ভ্রমণ ও দেশ-বিদেশ

রূপকথার দেশ নিউজিল্যান্ড (পর্ব ১০-১৬) [ধারাবাহিক]



সবিতা বিশ্বাস


পর্ব - ১০

কোনো একটি দেশ সম্পর্কে আলোচনা হলেই আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে সেখানে লোকজনের অভ্যাস কি, আচার আচরণ কেমন, আমাদের দেশের সাথে কোথায় মিল, কোথায় অমিল। যেমন ওদেশের মানুষ না ডাকলে কারো বাড়িতে যাবে না। অন্যের প্রাইভেসি কে ওরা খুব সম্মান করে। শান্তিপ্রিয় মানুষ জন নিজের পরিবারের সাথে সময় কাটাতে অত্যন্ত পছন্দ করে। আর ওদের ভীষণ ভালো লাগা হলো বই পড়া। বাড়িতে তো অবসর সময়ে বই পড়ে। তাছাড়া নিয়মিত লাইব্রেরী তে গিয়ে বই পড়বে, ট্রেনে বাসে যাতায়াত করছে, সবার না হলেও বেশিরভাগ মানুষের হাতে পছন্দের বই।

শুনে তো আমি লাফিয়ে উঠি। সুমনা ওদের লাইব্রেরী নিয়ে কিছু বল।

সুমনা বলে, ওদেশে সবাই বাচ্চাদের নিয়ে লাইব্রেরী তে যায়। হয়তো দুই বছরের বাচ্চা। মা তাকে বাচ্চাদের রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজের পছন্দ অনুযায়ী বই নিয়ে পড়তে বসে গেলেন। বাচ্চাদের ঘরে যিনি লাইব্রেরিয়ান আছেন তিনি বাচ্চাটিকে জীবজন্তুর ছবিওয়ালা বই, ছড়ার বই দিলেন। বাচ্চাটি ইচ্ছে মতো বইটি নিয়ে দুমড়েমুচড়ে ছিঁড়েই ফেললো। সেজন্য তাকে মারাও হবে না, বকাঝকা ও করা যাবে না। বরং তার হাতে আরো অনেক গুলো বই তুলে দেওয়া হবে। এই ভাবে বই নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতে তার মধ্যে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মাবে। আগ্রহ তৈরি হবে। রুচি, পছন্দ সব তো শৈশব কাল থেকে তৈরি হয়।

কিছুটা দূরে দূরেই লাইব্রেরী রয়েছে। বসে পড়ার ব্যবস্থা আছে আবার ইচ্ছে হলে বাড়িতে ও নিয়ে আসা যায়। ফেরত দেবার নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। পড়ুয়া মানুষ বলে প্রায় সবার বাড়িতেই একটি বইয়ের আলমারি থাকবেই।

আমি বলি,সুমনা, সামনেই তো বড়োদিন। ওখানে খুব জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হয়। তাই না রে?

সুমনা বলে, না গো। বড়ো দিনে একদম হৈচৈ হয় না। বরং সেই সময় পথে ঘাটে লোক জন থাকে না বললেই চলে। সবাই যে যার বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বড়দিন উপলক্ষে নানা ধরনের খাবার দাবার বানায়। রকমারি কেক, কুকিজ তৈরি করে। হ্যাম, টার্কি রোস্ট হয়। দূরে দূরে থাকা ভাই বোনেরা একত্রিত হয়ে গল্প গুজব আড্ডায় সময় কাটায়। সেখানে বন্ধু বান্ধব দের আমন্ত্রণ জানানোর রীতি নেই।

সুমনাদের অনেক বন্ধু বান্ধব আছে যারা হয়তো অষ্ট্রেলিয়া অথবা জার্মানি থেকে এসেছে। তারা তো নিউজিল্যান্ডের বড়দিন উদযাপন দেখে অবাক। তাদের দেশে বড়দিন মানে হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। দীপাবলি উৎসবের সময় আমরা যেমন আলোক মালায় বাড়ি সুসজ্জিত করি ওরা তেমন ভাবেই বাড়িঘর সাজিয়ে বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নাচ, গান, সুপেয় পানীয়, সুস্বাদু ভোজ্য বস্তুর আয়োজন করে। কখনো দু' তিন দিন কখনো সপ্তাহ ব্যপী চলে সে উৎসব। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত না হলে উৎসবে ভাঁটা পড়ে না।

ফলের ভাঁড়ার নিউজিল্যান্ডে আঙুরের পর আঙুর ক্ষেত। আঙুর থেকে তৈরি হচ্ছে আকর্ষণীয় সুস্বাদু ওয়াইন। আঙুর ক্ষেতে ঢুকলে আঙুর থেকে ওয়াইন তৈরি করার প্রক্রিয়া যেমন দেখতে দেয় তেমনি সকলকে স্বল্প পরিমাণ ওয়াইন দিয়ে আপ্যায়ণ ও করা হয়।

এখানে অ্যাবোগাডো নামক এক ধরনের ফল আছে যেটা খেতে একদম আমাদের দেশের আমের মতো।

প্রায় সবার বাড়িতেই হলুদ বর্ণের রসালো লেবু গাছ আছে।

নিউজিল্যান্ডে সোনার খনি আছে। খনিতে কাজ করার জন্য প্রচুর শ্রমিক চীন দেশ থেকে এদেশে আসে। চীনারা অসম্ভব পরিশ্রমী হয়। খনিতে কাজ করার জন্য বলিষ্ঠ ধৈর্যশীল মানুষের প্রয়োজন হয়। খনির কাজ হয়ে গেলে তারা খনির আশপাশের বালি কুড়িয়ে বাড়ি নিয়ে যায়। সেই বালি ধুয়ে ধুয়ে তার থেকে কণা কণা সোনা বের করে।

তখন আমার মনে পড়লো, শুনেছি এক সময় সুবর্ণরেখা নদীর বালিতে সোনা পাওয়া যেতো বলেই এই নদীর নাম হয়েছে সুবর্ণরেখা নদী।

চীনারা কর্মঠ জাতি। ছেলেরা যখন খনিতে কাজ করতে যায় তখন তাদের স্ত্রী, মেয়েরা নানা ধরনের সবজি নিয়ে বসে যায় নদীর তীরে। সুমনা বলে - ওদের কাছে যে সব সবজি পাওয়া যায় তার অনেক কিছুই সুপার মার্কেটে পাওয়া যায় না। যেমন করলা, মোটা মোটা সাদা মুলো, ঝাল লঙ্কা, বিভিন্ন রকমের শাক। দাম ও সুপার মার্কেটের চাইতে অনেক কম। ফলে অনেকেই যাতায়াতের পথে এই তরতাজা টাটকা সবজি কিনে নিয়ে যায়।

বিশ্ব উষ্ণায়ণের ফলে নদী, সমুদ্রের জল স্তর অনেক বেড়ে গেছে। নদী বা সমুদ্রের নিকটবর্তী স্থানে যারা ঘর বেঁধে আছে তাদের সবার বক্ষ দুরু দুরু। যে কোন দিন প্লাবিত হয়ে যেতে পারে তাদের সাজানো স্বপ্নের সংসার জীবন।

এক দিকে মাঝে মাঝেই ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। আগ্নেয়গিরি জানান দেয়, সে জীবিত আছে,অপরদিকে জলে প্লাবিত হবার আশঙ্কা। এই উভয় সঙ্কটের মধ্যে ও জীবন রস রসিক মানুষ প্রেম নিবেদন করে, গান গায়, গীটার বাজিয়ে নিজের ও অন্যের মনোরঞ্জন করে। সংসার বাঁধে। সন্তান পালন করে। সর্বংসহা ধরিত্রী মাতা এইভাবেই তার সন্তানদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করে ধারণ করে আছেন। সন্তান কে স্বযতনে আগলে রাখাই যে মায়েদের সনাতন রীতি। মাতৃস্নেহ দেশ কাল ভেদ মানে না।


পর্ব - ১১

আজ আমি বলব সুমনার আর এক প্রতিবেশী, ঘনিষ্ঠ উপকারী বন্ধু, ভিক্টোরিয়ার কথা। পাহাড়ী এলাকার বাড়িগুলো কোনটা অনেক গুলো ধাপ উঠে যেতে হয় আবার কারো বাড়িতে যেতে হলে রাস্তা থেকে কয়েক ধাপ নেমে যেতে হয়। ভিক্টোরিয়ার বাড়ি রাস্তা থেকে অনেকটাই উপরে। তবে তার লেটার বক্সটা সুমনার বাড়ির একদম পাশে। ভিক্টোরিয়া যখন লেটার বক্সটা খুলে চিঠি নিতে আসতেন তখন সুমনার সাথে প্রথমে চোখাচোখি, হাসি বিনিময় তার পর আলাপচারিতা,ভাব বিনিময়।

২৫ একর জমির ওপর ভিক্টোরিয়ার বাড়ি। বিশাল বড় বাগান। হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া ছিল না বটে, তার গোয়াল ভরা ধবলী,শ্যামলী গাই ছিল, রাঙা গরুর দুধ ছিল, রামছাগলের মতো লম্বকর্ণ ছাগল ছিল আর ছিল কিছু নিরীহ গাধা। নীরবে কাঁধে তুলে ভারী জিনিসপত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে হলে গাধা ছাড়া চলে না।

ভিক্টোরিয়ার আরও একটি জিনিস ছিল। সেটা হলো হেলিকপ্টার। এতো এতো বাগ বাগিচা,ফলের বাগান, শস্যক্ষেত্র যে হেলিকপ্টার ছাড়া এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া অসম্ভব।

ভিক্টোরিয়ার স্বামী নিকোলাস। বিশাল বড়ো দৈর্ঘ্যে প্রস্থে। মিলিটারীতে চাকরি করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধে বাধ্যতামূলক ভাবে যোগদান করতে হয়েছে। শান্তিপ্রিয় মানুষ তিনি। যুদ্ধে যেতে চাইতেন না। কামান বন্দুক দেখলে খুব ভয় পেতেন।

নিরুপায় হয়ে ক্যাপ্টেন তাকে দিলেন গরু দোহনের কাজ। সোলজারদের জন্য গরু দুইয়ে, দুধ জ্বাল দিয়ে দুধের গ্লাস তাদের মুখের সামনে ধরতেন। সেই সময় কিছু ভারতীয় সেনার সাথে তার আলাপ পরিচয় হয়। তাদের কাছ থেকে কিছু আদব কায়দা শিখেছেন। রাস্তার মাঝখানে আকস্মিকভাবে সুমনাকে দেখে দু হাত একত্রিত করে বলেছেন, নমস্তে। সুমনা তো ভয়ানক চমকে গেছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। উনি নিজেই বললেন, শাড়ি দেখে ই বুঝতে পেরেছি ভারতীয় নারী।

কফি খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যান নিজের বাড়িতে। লাঞ্চ খাইয়ে পৌঁছে দেন সুমনার নিজের বাড়িতে।

গল্পে গল্পে সুমনা জানতে পারে ভিক্টোরিয়া নিকোলাসের দ্বিতীয় স্ত্রী। দুই জনের মধ্যে বয়সের ব্যবধান কুড়ি বছর। প্রথমা স্ত্রী দুই ছেলে এক মেয়ে রেখে খুব অসুস্থ হয়ে মারা গেলে ছেলে-মেয়েদের দেখা শোনা করার জন্য দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ। ভিক্টোরিয়া নিজের এক পুত্র ও এক কন্যার সঙ্গে আগের ছেলে মেয়ে দের এতো টুকু বৈষম্য দেখাতেন না। তারা ও আনন্দের সঙ্গে দ্বিতীয়া মাকে আপন করে নিয়েছে। এখন পাঁচ পুত্র-কন্যা সুপ্রতিষ্ঠিত। যে যার কর্মস্থলে থাকে। বিশেষ বিশেষ উৎসব উপলক্ষে সবাই এক সাথে মিলিত হয়ে কয়েকটি দিন কাটিয়ে যায়। ওরা চলে গেলে এত বড়ো বাড়িটা যেন আরও বিশালাকৃতি ধারণ করে। তখন মাত্র দুই মানুষ থাকতে থাকতে যেন প্রস্তরীভূত হয়ে যান। এতো কাজের মধ্যে নিজেদের নিয়োজিত রেখেও একটুখানি গল্প গাছা করার জন্য হাঁফিয়ে ওঠেন।

সুমনাদের কাছে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেলেন। বিশেষতঃ মনোজ তখনো শিশু। শিশুদের কে না ভালোবাসে? মনোজের জন্য কিনে নিয়ে আসেন দামী বাইনোকুলার। তাকে কত পাখি চেনান। পাখিদের স্বভাব বৈশিষ্ট্যের সাথে পরিচয় ঘটান।

ভিক্টোরিয়া আর নিকোলাস দুজনেই খুব গল্প করতে ভালোবাসেন। তারা দুজনেই ওয়েলিংটন সম্পর্কে অনেক ইতিহাস অবগত আছেন। ইন্ডিয়ার প্রতি তাদের খুব শ্রদ্ধা বোধ রয়েছে।

নিকোলাস সুমনাদের বলতেন,’ স্পেশাল ইন্ডিয়ান ফ্রেন্ড’।

ইন্ডিয়ানদের প্রতি তার অপরিসীম ঔৎসুক্য। কৌতূহল নিরসন করার জন্য সুমনাদের অজস্র প্রশ্ন করতেন।

দেশের কথা বলতে পেরে সুমনা র ও খুব ভালো লাগতো।

ভিক্টোরিয়া যখন বারো-তেরো বছরের কিশোরী, তখন তার মায়ের সঙ্গে ভারতে এসে কয়েক মাস কাটিয়ে যায়। কেন মা ভারতে এসেছিলেন সে সম্পর্কে কিছু মনে করতে পারে না ভিক্টোরিয়া। শুধু মনে পড়ে মুম্বাই শহরে মা ছিলেন। সেই থেকে ইন্ডিয়ানরা এলে ভিক্টোরিয়া তাদের সঙ্গে ভাব করে বর্তমান ভারত সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে চান।

ভিক্টোরিয়া খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সারা দিন ঘরবাড়ি, বাগান নিজের হাতে পরিষ্কার করে চলেছেন। সবসময় ফিটফাট পোশাক পরা। ঘাস কাটার মেশিন দিয়ে ঘাস কাটতে যাচ্ছেন। স্কার্টের ওপর যে রুমালটি নিয়েছেন সেটা পর্যন্ত ইস্ত্রী করা। ভিক্টোরিয়া ঘুম থেকে উঠেই সুসজ্জিত হয়ে তার পর বাইরে বের হতেন।

গৃহ সজ্জাতেও খুব শৌখিন ছিলেন। নিকোলাস অনেক দিন ইতালিতে ছিলেন। সেখান থেকে অনেক ঘর সাজানোর জিনিস এনেছিলেন। ভিক্টোরিয়া সে সব জিনিসপত্র দিয়ে ঘরের শোভা বর্ধন করতে সব সময় ব্যস্ত থাকতেন। নিত্য নতুন যত্নে পুরনো জিনিসপত্র ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সজ্জিত করে পুরনো ঘরকে নতুন করে তুলতেন।

ভিক্টোরিয়া, মাদার টেরেসার বড়ো ভক্ত ছিলেন। মাদার টেরেসা কলকাতায় থাকতেন বলে কলকাতার মানুষ জনকে তিনি শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। সুমনা ভিক্টোরিয়াকে মাদার টেরেসার একটি মূর্তি দিয়েছিল। তাতে ভিক্টোরিয়া আনন্দে অভিভূত।

প্রথম জীবনে ভিক্টোরিয়া একটি বাচ্চাদের স্কুলে পড়াতেন। এর ফলে শিক্ষকতা তার রক্তে। সুমনাকে অনেক জিনিস শেখাতেন। কেক তৈরি করা, নিত্য নতুন রান্না করা, অতিথিদের খাবার সার্ভ করা, কি ধরণের পাত্রে কোন খাবার পরিবেশন করতে হয়, সব কিছু শেখাতেন।

ভিক্টোরিয়ার একটি চারা গাছের দোকান ছিল। গাছের যত্ন কিভাবে নিতে হয়, কি ভাবে গাছের পরিচর্যা করতে হয় সব ছিল তার আয়ত্তে। গাছ দিয়ে তিনি ঘর বাড়ি সাজাতেন। তার বাথরুম ও গাছ দিয়ে সাজানো থাকতো।

ভিক্টোরিয়ার বসার ঘরে ভেলভেটের পর্দা টানা। প্রতিটি কুশন কাভার এমব্রয়ডারি করা। ভিক্টোরিয়ার নিজের হাতে তৈরি।

ভিক্টোরিয়া ভালো পিয়ানো বাজাতে পারতেন। ভিক্টোরিয়ার নাতনি তার কাছে বেড়াতে এলে নাতনিকে নিজের সব বিদ্যাগুলো শেখাতেন। ভিক্টোরিয়ার স্নেহমাখা স্বভাব মাধুর্যে পর ও আপন হয়ে উঠতো।

অনেক দূরে চলে যাবার পর মাঝে মাঝেই সুমনারা ভিক্টোরিয়ার বাড়িতে বেড়াতে আসতো। আনন্দে অভিভূত ভিক্টোরিয়া ভেবে পেতেন না কিভাবে তাদের যত্ন করবেন।

ভিক্টোরিয়ার একটি ক্যারাভান ছিল। ক্যারাভান হলো বাসের মতো সচল। ওটা নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে বেড়ানো যেত। ভেতরে ডাবল বেডের বিছানা। চেয়ার টেবিল ফ্যান সব কিছু আছে। মনোজ ক্যারাভানে থাকতে খুব ভালোবাসত।

ভিক্টোরিয়া সুমনাকে নিয়ে মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। আবার কখনও কোনো নদীর সঙ্গম স্থলে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অতুলনীয় শোভা দেখাতে নিয়ে যেতেন। নদীর বালুচরে ফটো তুলতেন। নদীর বালি এনে গাছের গুঁড়িতে দিতেন।

ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলেই সুমনা কে বলতেন, ঘরের ভেতরে বড় সিলিন্ডারে বেশি করে গরম জল রাখো।

একবার মনোজকে বাড়িতে রেখে সুমনা আর তপন বাইরে কোথাও কোন কাজে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে এমন ইচ্ছে ছিল। কিন্তু চারিদিকে হঠাৎ করে তুষার পাত শুরু হয়েছে। গাড়ির কাঁচ ঝাপসা। পথ পিছল। খুব ঝুঁকি নিয়ে আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে অনেক দেরি করে বাড়ি পৌঁচেছে। মনোজের জন্য চিন্তায় ব্যকুল। একা একা ছেলেটি কি করছে কে জানে? ঘরে ঢুকে দেখে ছেলে বাড়িতে নেই। ছেলে কোথায় গেল? দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় সুমনা কেঁদে আকুল। হঠাৎ করে ফোন বেজে উঠলো। দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরতেই ভিক্টোরিয়ার গলার স্বর। তুষারপাতের সঙ্গে সঙ্গে আমি গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম তোমাদের বাড়ি দেখতে যে তোমরা সবাই কেমন আছো। এসে দেখি মনোজ বাড়িতে একা। পাছে এটি কেউ জেনে ফেলে তাই ওকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসে ফায়ার প্লেসের পাশে বসিয়ে রেখেছি। আলো জ্বলছে দেখে বুঝতে পারলাম তোমরা ফিরে এসেছো। আমার বাড়িতে চলে এসো। ডিনার করে ফিরবে।

সুমনা বলে, সেদিন আমি সারা রাত জেগে-জেগে তুষারপাতের সৌন্দর্য উপভোগ করেছি আর মা দিদিকে ফোন করে সেই সৌন্দর্য বর্ণনা করেছি।


পর্ব - ১২

প্রথম তুষারপাতের সৌন্দর্য দেখে সুমনা খুব উত্তেজিত।

শ্বেত-শুভ্র তুষার কণা হালকা পেঁজা তুলোর মতো ঝিরিঝিরি করে আস্তে আস্তে গাছগুলো, বাইরে থাকা গাড়ি, জনহীন রাস্তা সব ঢেকে দিল। ঘরের কাঁচের জানালার ভারি পর্দা সরিয়ে সুমনা দেখছে একটি সুন্দর সাদা পাতলা চাদর দিয়ে ঢাকা পড়ে গেল বিশ্ব প্রকৃতি। কি পবিত্র তার রূপ!কি অনবদ্য তার সৌন্দর্য!

গোল বাঁধলো পরদিন সন্ধ্যায় যখন তুষার ঝড়ে ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার উপক্রম। একটুখানি আগুন গরম কফি না খেলেই নয়। ইলেকট্রিক হিটার অকেজো। ফায়ার প্লেসের পাশে একটুকরো জ্বলন্ত কাঠের ওপর কফির কেটলিতে জল বসানো হলো। কফি তৈরি ও হলো। খেতে গিয়ে দেখে বিস্বাদ। প্রবল ধোঁয়ার গন্ধ।

দরজায় টোকা পড়লো। খুলে দেখে নিকোলাস। তার রেইনকোট বেয়ে জলের ধারা নেমেছে। এই প্রবল তুষার ঝড়ে ওরা কি করছে দেখতে এসেছেন। সব দেখে শুনে বললেন, হাই ইয়ং ম্যান, আমি তোমাদের নিয়ে যেতে এসেছি। ভিক্টোরিয়া তোমাদের জন্য খুব চিন্তিত। তোমরা ফ্রিজের খাবার দাবার কিভাবে গরম করবে? আমাদের বাড়িতে ডিনার করবে। তার পর আমি আবার গাড়ি করে তোমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেবো।

সেখানে পৌঁছে দেখে ভিক্টোরিয়া নতুন গরম টাওয়েল নিয়ে রেডি। ওরা যেতেই গরম তোয়ালে জড়িয়ে ধরে গা গরম করে দিল। আর একপ্রস্থ উষ্ণ কফি। ভিক্টোরিয়া ফায়ার প্লেসের পাশে বসিয়ে কফি তৈরি করেছেন কিন্তু তাতে তো ধোঁয়ার গন্ধ নেই। কি ভাবে সম্ভব হলো? ভিক্টোরিয়া হাসেন। বললেন, অনেক বছর আছি তো। সব শিখে নিয়েছি। তুমি ও শিখে যাবে থাকতে থাকতে। সুমনা, ফোন তো সব ডেড। বাড়িতে নিশ্চয়ই ফোন করতে পারো নি। তোমার বাবা মা খুব চিন্তা করছেন। আমাদের কর্ডলেস ফোন থেকে ফোন করে আগে বাবা মা কে চিন্তা মুক্ত করো।

তার পর সুমনা আর তপনকে অনেক ক্ষণ ধরে শেখালেন এই সব আপতকালীন অবস্থায় কি কি জিনিসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আগে থেকেই সব কিছু সংরক্ষণ করে রাখতে হবে।

গরম জলের সিলিন্ডারে বেশি করে গরম জল জমা করে রাখতে হবে যাতে ঐ গরম জল দিয়ে সব কাজ করা যায় কারণ ইলেকট্রিসিটি না থাকলে গীজার কাজ করে না।

নিকোলাস মারা যাবার পর ভিক্টোরিয়া খুব একা হয়ে যান। প্রায়ই সুমনাদের নিমন্ত্রণ করেন।সুমনার হাতের গোলাপ জামুন খেতে খুব ভালোবাসতেন বলে সুমনা গোলাপ জাম আর মালপোয়া করে নিয়ে যেত। অনেক দিন ধরে একটু একটু করে তিনি রেখে রেখে সে খাবার খেতেন।

এবার সুমনা আর তপন গেছে। গিয়ে দেখে ভিক্টোরিয়া তাদের জন্য ভাত রান্না করেছে। ভিক্টোরিয়া কোনো দিন ভাত খান নি। সুমনা দু’এক বার খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু ভাত খেতে পারেন নি। খেলেই ওনার হজমের গোলমাল হয়ে সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটে। সুমনা ভাত দেখে বলে, তুমি ভাত রাঁধতে কোথায় শিখলে? সলজ্জ হাসি হেসে ভিক্টোরিয়া বলেন, আমি আমার মেয়েকে বললাম, ইউ টিউব থেকে তুমি আমাকে ভাত রান্নার রেসিপিটা বলো।

মেয়ে বললো যতোটা চাল নেবে তার দ্বিগুণ জল নেবে। চালটা ভালো করে ধুয়ে জল ঝড়িয়ে রেখে দেবে। ভাতের জল ফুটে উঠলে তাতে একটুখানি ভিনিগার আর কারি মশলা দেবে। তার পর চাল দেবে। মাঝে মাঝে নেড়ে চেড়ে দেবে। জলটা শুকিয়ে গেলে নামিয়ে নেবে। আমি ঠিক করে রাঁধিনি সুমনা?

ভয়ার্ত ভিক্টোরিয়াকে অভয় দেয় সুমনা। তুমি একদম ঠিকঠাক রেঁধেছ। এটাই ভাত রান্নার নিয়ম।

আমি আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করি - ভাতটা খেতে সত্যি সত্যি কেমন হয়েছিল রে?

- জানো তো, খেতে খারাপ হয়নি। শুধু একটু স্টিকি মানে আঠালো আঠালো হয়েছিল। আর কারি মশলা দেবার দরুণ রং টা হয়েছিল একেবারে বাসন্তী পোলাওয়ের মতো। ঘি আর গরম মসলা, কাজু কিসমিস দিলে ই বাসন্তী পোলাও। তবে একটা জিনিস আমার খুব খারাপ লাগছিল। ভিক্টোরিয়া তো খাবারের মাপ জানে না। অনেক টা ভাত রান্না করে ফেলেছে। আমরা দুজন খাওয়ার পর অনেকটা ভাত বেঁচে গেছে। ভিক্টোরিয়া তো ঐ ভাত ফেলে দেবে। ও তো ভাত খায় না। আবার দেবার ও লোক নেই। সেটাই আমার কাছে খুব খারাপ লাগছিল। নিজের দেশ ছেড়ে এখানে এসে অনেক অভ্যাস ত্যাগ করেছি। নতুন অভ্যাস তৈরি করেছি। কিন্তু খাদ্যাভ্যাস টা পরিবর্তন করতে পারি নি। দিনান্তে একবার ভাত না খেলে মনে হয় কি যেন একটা খাইনি।

আমি বললাম - সুমনা, ভাতের গল্প শুনবি? শোন।

আমার এক মাড়োয়ারী বন্ধু। তার পূর্ব পুরুষরা অনেক দিন আগে এই পশ্চিমবঙ্গে ব্যাবসা করতে এসে থেকে গেছে। কয়েক পুরুষে ওরা পুরোপুরি বাঙালি হয়ে গেছে।

আমার বন্ধুর বিয়ের বয়স হয়েছে। ওদের খুব কম বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়। পাত্র দেখতে এসে অপছন্দ করে চলে গেছে। পাত্রের মা জিজ্ঞেস করলেন, বেটা, লেড়কিকে তোর পছন্দ হলো না কেন? বেটা বলে, মাম্মা, ওরা এদেশে থাকতে থাকতে বাঙালি বনে গেছে। দুই বেলা ভাত খায়। বাংলায় নিজেরা কথা বলে। আদব কায়দা সব বাঙালিদের মতো হয়ে গেছে। ওদের সঙ্গে আমাদের বনিবনা হবে না। ব্যস্, সম্বন্ধ ক্যান্সেল।

ছয় মাস পর পাত্রের বন্ধু আর একটা সম্বন্ধ এনেছে। বিবরণ শুনে পাত্র বলে, আরে, ও লেড়কিকে তো আমি ছমাস আগে রিজেক্ট করে দিয়েছি। আমার না পসন্দ আছে। বন্ধু ওকে এই মারে তো সেই মারে।

- বুদ্ধু, উল্লুক, উজবুক। এতো ভালো পাত্রীকে রিজেক্ট করে দিয়েছিস? এমন ভালো লেড়কি আর পরিবার আর পাবি না।

বন্ধুর কথায় কাজ হয়। ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায়।

মাড়োয়ারীদের মধ্যে বিয়ের পর বধূ পয়া না অপয়া - এই ব্যাপারটা খুব প্রাধান্য পায়। সেই বুঝে বধূর আদর যত্ন।এই বধূ আসার পর ছোট দোকান বড়ো হয়। ব্যবসার প্রসার লাভ ঘটে। বৃদ্ধি হতে হতে এখন তারা ধণাঢ্য ব্যক্তি।

কিন্তু বিয়ের কয়েক দিন পর মেয়ে বাপের বাড়ি এলে মেয়েকে দেখে বাবা-মায়ের মুখ শুকিয়ে যায়। একি কঙ্কালসার চেহারা হয়েছে। শাশুড়ি নিশ্চয়ই খেতে দেয় না। মেয়েকে চেপে ধরেন বাবা-মা। মেয়ে তখন সত্যি কথা বলে। শ্বশুর বাড়িতে সব আছে। ভাত নেই। চারবেলা রুটি, চাপাটি, পরোঠ্ঠা। লেকিন ভাতের কথা একবারও উচ্চারিত হয় না। অথচ মেয়ে চার বার ভাত খেতো। রুটি চাপাটি পরোঠ্ঠা ছুঁয়েও দেখতো না। এখন প্রায় অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটে।

ক্ষুব্ধ পিতা আদুরে মেয়েকে শ্বশুরালয়ে নিজের গাড়িতে করে নিয়ে আসেন। মান মর্যাদা শিকেয় তুলে শাশুড়ির কাছে সসঙ্কোচে আবেদন করেন, দুধ ঘিউ মাক্খন কিচ্ছুটি চাই না। মেয়েকে চারবার যেন শুধু সবজি ভাত দেওয়া হয়। অপ্রসন্ন মুখে শাঁসু মাতা রাজী হয়ে যান ভাত দিতে।

পরদিন থেকে চার বার সবজি ভাত জোটে। সাথে উপরি পাওনা, শাঁসু মায়ের গঞ্জনা। ভাত রাঁধতে ইতনা গ্যাস খরচ হয় তাতে এক সপ্তাহের রুটি হয়ে যায়।

কান্নায় ছলছল মেয়ের বেদনা ফোন বাহিত হয়ে বাবার কানে পৌঁছে যায়। স্নেহশীল পিতা পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই এক বস্তা চাল আর এক টি গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে হাজির হয়ে যান বেয়ানের বাড়ি। গলবস্ত্র হয়ে নিবেদন করেন, যতদিন তিনি জীবিত থাকবেন ততদিন প্রতিমাসের পহেলা তারিখে এক বস্তা চাল আর একটা গ্যাস সিলিন্ডার তিনি বেয়াইনের জন্য পাঠিয়ে দেবেন।

বেয়াইন যেন এতে গুস্সা না করেন।

শাশুড়ি মাতার কপালের ভাঁজ সোজা হয়।

সেই থেকে পিতাজী তার প্রদত্ত বাক্য অক্ষরে অক্ষরে আমৃত্যু পালন করে গেছেন।

আমার বন্ধুর স্বামী বা দেবর এই মান হানিকর, মর্যাদাহীন ব্যবস্থায় খুব অসন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু মায়ের বিরুদ্ধে একটি শব্দ উচ্চারণ করার সাহস তাদের ছিল না। তাদের কাছে মা সবার উপরে। সমালোচনা করার ঊর্ধ্বে তার আচার আচরণ।

বলতে বলতে আমার বন্ধুর দু'ফোঁটা মুক্তোদানা গড়িয়ে পড়ে দুই চোখ থেকে। একটি ফোঁটা অত্যন্ত স্নেহময় পিতার অপত্যস্নেহ মনে করে। আর এক ফোঁটা নির্দয় শাশুড়ি মাতার লাঞ্ছনার শিকার হবার অবমাননার জন্য।


পর্ব - ১৩

আমার বন্ধুর ভাতের গল্প শুনে সুমনা কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। পরে অস্ফুটে বলে ওঠে - ভাত এতো মহার্ঘ্য? এর জন্য অশ্রুমোচন? তাও ধনীর দুলালীকে?

পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে দেখে আমি বললাম, সুমনা, ওদেশে খেলা নিয়ে আমাদের দেশের মতো উন্মাদনা আছে? আমাদের তো জানিস। সাপোর্টাররা এতটাই ডেডিকেটেড যে নিজের ফেভারিট দল জিতলে হৈচৈ বাজি ফাটানো, পাড়া একেবারে মাথায় করে তোলে। আবার নিজের দল হারলে শয্যাশায়ী হয়ে যায়। রাগে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করে এমন ঘটনাও শুনেছি।

সুমনা বলে, খেলা নিয়ে হৈচৈ আছে। উন্মাদনাও আছে। তবে পাগলামো নেই। আসলে এখানকার লোকজন খুব পরিশীলিত, মার্জিত বলে তাদের আবেগের প্রকাশ টাও সংযত ভাবে হয়। ফুটবল, ক্রিকেট জনপ্রিয় খেলা হলেও এদের সব চাইতে প্রিয় খেলা হলো রাগবি। বেশিরভাগ মানুষ খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে চলে যায়। যারা বৃদ্ধ বৃদ্ধা, অশক্ত তারা যান কমিউনিটি সেন্টারে, শপিং মলে অথবা কোনো কফি শপে। বিশাল বড়ো স্ক্রীনে সবাই মিলে একসাথে খেলা দেখার মজাই আলাদা। এই সুযোগ সহজে ছাড়া যায় না। মানুষ মানুষের সঙ্গ সব সময় ই চায়। খেলা দেখতে ওরা অনেকেই অষ্ট্রেলিয়া বা ইওরোপ চলে যায়। এটা ওদের কাছে সল্টলেক থেকে দমদম বা বারাসাতে যাবার মতো ব্যাপার। রাগবি খেলা দেখতে বা খেলোয়াড়দের উৎসাহিত করার জন্য যে ছেলেটি খেলছে তার বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাই মিলে দল বেঁধে চললো সেই সুদূর জাপানে। এটা ওদের কাছে কোনো ব্যাপারই না। এখানকার লোকজন খুব বেড়াতে ভালোবাসেন। বেড়াতে যেতে পারলে আর কোনো কিছু চান না। অষ্ট্রেলিয়া তো জলভাত। ইতালি, ফ্রান্স ঘুরে এসেছেন এমন মানুষ এখানে বহু আছেন। ইন্ডিয়া সম্পর্কেও ওদের অনেক জিজ্ঞাসা। আমাকে অনেক অনেক প্রশ্ন করেন। সাধ্য মতো জবাব দিই।

নিকোলাস তো আমাকে শাড়ি পরতে দেখলে কি খুশি হতেন। আর টিপটা ওদের কাছে বিস্ময়। যখন কোনো পার্টি হতো, আমি মেয়েদের সবাইকে টিপ পরিয়ে দিতাম। ওদের সৌন্দর্য শতগুণ বেড়ে যেতো। ওরা আনন্দে বারবার নিজেদের হাত আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেরাই খুশিতে আত্মহারা। খুশি টাকে চেটেপুটে উপভোগ করতে ওদের মতো আর কাউকে দেখলাম না।

একটা সামান্য গিফট দিলে খুশিতে উপচে পড়তো। ওটা যে ওর খুব পছন্দের জিনিস সেটা বারবার করে বলতো।

আমাদের দেশের জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, বিয়ে ইত্যাদি অনুষ্ঠানে গিফট দিলে অতিথির সামনে গিফট খোলার রেওয়াজ নেই। নিমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই চলে যাবার পর বাড়ির লোকজন উপহারের মোড়ক উন্মোচন করে চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বেডকাভারের পাহাড়ের সামনে বসে উপহার দাতাদের মানসিকতার উন্নতি অবনতির উপর শিলমোহর পড়ে। ওদের দেশের রীতি আলাদা। উপহার দাতাদের সামনে প্যাকেট খুলে উপহারসামগ্রী, তা হোক না যতই তুচ্ছ বা স্বল্প দামের, ভূয়সী প্রশংসা করে উপহার দাতার মনোরঞ্জন করা হয়।

কেউ কারো বাড়িতে হাতে কিছু একটা না নিয়ে যাবে না। কিছু না থাকলে নিদেনপক্ষে বাড়ির গাছের ফুল নিয়ে গেলেও সবাই খুব খুশি। আর ফুল তো সবার বাড়িতেই অজস্র আছে।

খেলা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। গল্পে গল্পে এমনি হয়। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাই। বিবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। এবার সুমনা কে আমি খুব অস্বস্তিকর একটি প্রশ্ন করে ফেলি। আচ্ছা বলত, ভারত আর নিউজিল্যান্ডের খেলার দিনে তুই কাকে সাপোর্ট করিস? অনেস্টলি বলবি।

উত্তর দিতে একটু সময় নেয় সুমনা। তারপর বলে - আমি তোমাকে একটা গল্প বলি।

আমার পাশের বাড়িতে একটি বাচ্চা ছেলে আছে। তার নাম ক্রিস। ওর মা অষ্ট্রেলিয়ার মেয়ে, বাবা নিউজিল্যান্ডের। একদিন সবাই মিলে কমিউনিটি হলে বসে ক্রিকেট খেলা দেখছি। অষ্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের মধ্যে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শুরু হলো। এক বর্ষিয়সী ভদ্রমহিলা ছেলেটিকে আদর করে বললেন,

- ক্রীস, তুমি কোন্ দেশের সাপোর্টার?

ছেলেটি এক মুহূর্ত না ভেবে উত্তর দিল, যখন যে দল ভালো খেলে আমি তখন সেই দলের সাপোর্টার হয়ে যাই। সব সময় চাই ভালো খেলোয়াড়রা জিতুক। অনেক সময় আম্পায়াররা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে খারাপ দলকে জিতিয়ে দেয়। তখন আমার খুব রাগ হয়। মনে হয় ছুটে গিয়ে আম্পায়ারের নাকে ঘুঁষি চালিয়ে দিই।

আশা করি আমার উত্তর তুমি পেয়ে গেছো। অন্য দেশের সঙ্গে ইন্ডিয়ার খেলা থাকলে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে না। আমার খুব সুবিধে হয়। শিকড়ের টান কি কোনো দিন ভোলা যায়? যতো সুন্দর নিসর্গ প্রকৃতি থাকুক না কেন, যতোই সুযোগ সুবিধা থাকুক, সরকারি স্কলারশীপ আর তত্ত্বাবধান থাকুক - মনে মনে দিন গুণি, কবে যাবো আমার নিজের দেশে। আমার মাতৃক্রোড়ে। সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি। সব সময় খোঁজ খবর নিয়ে রাখি - প্লেন ফেয়ারে কখন কি ডিসকাউন্ট দিচ্ছে। তিন জনের টিকিট, যথেষ্ট ব্যয় সাপেক্ষ ব্যাপার। সাধ আর সাধ্যের মধ্যে শত যোজন ফারাক। এই তেইশ বছর পরেও কখনো কখনো সকাল বেলায় ঘুম ঘোরে মনে হয় আমি কোথায়? দমদমের বাড়িতে কি? ঘোর কেটে গেলে সত্যিটা চোখের সামনে প্রতিভাত হয়। মনটা ব্যথাতুর হয়ে ওঠে। বিভিন্ন পাখপাখালির কলকাকলিতে মুখরিত চারিদিক। ওদের মধ্যে তো কোনো এদেশ ওদেশের ভাগাভাগি নেই। মনে হয় দমদমের বাড়ির বিছানায় শুয়ে ওদের কলকূজন শুনছি।

ও পাখি, আমার বাপ মা রে গিয়া কইও, তোমাদের তুতুল খুব ভালো আছে। দেশের জন্য ওর এতোটুকু কষ্ট হয় না।

আমার দাদারে কইও, মনা খুব ভালো আছে। ওর জন্য তোমরা কাইন্দো না। মনা আর মামা মামা কইরা পাগল হয় না।

আমার দিদিরে কইও, সুমনা এখন অনেক রান্ধন শিখ্যা নিছে। দিদির হাতের পিঠা-পায়েস খাবার লাইগ্যা ওর মন আর এতো টুকু দুখায় না।

শনিবার দুপুরে আমার বৌদি না খেয়ে বসে থাকতো। আমি স্কুল থেকে ফিরলে এক সাথে ভাত খাবে বলে। সেদিন আমাদের বাপের বাড়িতে রান্না হতো তুতুলের সব পছন্দের খাবার। তুতুলের পছন্দ গুলো খুব অদ্ভুত। মাছ, মাং্‌ পোলাও, কালিয়া নয়। খুব অকিঞ্চিৎকর খাবার।

পোস্তর মুচমুচে বড়া, ন্যাকড়ায় বেঁধে মুসুর ডাল এক হাঁড়ি ভাতের মধ্যে দিয়ে সেদ্ধ করা, তাতে বেশি করে সরষের তেলে পেঁয়াজ কুচি, লঙ্কা কুচি দিয়ে মাখা, মানকচু বেটে আচ্ছা করে ঝাল দিয়ে কড়াইতে তেল দিয়ে ভাজা ভাজা করা, ভেজানো ছোলা আর নারকেল কোড়া দিয়ে কচুর শাক, সামান্য সরষে বাটা দিয়ে কচুর লতি।

তুতুল ইন্ডিয়াতে রয়ে গেছে। সুমনা ওরে নিউজিল্যান্ডে নিয়া আসে নাই।

স্কুলের বাচ্চাদের খুব কষ্ট হয় সুমনার নাম উচ্চারণ করতে। ওদেশে বাচ্চারা ও ম্যাডাম, ম্যাম বলে না নাম ধরে ডাকে। তখন সুমনা মাঝে-মাঝেই বলে, আমার আর একটা নাম আছে। তুতুল। উচ্চারণ করতে সহজ। তোমরা আমাকে ঐ নামেও ডাকতে পারো। সেই সময় বিনা পাসপোর্টে বিনা ভিসাতে তুতুল চলে আসে নিউজিল্যান্ড। নতুবা অন্য সময় তুতুল ইন্ডিয়াতেই থাকে।

বাবা মা দাদা বৌদি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তাদের মুখে মুখে। তারা চলে যাবার পর তুতুলও অনাথ হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। দিদি আছেন বলে দিদির জিহ্বাগ্রে এখনো তুতুল নামটি উচ্চারিত হয়।

তাই তুতুল ইন্ডিয়াতে আর সুমনা বাস করে নিউজিল্যান্ডে।


পর্ব - ১৪

সুমনা, নিউজিল্যান্ডের বাচ্চাদের কথা বল।

এদেশে বাচ্চাদের ভীষণ রকম আদর। আমরা ছোট বেলায় বাবা মায়ের হাতে, দিদিমণি,দাদামণিদের হাতে কতো চড়- চাপড়, কানমলা খেয়েছি তাতে আমরা বিচলিতও হতাম না, অনধিকার চর্চা বলেও মনে করতাম না। সবটুকু স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছি।

এখানে তা নয়। একটি বাচ্চার গায়ে ফুলের আঘাত দেওয়ার কথা কেউ ভাবতে পারে না। সব বাচ্চাদের ওপর থাকে রাষ্ট্রের নজর দারি। ছোট্ট শিশুদের তো কথাই নেই, পনেরো বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদেরও খুব নজরদারির ওপর রাখা হয়। তাদের একা বাড়িতে রেখে যাওয়া দন্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। বাচ্চাদের সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে হবে। তাদের মধ্যে কোনো ভুল তথ্য দেওয়া চলবে না।

ক্রিশ্চিয়ানো বলে সুমনার এক বন্ধু ওদের নিমন্ত্রণ করেছেন। মনোজ তখন সাত বছরের বালক। মনোজ তার বাড়ি গিয়ে খেলায় এতো মত্ত যে কিছুতেই খাবে না। সুমনা এক টুকরো ব্রেড কোনো রকমে খাইয়েছে। তারপর আর এক টুকরো ব্রেড হাতে নিয়ে বলছে, এই টুকরোটা খাও আর তোমাকে জোর করবো না। বাধ্য ছেলে মায়ের কথা মতো ঐ টুকরোটাও খেয়ে নিয়েছে। তার পর সুমনা আর এক টুকরো ব্রেড হাতে নিয়ে যেই মনোজকে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে অমনি ক্রিশ্চিয়ানো থাকতে না পেরে বলে উঠলেন, নো সুমনা নো। তুমি ছেলেকে কথা দিয়েছ ওই এক টুকরো খেলে আর খেতে বলবে না। তুমি তোমার দেওয়া কথা রাখছো না। ইট ইজ ভেরি আনফেয়ার।সুমনা বলে, সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিলাম আর ওদের কাছে শিখেছিলাম বাচ্চাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিত।

কোনো বাচ্চা মায়ের সঙ্গে কোনো শপিং মলে গিয়ে এটা ওটা তে হাত দিচ্ছে। বল নিয়ে খেলছে। একটা ক্যান্ডি মুখে পুরে দিল। কেউ কিচ্ছুটি বলবে না। শিশুকে বাধাও দেবে না। শিশুদের সাত খুন মাফ।

প্রতিটি শপিংমলে, মাল্টিপ্লেক্সে মায়েদের জন্য নির্দিষ্ট একটি ঘর থাকে। মায়েরা সেখানে গিয়ে বাচ্চাদের বক্ষ সুধা পান করান। শিশুর ন্যাপী পালটান।

ওদেশে অনেক বিষয়ের ওপর ছোট বড় নানা ধরনের কোর্স করা যায়। যেমন কারো ইচ্ছে হলো সে হসপিটালে গিয়ে রোগীদের জন্য কিছু করবে, তাদের মনোরঞ্জনের জন্য গান গাইবে। তাকে সে বিষয়ে কোর্স করে নিতে হবে। নতুবা হসপিটালে ঢোকার অনুমতি মিলবে না। তার হয়তো এক বছরের বাচ্চা আছে। বাড়িতে বাচ্চাকে দেখার কেউ নেই। সে অনায়াসে বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলে যেতে পারে। তার টিচার হয়তো তার কোল থেকে নিজের কোলে বাচ্চা টিকে নিয়ে নিলেন। বাচ্চা কোলে নিয়েই ক্লাসে পড়াচ্ছেন। মা পড়ায় নিমগ্ন। বাচ্চার দিকে তার কোনো নজর নেই।

এই রকম ঘটনা এখানে আকছার ঘটে।

অনেক অল্পবয়সী মা, হয়তো কোন মিটিং চলছে, সবার মাঝে বসেই বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছেন। এতে কেউই কিছু মনে করেন না। তবে আমাদের মতো রক্ষণশীলতা ওদেশেও আছে। অভিজাত, সম্ভ্রান্ত ঘরের ভদ্রমহিলারা এটাকে সুনজরে দেখেন না। যা শোভন, সুন্দর তাই প্রকাশ্য লোকালয়ে করা উচিত বলে তাদের অভিমত। কোথাও একটা শালীনতার সীমারেখা বজায় রাখা উচিত বলেই তারা মনে করেন।

অনেকের ধারণা আছে ওখানে ছেলে-মেয়ে বড়ো হয়ে গেলে তারা স্বাবলম্বী হয়ে যায়। তাদের জীবনে পিতা মাতার কোনো দায় দায়িত্ব বা প্রভাব থাকে না। এটি সর্বাংশে সত্যি কথা নয়। যে যার কর্মস্থলে থাকে বলে ঠাঁই আলাদা আলাদা হলেও সন্তানের প্রতি টান অটুট থেকে যায়। তার উদাহরণ স্বরূপ একটি গল্প পরে বলছি।

সুমনার বন্ধু ক্রিশ্চিয়ানো দীর্ঘদেহী। বলিষ্ঠ গড়ন। খুব লম্বা চওড়া পেশীবহুল ভারী চেহারা বলে বয়সের তুলনায় একটু বেশি বয়সী দেখায়। ওর স্বামী হলেন গ্যারী। ওদের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে অষ্ট্রেলিয়ায় থাকে। ছেলের জন্য সব সময় ওদের কি চিন্তা। ঘন ঘন ফোন করে জানতে চান তার টাকা পয়সার ঘাটতি আছে কিনা। তিনি অর্থ সাহায্য করবেন কিনা। সে কি খাচ্ছে, কোথায় থাকছে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় থাকছেন স্বামী স্ত্রী।

ক্রিশ্চিয়ানোর সাথে সুমনাদের আলাপটা অদ্ভুত। সুমনা স্কুল থেকে ফিরছিল। বাস থেকে নেমে অনেকটা হাঁটা পথ। মাথা নিচু করে হেঁটে আসছে, পাশে একটা নীল রঙের গাড়ি এসে হর্ন বাজিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে খুব নম্রভাবে জানতে চাইলেন, আমি কি আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারি? এতো দিনে সুমনা জেনে ফেলেছে এই জাতীয় অফারে অসম্মতি প্রকাশ করলে তাকে অসম্মান করা হয়। হাসি মুখে অফারটা মেনে গাড়িতে উঠে বসাই নিয়ম। বাড়িতে এসে ভদ্রতা বশতঃ সুমনা ওনাকে বসার ঘরে বসিয়ে অনেক গল্প-গুজব করে। চা অফার করে। অসময়ে উনি চা খাবেন না।সুমনা বলে তাহলে কাল বিকেলে এখানে এসে চা খাবেন। ভদ্রলোক বললেন, স্ত্রীকে জিজ্ঞেস না করে বলতে পারছি না কাল আসতে পারবো কিনা।

ওখানকার নিয়মানুযায়ী স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত কোনো নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা যাবে না। চায়ের নিমন্ত্রণ ও নয়। আর স্ত্রীকে ছাড়া কোন নিমন্ত্রণে যাওয়া যাবে না। আমি বলি, কি চমৎকার সুন্দর নিয়ম রে ওখানে। আমাদের দেশেও অবিলম্বে এই নিয়ম বলবৎ করা উচিত। মধ্যরাতে এসে দন্ত বিকশিত করে হাসতে হাসতে বলবেন, তুমি এখনো জেগে আছো? খাও নি? আমি তো অমুকের বাড়ি থেকে ডিনার করে এসেছি। খেতে চাইছিলাম না তো। জোর করে খাইয়ে দিয়েছে।

রাগান্বিত স্বরে বলি, না বলেছিলে? ‘না’ বলাতে জোর ছিল তো? নাকি দুর্বল ‘না’। তখন মাথা চুলকাতে শুরু করে।

ইস্, কতো ভালো ভালো নিয়ম এখনো এখানে চালু হতে বাকি।

পরদিন সকালে এক ভদ্রমহিলার হেঁড়ে গলা ফোনে ঝনঝন করে বেজে ওঠে - আমি আপনার বাড়ির প্রতিবেশী। আপনি আমাদের ডিনারে ডেকেছেন না কি আফটার নুন টি তে ডেকেছেন? সুমনা তো আকাশ থেকে পড়লো। ও টি খেতে ডেকেছে। টি য়ের যে আবার ভাগাভাগি আছে তা তো ওর জানা নেই। ভদ্রমহিলা সেটা বুঝতে পেরে বললেন - টি তে ডাকা মানে ডিনারে ডাকা আর আফটার নুন টি তে ডাকা মানে বিকালের চা, সাথে কিছুমিছু স্ন্যাক্স। সুমনা তাড়াতাড়ি বলে - পরেরটা, পরেরটা।

সেই থেকে আলাপ, পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা।


পর্ব - ১৫

ক্রিশ্চিয়ানো, তাকে সবাই আদর করে ডাকে ক্রিশ্চিন, খুব সাজগোজ প্রিয়। তার জামা, জুতো, ব্যাগ সব ম্যাচ করা। বিশাল বড়ো ধনী পরিবারের মেয়ে। নিউজিল্যান্ডে তার জন্ম হলেও পূর্ব-পুরুষরা স্কটল্যান্ডের অধিবাসী ছিলেন। তার চেহারা ছিল আভিজাত্য পূর্ণ। হাতের বড়ো বড়ো নখ নেলপালিশ দ্বারা রঞ্জিত। চুল সবসময় স্প্রে করে সুবিন্যস্ত। ঠোঁট লাল টকটকে ওষ্ঠ রঞ্জনী শোভিত। সুমনা তাকে তার পঞ্চাশ বছর আগে যেমন সাজে দেখেছে, এখন তার সত্তর বছর বয়স, শরীর ন্যুব্জ হয়েছে, অনেক টাই ভেঙ্গে পড়েছেন কিন্তু সাজগোজ একই রকম আছে।

ক্রিশ্চিনা অসম্ভব পুস্তক প্রেমী। গ্রন্থকীটও বলা যায়। সারা বাড়িতে শুধু বই আর বই। খাটময় ছড়ানো বই, সোফায় বই, কিচেনে বই। বিশাল বড়ো বাড়ি। বিশাল লাইব্রেরী। সব সময় বই হাতে কিছু না কিছু পড়েই যাচ্ছে। কোনো ক্লান্তি নেই।

ক্রিশ্চিনার আর একটি পছন্দের জিনিস হলো ফটো। সব সময় ফটো তুলছে। সেগুলো বাঁধিয়ে রাখছে আর দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখছে। সারা বাড়িময় সব ঘরের দেয়াল জুড়ে কেবল ছবি আর ছবি। প্রপিতামহ থেকে শুরু করে নিজের ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠা, সব ছবি ঝুলিয়ে রেখেছে দেওয়াল থেকে দেওয়ালে।

সুমনাদের নিমন্ত্রণ ক্রিশ্চিনার বাড়িতে। সুমনা গিয়ে দেখে রন্ধন পটিয়সী রান্না ঘরে রান্না করছেন। যথারীতি জাঁকজমকপূর্ণ রঙিন পোশাক পরনে। লাল লিপস্টিক, আই লাইনার, মাসকারা। সুমনা বলে, আমি অতো কিছুর নামও জানি না। চোখে চশমা। বাঁ হাতে রান্নার বই ডান হাতে খুন্তি - একদম ভজহরি মান্নার স্টাইলে ঘটাং ঘটাং শব্দের হিল্লোল তুলে রান্না চলছে। ঠোঁট টিপে হাসি চেপে সুমনা বলে কি রান্না করছো?

- রাইসের পুডিং।

বলেই হাতের বইতে একটা টিক দেয়।

সুমনা উঁকি দিয়ে বইটা দেখে।

১) দুধটা ভালো করে ফুটান। তার পাশে এস্টারিক মার্ক (*) মানে দুধ ফুটানো হয়ে গেছে।
২) আগেই ধুয়ে রাখা চাল দুধে ঢেলে দিন। *
৩) চাল ফুটে গেলে চিনি মেশান।

ক্রিশ্চিনা চিনি ঢেলে দিয়ে * দেয়।

৪) এবার ভালো করে হাতা দিয়ে নাড়াচাড়া করুন।

ক্রিশ্চিনার করুণ দশা দেখে সুমনা বলে - পায়েস রান্না করছো তো? আমাকে দাও। আমি করছি।

- নো নো, আমি আজ নিজের হাতে তোমাদের রেঁধে খাওয়াতে চাই।

৫) গ্যাস কমান। *
৬) এবার নামিয়ে নিন। *
৭) গ্যাস নেভান। *

বাঁচলাম ভঙ্গিতে ক্রিশ্চিনা বলে কুকিং শেষ। চলো বাগানে যাই।

কৌতূহল দমন করতে পারি না। জিজ্ঞেস করি, পায়েস টা খেতে কেমন হয়েছিল রে? গলাধঃকরণ করতে পারলি? হো হো করে সুমনা হাসে। বলে, আমাদের দেশের মতো পায়েস ওরা কখনোই রাঁধতে পারে না। দুধের তুলনায় চাল বেশি করে দেয়। দেখতে হয় অখন্ড মন্ডলাকার। তাই মহানন্দে পুডিংয়ের মতো কেটে কেটে খায়। মিষ্টি জাতীয় খাবার দাবার ওদের খুব পছন্দ বলে রাইস বলতে ওরা রাইস পুডিং বোঝে। এখন অবশ্য ধীরে ধীরে অনেকের মধ্যে ভাত খাবার প্রচলন হয়েছে। প্রচুর বাংলাদেশী মানুষ এখানে এসে বাঙালি হোটেল খুলেছেন। এই দেশের মানুষ বিদেশি খাবার দাবার খেতে খুব ভালোবাসেন। বাঙালি রেস্টুরেন্টে গিয়ে মশলাদার চিকেন, মটন খেতে খুব পছন্দ করেন। আমি জিজ্ঞেস করি, তুই কখনো বাঙালি রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে দেখেছিস?

- গেছি কয়েক বার। আমার খুব ভালো লাগে নি। মাংসের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ক্রীম দেয়। ক্রীম দেওয়া খাবার খেতে এরা খুবই ভালোবাসে। চেটে চেটে ক্রীম খায়। আর এরা ব্রাউন রাইস খায়। আমাদের মতো সাদা ধবধবে লম্বা লম্বা চালের ভাত খায় না।

আমরা যখন প্রথম এই দেশে আসি তখন যে চালটা খেতাম তাকে বলে জেসমিন রাইস। থাইল্যান্ড থেকে আসে। আমার বাড়িতে ঢুকেই অনেকে বলতো, কি রান্না করছো? এতো সুগন্ধ! বলতাম ভাত রান্না করছি। খাবে?

সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যেতো। আমি তাতে অনেক টা ঘী ঢেলে কাজু কিসমিস ছড়িয়ে দিতাম। চিনি বেশি করে দিতাম। তার সাথে হয়তো বিভিন্ন রকমের সবজি দিয়ে ভাজা মূগের ডাল। কি পরিতৃপ্তি নিয়ে খেতো না দেখলে বিশ্বাস করবে না। ক্রিশ্চিনার ছেলে-মেয়েরা এটা খেতে খুব ভালোবাসতো বলে ক্রিশ্চিনা আমার কাছে এই দুটি আইটেম শিখে নিয়েছিল। পরেও আমার চাইতে অনেক বেশি এক্সপার্ট হয়ে যায়।

জেসমিন রাইস একটুখানি আঁঠালো। কুড়ি কেজির বস্তা। ইন্ডিয়া থেকে এখন আসে বাসমতী রাইস। আমরা এখন এটাই খাই। সব কিছুই পাওয়া যায় গো। শুধু পাওয়া যায় না পটল। আজ তেইশ বছর ধরে পটল খাইনা।

খুব মনে পড়ে পটল ভাজা, পটল পোস্ত, পটলের দোলমার কথা। আর এদেশের সীম গুলো খুব ছোট আকারের। সজনে ডাঁটা পাওয়া যায়। অসম্ভব দাম। সজনে ফুল আসে প্যাকেটে করে। এঁচোড়ও আসে। তবে আমাদের দেশের মতো ডাঁটো সাঁটো নয়।ক্যানে করে আসে বলে নরম আর পাকা পাকা হয়ে যায়।

সুমনারা নিউজিল্যান্ড যাবার পরপরই ক্রিশ্চিনার পঞ্চাশ বছরের জন্মদিন। আবার ওর বাবার সত্তর বছরের জন্মদিন। দুটো জন্মদিন খুব আড়ম্বর করে একসাথে পালন করা হলো। আমাদের দেশে ছোট ছোট ছেলে -মেয়ে দের যেমন খাবার পাতে নুন লেবু জল পরিবেশন করতে দেয় তেমনি ক্রিশ্চিনা নিজের ছেলের সঙ্গে আশেপাশের সব বাচ্চাদের মাথায় শেফদের মতো টুপি পরিয়ে দিয়ে বলে, তোমরা সবাইকে স্টার্টার পরিবেশন করে খাওয়াবে। মনোজ তো নতুন ভূমিকায় মহা খুশি। সে এখানে নূতন এসেছে। কারোকে চেনে না। বার বার নিজের বাবা-মাকেই অনুরোধ করছে, স্টার্টার খাও। স্টার্টার খাও। ছেলেকে খুশি করার জন্য ওরা সেদিন এতো স্টার্টার খেয়েছে যে মূল খাবারে আর পৌঁছতে পারেনি।

খাওয়া দাওয়ার পর নাচা গানা। ক্রিশ্চিনা খুব ভালো বলড্যান্স করে। বলড্যান্স এখানকার পার্টির অঙ্গ।

ক্রিশ্চিনা সব সময়ই সুমনা কে উৎসাহিত করতো সব সময় নাচ গান নিয়ে থাকবে। এতে কখনো মন খারাপ হয় না। নাচতে পারো না তাতে কি? শিখে নাও। যেমন খুশি হাত পা ছোড়াছুড়ি করে সারা মাঠজুড়ে ঘুরে বেড়াও। তুমি একদম সাজো না কেন? আমি তোমাকে সাজের জিনিস দেবো। সাজলে মন ভালো থাকে।

ক্রিশ্চিনার পতিদেবতা গ্যারী ছিলেন খুব স্নেহপ্রবণ। তিনিসুমনা দের লোকাল গার্জিয়ান ছিলেন। সুমনারা আর্থিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রায়শঃ এক বাড়ি বিক্রি করে আরও বড়ো নতুন বাড়ি কিনতো। পিতার মতো গ্যারী নিজে গিয়ে সে বাড়ি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। কাঠে ঘুণ ধরেছে কিনা। কাগজ পত্র ঠিক আছে কিনা। এটা সুমনাদের কাছে বিশাল বড় প্রাপ্তি। ওরা নবাগত। ওদেশের বাড়ি ঘর সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। এমন একজন অভিভাবক থাকলে সব দিক থেকেই নিশ্চিন্ত।


পর্ব - ১৬

ক্রিশ্চিনা বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবিতা আবৃত্তি করতে খুব ভালোবাসতেন। পুরুষালী চেহারা বলে গলায় মাধুর্য কম। পুষিয়ে দিতেন আবেগ দিয়ে। সুমনা ইংরেজী সাহিত্যের দিদিমণি বলে উনি খুব খুশি। প্রায়ই ডেকে নিতেন লাঞ্চে। সুমনা গেলেই একসাথে কফি খেতেন। তারপর বই-পত্র নিয়ে বলতেন, চলো, বাগানে যাই।

বাড়ির পেছনে বিশাল বড়ো ফলের বাগান। আপেল গাছতলায় চেয়ার টেবিল পাতা। দু'জনের সাহিত্য সাধনা চলতো। টেগোরের কবিতা পাঠ করে তার তর্জমা করে দিত সুমনা। ভারী খুশি হতেন ক্রিশ্চিনা। নিজে উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করতেন ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা।

কতো রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন, কতো মেঘমেদুর বিষন্ন বেলা,কতো শনশনে হাওয়ায় তরুমর্মর ধ্বনি শুনতে শুনতে কবিতা পাঠের আসর মধ্যাহ্ন পেরিয়ে অপরাহ্ন বেলায় গড়িয়ে যেতো। ‘সরি সরি’ বলে ক্রিশ্চিনা সুমনা কে নিয়ে ঘরে এসে খাবার গরম করে একসাথে বসে খেতেন। তারপর চলত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা।

ক্রিশ্চিনার মেয়ে অ্যানা বছর পনেরোর মেয়ে। শরীরটা দুবলা প্রকৃতির। শীর্ণ চেহারা। মুখ খানি গ্রীক দেবীর মতো। নিষ্পাপ পবিত্র সুন্দর একটি গোলাপ যেন।

সুমনা ওকে একদিন প্রেসার কুকারে বেশি চাল, কম ডাল আর আলুর ছোট ছোট টুকরো দিয়ে সেদ্ধ করা ভাত দিয়েছে। বেশি করে বাটার আর সাথে ডিমের একটি পোচ। অ্যানা খেয়ে মুগ্ধ। তার পর প্রায়ই বলতো,সুমনা আমি তোমার কুকিং করা এই রাইস টা খেতে চাই। তুমি কি আমাকে দেবে? এতো ভালো খাবার আমি আমার লাইফে খাইনি।

সুমনা হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না। মনে পড়ে দুয়োরাণীকে পান্তাভাত খেতে দেখে সুয়োরাণীর পান্তাভাত খাওয়ার ইচ্ছে হবার গল্প।যখন রাঁধতে রাঁধতে আলস্য লাগে, অথবা খুব কাজের চাপ তখন সুমনা মাঝে মাঝেই এই ভাতটা করে। মনোজ, তপনও ভালো খায়। রান্না সহজ, অল্প খেলেই পেট ভরে যায়।

এরপর থেকে এই ভাত রান্না করলেই সুমনা অ্যানাকে ডেকে নিতো আর অ্যানা তৃপ্তি করে মহামূল্যবান এই রাজভোগ সোনা মুখ করে খেতো।

দেখতে দেখতে অ্যানা বড়ো হয়ে গেল। এবার ওর বিয়ে দিতে হবে। পাত্র ঠিক করাই আছে। জোসেফ, অ্যানার স্টেডি বয়ফ্রেন্ড। ছোট্ট বেলার কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে একসাথে পথ চলা শুরু। এরা একে-অপরকে খুব ভালো করে জানে, বোঝে। দুই বাড়ির বাবা মা ও খুব খুশি। বিয়ের দিন পাকা হয়ে যায়। সুমনারাও খুব উত্তেজিত। এদেশের বিয়ে দেখতে পাবে।

শুরু হলো কেনাকাটা পর্ব। অঙ্গুরীয় বিনিময় এদেশের আসল বিয়ে। বর-কনে দু'জন গিয়ে দু'জনার সম্মতিতে ডায়মন্ড রিং কিনে নিয়ে এলো। জোসেফের স্যুট কোট, প্যান্ট, টাই,অ্যানার ফ্রিল দেওয়া বিশাল হোয়াইট ড্রেস, ভেল, সোনার মুকুট। নিমন্ত্রণের কার্ড, খাবারের মেনু তৈরি, সবাই কে নিমন্ত্রণ করা, একেবারে সোরগোল পড়ে গেল। তার ফাঁকে ফাঁকে চলছে বলড্যান্স করার প্রস্তুতি। নিয়মিত ভাবে রিহার্সাল করা। পিয়ানো প্র্যাকটিস। যে ভায়োলিন বাজাবে সেও ভায়োলিন নিয়ে অষ্টপ্রহর লেগে রইলো। এই বিয়ে মানে তো এমন নয়, পাড়া প্রতিবেশীরা যাবে আর গীফট দিয়ে খেয়ে চলে আসবে। এটা পুরো গাঁয়ের মান মর্যাদার প্রশ্ন। সবার সমান ভূমিকা রয়েছে অনুষ্ঠানটিকে সর্বতোভাবে সার্থকতা মন্ডিত করার।

বলড্যান্স এখানকার ছেলে মেয়ে সবাই শেখে।

স্কুল কলেজে যখন নবীন বরণ উৎসব হয় বা পাশ করে ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল ছেড়ে চলে যায় তখন অনুষ্ঠান হয়। ছাত্র ছাত্রীদের অনুমতি থাকে বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে অনুষ্ঠানে যোগদান করতে। তারা তখন যুগলে বলড্যান্স করে।

সুমনা তো মহা মুস্কিলে পড়েছে। ক্রিশ্চিনা তো ওকে আর তপনকে ছাড়বে না। নাচতে হবেই। সবাই নাচবে আর ওরা না নাচলে সেটা ভীষণ দৃষ্টিকটু ব্যাপার। আবার বারংবার পীড়াপীড়ি করলে না নাচাটাও খুব খারাপ দেখায়।

সুমনার অসুবিধে হবে অনুমান করে ক্রিশ্চিনা নিজের বাড়িতে দুই জন কেই ডেকে নিয়ে নাচের তালিম দেয়।

নিকটবর্তী চার্চে বিয়ের অনুষ্ঠান। বর আসে বাবার হাত ধরে। কনেও আসে তার বাবার হাত ধরে। সুমনা বোঝে, পুরো পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। মায়েরা দর্শক। ঘন ঘন হাততালি দেওয়া তাদের কাজ। অঙ্গুরীয় বিনিময়, আইনি বিবাহ শেষ হলে কেক কাটা হয়।

একটি গোল টেবিলে কেকটি রাখা। গোল টেবিল ঘিরে কয়েক খানি চেয়ার পাতা। পদমর্যাদা অনুযায়ী সেখানে বসবেন উভয় বাড়ির বাবা- মা, ভাই-বোন।

পরের সারিতে আত্মীয়-স্বজন। তার পরের সারিতে পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধব। প্রতিটি চেয়ারে নাম লেখা আছে। সেই নাম দেখে বসতে হবে।

ক্রিশ্চিনা খুব রুচি শীলা। সে প্রচুর পরিমাণে লেসের ঢাকনা তৈরি করে। টিকোজি বানিয়ে এমব্রয়ডারি করে। সমস্ত খাবার দাবার দেবে লেসের ঢাকনা দিয়ে মুড়িয়ে। আর ক্রিশ্চিনা খুব দামী দামী কাঁচের, বোন চায়নার কাপ প্লেট, বাসন কোসন ব্যাবহার করে। চায়ের কাপে,প্লেটে সোনালী বর্ডার থাকতে হবে। মেয়ের বিয়েতে যতো রকম ভাবে পারা যায় অতিথি আপ্যায়ন করে।

খাদ্য পানীয় সুস্বাদু সুগন্ধি এবং লোভনীয়। যেখানকার যেটি নাম করা, সেখান থেকে সেটাই সংগ্রহ করা হয়েছে।

তার পর দীর্ঘ সময় ধরে চললো বহু প্রতীক্ষিত বলড্যান্স। অসম্ভব শারীরিক ব্যালান্স না থাকলে এই নাচ নাচা যায় না। দেখা গেল স্থুলকায় স্ফীতোদর তারা ও দিব্যি নাচতে পারছেন। তার মানে প্রত্যেকে ভালো রকম প্র্যাকটিশ করেই এসেছেন।

এদেশে প্রায়ই রাশিয়ান ব্যালে, ইন্ডিয়ান কথাকলি, কত্থক, ওড়িশী ড্যান্স হয়। টিকিটের দাম ও খুব বেশি রকম। কিন্তু এরা দামের পরোয়া করে না। সপরিবারে গিয়ে এক সাথে উপভোগ করে নৃত্য শৈলী।

আমি বলি, সুমনা, তুই আসল কথাটাই এড়িয়ে যাচ্ছিস। তুই আর তপন কেমন বলডান্স করলি সেটা তো বললি না? আমার আসল ইন্টারেস্ট তো তোদের দুই জনকে নিয়ে। ওদেশের কাউকে চিনি ও না, জানি ও না। কে কেমন নৃত্য পরিবেশন করলেন সেই ব্যাপারে কোন ইন্টারেস্টও নেই। বল্ না রে, কেমন নাচলি?

লজ্জা পেয়ে সুমনা বললো, ধ্যাৎ।

আমি ফোন হাতে তাকিয়ে আছি। এটা কোনো উত্তর হলো? মনে মনে ঠিক করলাম একদিন ভিডিও কলে ওর নাচটা দেখতেই হবে।

আপনারা ও আশায় থাকুন। বিস্তারিত বিবরণ তো জানাবোই।

(এরপর আগামী সংখ্যায়)