গল্প ও অণুগল্প

উড়ান



মমতা বিশ্বাস


একসময় অণির মনে হতো যারা চাকরি করে পৃথিবীতে তারাই একমাত্র সুখী মানুষ। ধারনাটা পাল্টে গেল চাকরিটা পাবার পর। শুধু ডিউটি আর ডিউটি। ভাল লাগে না একেবারে। পৃথিবীজুড়ে ভালো না থাকার ঝোড়ো বাতাস বইছে যেন। কেউ ভালো নেই, কিচ্ছু ভালো নেই। না-তুমি, না-আমি। মহানগর ভালো নেই। নগর-শহর-মফঃস্বল-গ্রাম-গঞ্জ-নদী-নালা-খাল-বিল-মাঠ-ঘাট কিচ্ছু ভালো নেই। মহানগর মিটিং-মিছিলের বিক্ষোভ-সমাবেশের উপ্তত্ত আবহাওয়ার ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত। বর্ষার বিদায়বেলায় গ্রীষ্মের কড়া শাসনে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে জগৎ সংসারের সবকিছু। ধর্ম ও রাজনীতির অনৈতিক কার্যকলাপের উন্মাদনা চারদিকে; কখন কী ঘটে, চাপা টেনশন। তারই মধ্যে শিয়া-সুন্নির দুঃখ-সুখের উৎসব মহরম। আল্লাতালা জুড়তে পারেনি আজও তাদের। কেউ উল্লাসে মত্ত, কেউ দুঃখে কাতর। সেই কোন অতীতে ঘটে যাওয়া বিদ্বেষের বিষ বহন করে চলেছে বংশ পরম্পরায় যুগ যুগ ধরে। এইসব ভাবতে ভাবতে অণি সকাল আটটা থেকে হাঁটছে।

এক জওয়ান দু'দিন আগে কর্তব্যরত অবস্থায় নিজের রাইফেলের গুলিতে আত্মহত্যা করেছে। রাখি উৎসবে বাড়ি যাওয়ার ছুটি না-মঞ্জুর হওয়ায় মানসিক অবসাদে ভুগছিল সে। ডিউটির চাপে পিষ্ট শরীর, মন। দীর্ঘদিন এই অবস্থায় চলার জন্যই জওয়ানটি বেঁচে থাকার অর্থ হারিয়ে ফেলেছিল বোধহয়। জিডি অণিই লিখেছিল। গতকালের ঘটনাটা হাজার চেষ্টা করেও মাথা থেকে সরাতে পারছে না। ঘুণপোকার মতো মাথার মধ্যে কুরে কুরে খাচ্ছে। সেই সঙ্গে লেখাকে কাছে পাওয়ার ব্যাকুলতা বেড়ে যাচ্ছে। অনিশ্চিত পাওয়ার ব্যাকুলতায় অধীর হয়ে পড়েছে। একান্ত আপনজনের সান্নিধ্য না পাওয়ার কারণেই মানসিক অবসাদের শিকার হয় মানুষ। মাঝে মাঝে তারও ও-রকম হয়, হয় তো। কিচ্ছু ভালো লাগে না। তালগোল পাকিয়ে যায়। মুড অফ। লেখার ফোন এলে ধীরে ধীরে সময় কেটে যায় কিছুটা। সবটা নয়। ঘণ্টা অতিক্রম করলেও ফোন রাখতে ইচ্ছে করে না। আজ আদপেও কথা বলা যাবে না বোধহয়। মন বড্ডো বেসামাল হয়ে পড়েছে। মহরমের শোভাযাত্রা থেকে মন উড়ে চলে যাচ্ছে বারেবারে পাঁচশো কিলোমিটার দূরে মফঃস্বলের প্রান্তে, যেখানে লেখা তার জন্য অপেক্ষা করছে। কত কথা তার বলার আছে। ফোনে প্রতিদিন কথা হচ্ছে কিন্তু সেই বিশেষ কথাগুলো সামনা-সামনি বলতে চায় সে। বলতে বললেও, বলতে চায় না। একই কথা, "একান্ত মনের কথা ফোনে বলা যায় না"। মনের কথা ছাড়া সব কথা অনর্গল বলে যায়। থামতে চায় না। পাট নিয়ে চাষীদের দুর্গতির শেষ নেই। তাতে তার খুব মনখারাপ। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে দাঁড়িয়ে আছে শুধু পাটগাছ। খালবিলে জল নেই। মাটি ফেটে চৌচির। জমিতেই দু'ফুট আড়াই ফুট গর্ত কেটে পলিথিন বিছিয়ে স্যালোর জলে পাট জাগ দিচ্ছে লোকে। বিক্রি করে পাট কাটা, ধোয়ার দাম পাবে না। চার কিলোমিটার পাটক্ষেতের আলপথ ধরে ঘুরে ঘুরে দেখে এসেছে। ছবি তুলে এনেছে। বড্ডো একগুঁয়ে। সাপ, শিয়ালের ভয় তো থাকা উচিত? পথ হারিয়ে যাওয়ার পর একটু নাকি ভয় পেয়েছিল!

।। ২ ।।

দীর্ঘদিন পর লেখার পাটক্ষেতের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার গল্প শুনে তার শৈশবের কথা মনে পড়ে গেল। পাটক্ষেতে হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে অণি অন্য ধরনের রোমাঞ্চ অনুভব করত। কিশোরবেলায় দীপুর সঙ্গে পাটের মাঠে এসে আলপথ ধরে হেঁটে বেড়াত। তার মনে হত নিজেকে লুকিয়ে ফেলার মতো এমন জায়গা আর কোথাও নেই পৃথিবীতে। আকাশটাকে দেখা যায় না, মাথা উঁচু করে তাকালেও। পাটক্ষেত হয়ে উঠত আমাজনের জঙ্গল। কিশোর অণির অ্যাডভেঞ্চারের একজন অদৃশ্য সঙ্গী থাকত। সরু আলপথে পাশাপাশি হাঁটা যায় না। পিছনের হাত দিয়ে সেই অদৃশ্য হাত ধরে থাকত। সে হাতটা কার ঠিক মনে করতে পারছে না। লেখার? না, না। ওই গম্ভীর বালিকার হাত? না সেই ফর্সা ধবধবে মেয়েটির হাত?

দীপুর বস্তা ঘাসে ভরে গেলে দু'হাত মুখে লাগিয়ে ডাকত, "অণি তুই কোথায়? চলে আয়। আমার বস্তা ভরে গেছে। বাড়ি চল। সন্ধ্যে লেগে আসছে। শিয়াল বেরোবে। দল বেঁধে এলে আমাদের দেখে ভয় পাবে না। কোথায় তুই? তাড়াতাড়ি চলে আয়"।

শিয়ালের কথা শুনলে বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠত অণির। "একটুখানি দাঁড়া, আমি আসছি। তুই এইভাবে শিয়ালের ভয় দেখাবি না"। একদিন সন্ধ্যে লেগে যাওয়ায় সাত শিয়ালের জুলজুলে রক্তচক্ষুর চাহনির কথা মনে হলে অণির বুকটা ধড়াস করে ওঠে। দ্রুত পা চালায় বাড়ির দিকে। বুক ধড়ফড়ানি বাড়িতে এসেও থেকে যায়। মা'কে বলে না কিছুই। হাত-পা ধুয়ে পড়তে বসে যায়।

দীপু এখন বড়ো চাষা। টিনের ডোঙা বানিয়েছে। পাট-পাটকাটি টানে, মাছ ধরে। তারা দুজনে ছোটোবেলায় তালের ডোঙায় চড়ে মাছ ধরতে গিয়ে উল্টে পড়েছিল জলে। ভাগ্যিস কোমর সমান জল তাই দুই এক ঢোক জল খাওয়া ছাড়া, বড়ো বিপদ কিছু ঘটেনি। লেখার ডোঙায় চড়ার খুব শখ। দীপুর ডোঙায় এইবারের বর্ষায় তারা একদিন বিলের বুকে ভেসে পড়বে বলে ভেবেছিল। ডোঙাটা বেশ বড়োসড়ো। লেখার সঙ্গে পাশাপাশি শুয়ে হাতে হাত রেখে আকাশে শরৎমেঘের খেলা দেখবে। দীপুর কাছে তার কোনো সংকোচ নেই। লেখা তো তারই। অনাবৃষ্টিতে বিলে একফোঁটা জল নেই। মাটি ফেটে চৌচির। পাটগাছ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুড়ছে ! অণিও তো পুড়ছে লেখার জন্য।

সে লেখাকে কথা দিয়েছিল সন্ধ্যে সাতটাতে ফোন করতে পারবে। নাহ! আজও হল না। পা উঠছে না। ক্লান্ত লাগছে। লেখা তাকে অনেক কিছু বলতে চেয়েছে। কী কী বলতে পারে সেই ভাবনায় চলমান জনতার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে অণি বারবার। শরীরটাকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মন উড়ে গেছে লেখার কাছে। লেখাকে নিয়ে ময়ূরপঙ্খীতে চড়ে আসন্ন রাখি পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় ভেসে বেড়াচ্ছে। পরণে সাদা পায়জামা। গায়ে হাল্কা আকাশী রঙের পাঞ্জাবি। হাতে একটি রক্তগোলাপ। লেখা রক্তগোলাপ দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। অধরে এঁকে দিয়েছে মৃদু চুম্বন। সে পরেছে অফ হোয়াইট রঙের জামদানি। গায়ে ম্যাচিং ব্লাউজ। অণির হাল্কা রঙই পছন্দ। লেখার পিঠ জুড়ে খোলা চুলের ঢেউ। লজ্জা মেশানো খুশির আলো সারা মুখে। মৃদু স্বর্ণচাপার মিষ্টি গন্ধ লেখার শরীর থেকে অণির নাকে এসে লাগছে। এ গন্ধে মাতাল হয়ে উঠেছে অণি। শরীর-মন রোমাঞ্চিত। শিহরণ খেলে যাচ্ছে সারা শরীরে। সম্পূর্ণরূপে লেখাকে পাওয়ার এ যেন পরমক্ষণ। হাত ধরে তারা এক একটা করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছে। কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না। মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে সাদা ধবধবে বিছানার চাদরের ওপর।

হঠাৎ বিদায়ী বর্ষার ঘন কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে। মুষলধারায় বর্ষণের সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নিভে যাবার আগে প্রদীপের আলো দপ করে জ্বলে ওঠার মতোই শেষ শ্রাবণধারায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যেমন ভেসে যাচ্ছে অণি আর লেখা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর!

জনতার চিৎকারে সম্বিৎ ফিরে পেল অণি। ঝেপে বৃষ্টি নেমেছে। অঝোরধারার বৃষ্টি মাথায় করে জনতা এগিয়ে চলেছে। অণির মাথায় ছাতা থাকলেও ভিজে যাচ্ছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। হৃদ-মাঝারে শ্রাবণধারার আবেশ, বিবশ করে দিয়েছে বাহ্যিক চেতনা!