গল্প ও অণুগল্প

একাকীত্বের নিঃসঙ্গতা



কুমার চ্যাটার্জী


আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার... পরান সখা বন্ধু হে আমার... আকাশ কাঁদে হতাশ সম... নয়নে ঘুম নাই যে মম... দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম... চাই যে বারে বার...

ঝড়ের সঙ্গে একাকিত্বের একটা অদ্ভুত সহাবস্থান আছে। হয়তো দুজনেই একা। Solitude of loneliness। একাকীত্বের নিঃসঙ্গতা। তবুও ফিরে ফিরে তাকানো থামেনা। কোথাও কেউ নেই জেনেও শেষ হয়েও শেষ হয় না খোঁজার তাগিদ, বাঁচার প্রলোভন, ভালবাসার দাবি। একটা অদ্ভুত মাদকতা আছে হতাশার মধ্যে। হতাশ হবো জেনেও দরজা খুলে রেখে বেঁচে থাকে প্রতীক্ষা।

ঝড় তো শুধু বাইরে নয়, অন্তরে চুরমার করে দেয় বিপর্যয়। ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে। সেই বৃষ্টির জল বোধহয় নোনতা। চোখের জল মিশে থাকে সেই বৃষ্টির প্রতিটি বিন্দুতে। হতাশায় সম্পৃক্ত সেই বৃষ্টি। তবুও সেই বৃষ্টির মধ্যে লুকিয়ে থাকে পরম ভালোবাসার ধন। নিজেকে খুঁজে পাই সেই ঝড়ের তান্ডবে আর অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে। পরানসখা বন্ধু হে আমার।

হতাশ আকাশের মতোই এক সীমাহীন শূন্যতা ঢেকে দেয় শেষ দীর্ঘশ্বাসের অব্যক্ত যন্ত্রণা। কোন প্রতিধ্বনি নেই কোথাও। শুধু বেঁচে থাকে নৈঃশব্দের নীরবতা। নীরবতা বড় চেনা আমার। প্রতিদিন একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়েছে নীরবতা আমার সমস্ত মনন, চিন্তনের মধ্যে। ঠিক যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে ক্যান্সার প্রতিটি রক্তকোষ, অস্থি, মজ্জায়।

এক নিশ্ছিদ্র নৈঃশব্দের মধ্যে আমি খুঁজে পাই শেষের সংকেত। আমি শেষ দেখি আমার অন্তরে বাঁধভাঙ্গা বৃষ্টির প্রতিটি বিন্দুতে। আমি শেষ দেখি আমার প্রতিটি নিশ্বাসের আঘ্রাণে। আমি শেষ দেখি আমার দিকে চেয়ে থাকা প্রতিটি চোখের ভাষায়। পৃথিবীর প্রতিটি মৃত্যু আমায় ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে দেয়। গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গতা। আমি শুনতে পাই বিদায়ের শেষ ঘন্টাধ্বনি।

Any man’s death diminishes me... Because I’m involved in mankind... Therefore, never send to know for whom the bell tolls... It tolls for thee...

প্রতি রাতে নিঃসঙ্গতার অভিসার আমার। আর হতাশ প্রতীক্ষা। প্রতি রাতে নতুন করে খুঁজে পাওয়া নিজেকে। ক্লান্ত শরীর। শ্রান্ত মন। আমার ভিতরমহলের যন্ত্রণা এখন আর চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসে না গেরুয়া বসন পড়ে। ধূসর জীবনের গোধূলিতে ক্লান্ত স্মৃতির মিছিল চলে সারারাত।

বড় অদ্ভুত সেই স্মৃতির সঙ্গে পথ চলা। রাত চলা। ঠিক এরকমই এক ভাঙ্গা রাতের পরিপূর্ণ অন্ধকারে তুমি এসেছিলে। বন্ধনহারা শব্দের জোয়ার ছুটেছিল সেদিন। ঝড়ের মত ভেঙে পড়েছিল রাতের নৈঃশব্দের সব ষড়যন্ত্র। একটা রাতে ভেসে গিয়েছিল একটা গোটা জীবনের একাকিত্ব।

“আমার আরও একটা পরিচয় আছে। আমাদের সমাজে আমি সেই মানুষগুলোর দলে যাদের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক,” তুমি বলেছিলে। আলাপ হওয়ার মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই বলেছিলে তোমার ক্যান্সারের কথা। তুমি এসেছিলে পুজোর কিছু আগে। বাঁচবে না জেনেও বেঁচে থাকার তোমার সেই প্রাণশক্তি আমার ভালোবাসাকে ডানা মেলতে দিয়েছিল একটা গোটা আকাশ।

A man can be destroyed but not defeated, তুমি বলতে। হতাশা ছিল অনিবার্য। তবুও বিশ্বাস করতাম তুমি বাঁচবে। তোমার সঙ্গে স্বপ্ন দেখা। তোমার সাথে একলা হওয়া। তোমার সঙ্গে সারারাত শব্দের বৃষ্টি। তুমি ছিলে বোদলেয়ার-এর সেই প্রেমিক যে গদ্যের মধ্যেও রচনা করে কবিতা।

তার ঘর পুড়ে গেছে অকাল অনলে... তার মন ভেসে গেছে প্রলয়ের জলে... তবু এখনও সে মুখ দেখে চমকায়... এখনও সে মাটি পেলে প্রতিমা বানায়।

সেদিন সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল। কত গাছ, বাড়ি ভেঙে পড়েছিল সেই ঝড়ের রাতে। “একটা বৃষ্টির দুপুরে কলকাতাকে খুঁজতে যাবে আমার সঙ্গে?” কতবার বলেছ তুমি।

শ্রাবণ কন্যা আমি। সবুজ ছাড়া বৃষ্টির রূপ কোথায় পাবে? প্রতিবার বলেছি তোমায়। বৃষ্টি বড় আহাম্মক এই ধূসর শহরে। সরু ক্যাপিলারি টিউব-এর মধ্যে দিয়ে তোমার ধমনীতে পৌঁছে যায় বিষ। আগুন ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি রক্তকোষে। জীবন যখন ছোট হয়ে গেল, তখন বছরকে মিনিটে ভেঙে গুনিতক-এ বাঁচতে তুমি। এক মুহূর্তের নীরবতা সহ্য হতো না তোমার। “Silence-কে admire করার বিলাসিতা আমাদের মানায় না। আমাদের সময় বড় কম। শব্দ অনেক বেশি।”

সেদিনও বৃষ্টি শেষে সকাল হলো। সূর্যের আলোয় ঝলমল করে উঠল এই ধূসর শহর। কেউ জানলো না আমার আকাশে তখন রামধনুর সব রং মিশে গিয়ে এক নিকষ কালো অন্ধকার।

রাতগুলো বড় চেনা। অনেকটা দুয়োরানীর মত। ফিরে এলো আবার। ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা স্বপ্নের লাশ-এর সঙ্গে একাকিত্ব আর নৈঃশব্দের দুরভিসন্ধি।

মেয়ে আমি। মা আমি। তোমার জন্য এক পৃথিবী ভালোবাসা ছিল। কিন্তু ছিল না বৃষ্টিভেজা একটা দুপুর। আজ রাতগুলো আবার একা আমার। প্রতিটা রাত শুধু প্রতীক্ষার। হয়তো আবার তুমি বলে উঠবেঃ Let me forget about today until tomorrow।

তবুও সকাল আসে। সূর্যের আলোয় ধুয়ে-মুছে যায় একাকীত্বের কালো অন্ধকার। এখনও বেঁচে থাকা স্বপ্নগুলো গা-ঝাড়া দিয়ে জেগে ওঠে রাতের ব্যর্থতার ‌সব ক্লান্তি সরিয়ে রেখে। শুরু হয় আরও একটা দিন। আরও একবার বেঁচে থাকার লড়াই। আরও একবার তোমার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে উষ্ণতা শুষে নেওয়ার অদম্য উৎসাহ।

জানি তুমি আসবেনা। তবুও...