অনেক চিন্তাভাবনা করে ঘর ছেড়েছেন দশরথবাবু। স্ত্রী গত হবার পর তাঁর ছেলে-মেয়েরা তাঁকে সংসারের বাড়তি বোঝা ভেবে প্রতিদিন গালমন্দ করতো। শহরের শেষপ্রান্তে একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে নিজের মতো করে থাকেন। বাড়িওয়ালা তেমন বিষয়ী না হলেও তাঁর স্ত্রী ছায়াদেবী যথেষ্ট চতুর এবং বাস্তববাদী। 'সাপ মরবে অথচ লাঠি ভাঙবে না' - এই নীতিকে আশ্রয় করে প্রায় বিনা খরচে তিনি তাঁর তিন তিনটে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। স্বামী নন্দবাবুকে কষে বেঁধে রেখেছেন। নন্দবাবু সদর হাসপাতালের ডি-গ্রুপের একজন সাধারণ কর্মী। তাঁর স্যালারি খুব বেশি নয় কিন্তু ছায়াদেবীর পরিকল্পনা এবং হাতসাফাইয়ের গুণে প্রতি মাসের শেষে মোটা অঙ্কের টাকা তাঁর স্ত্রীর হাতে চলে আসে। সবটাই যে তিনি তাঁর স্ত্রীর হাতে তুলে দেন তা নয় কিছুটা নিজের ব্যক্তিগত কাজে লাগাবার জন্যে আলাদা করে রাখেন। সেটা ছায়াদেবীকে জানতে দেন না। ছায়াদেবী জানতে পারলে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে - এই আশঙ্কায় ব্যক্তিগত তহবিলটাকে সামলে রাখেন। ছায়াদেবী অনেক চেষ্টা করেও তা উদ্ধার করতে পারেননি। প্রতিদিনই নন্দবাবু অফিসে চলে যাবার পর সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকেন কিন্তু কোন গোপন কুঠুরিতে তা বন্দী সে, তার হদিস তিনি পান না। তিন মেয়ের বিয়ের পর বাড়িটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে। চার চারটি বেডরুমের দুটিকে নিজেদের ব্যবহারের জন্য রেখে বাকি দুটিতে দু'জন ভাড়াটিয়া বসিয়ে দিয়েছেন। চার কাঠা জমির ঠিক মাঝখানে দক্ষিণমুখী মূল বাড়ি এবং টানা বারান্দার বাঁদিকে অস্থায়ী রান্নাঘর, পিছনে অ্যাটাচড্ বাথরুম। সামনের ডানদিকে বড়সড় রান্নাঘর। অতিথি অভ্যাগত এলে বড়ো রান্নাঘরটি ব্যবহৃত হতো। শুধু শুধু ফাঁকা পড়ে থাকবে? এটা ভেবে ওই ঘরটিতে একজন কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে ভাড়া দিয়েছেন। কৃষ্ণনগর সরকারি মহাবিদ্যালয়ে সংস্কৃতে সাম্মানিক নিয়ে ছেলেটি এবার ফাইনাল ইয়ার দেবে। যেমন মিষ্টি দেখতে তেমনি মেধাবী। ওই ঘরে সে একাই থাকে, টিউশনি করে নিজের পড়াশোনা এবং খাওয়া-দাওয়ার খরচ চালায়। নিজের হাতে রান্না করে খায়। শোনা যায় কোন ছোটোবেলায় ওর বাবা মারা গেছেন। মা, দাদা-দিদি সবাই আছেন কিন্তু কেউ ওর সাথে যোগাযোগ রাখেন না। ছায়াদেবীর অত খবরে দরকার নেই মাস গেলে ঠিকমতো ভাড়ার টাকাটি পান - এটাই যথেষ্ট। তাছাড়া ছেলেটিকে সময়ে অসময়ে কাজে লাগে।
দশরথবাবু ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডে মোটা মাইনের চাকরি করতেন। তাই পেনশনের টাকায় ওঁর ভালোভাবেই চলে যায়। পয়ষট্টি বছর বয়স হলেও শরীরের বাঁধুনিটা বেশ আঁটোসাঁটো। একটা ইন্ডাকশন কুকার কিনে নিয়েছেন এবং ইলেক্ট্রিক বিল যাতে না ওঠে তার ব্যবস্থাও তিনি করে নিয়েছেন। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব মিটলে একটু বিশ্রাম নিয়ে তিনি চলে যান কলেজের মাঠে। বিকেল হলেই এখানে নানান মানুষের সমাগমে যেন ছোটখাটো মেলা বসে যায়। মানুষের এই মিলনমেলা দেখতে ওঁর বেশ লাগে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে কোন মান্ধাতার আমলে তৈরী প্লাস্টার চটা প্যাভিলিয়নে গিয়ে বসেন। মাঠভর্তি মানুষগুলোর বৈচিত্র্যময় গতি এবং অঙ্গভঙ্গী দেখে ভীষণ মজা পান তিনি। ঘন্টা দুয়েকের মতো বসেন তিনি, তার মধ্যে চা-ওয়ালা, ডালপুরি বিক্রেতা এবং ঝালমুড়ির চলমান দোকানী বার তিনেক তাঁর সামনে দিয়ে ঘুরে যায়। একটু চা কিংবা ডালপুরি খেতে তাঁর ইচ্ছে করে কিন্তু ভয় পান। বয়স হয়েছে তো, যদি পেটের সমস্যা হয় তবে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হবে। তাঁকে সেবা-যত্ন করার জন্য তো কেউ নেই। তাই ওদেরকে ডেকে কেবল দাম জিজ্ঞাসা করেই থমকে যান। ওরাও বুঝে গেছে যে, ভদ্রলোকের খেতে ইচ্ছে করে কিন্তু ভয়ে খান না।
ডালপুরি বিক্রেতা ছেলেটা বেশ ভালো। মাঝে মাঝে বলে - জ্যেঠু, একদিন একটা অন্তত খেয়ে দেখুন। না, পয়সা দিতে হবে না।
- খোকা, তুই কী ভাবিস আমি পয়সার জন্য খাই না? ঠিক তা নয়, বয়স হয়েছে তো, তাই ভয় করে।
- ভয় পাবেন না জ্যেঠু, কিছু হবে না। কিছু হলে আমাকে খবর পাঠাবেন। আমি তৎক্ষনাৎ চলে আসবো। ওই তো কলেজের পিছনে আমার বাড়ি। 'ডালপুরি বাড়ি' বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে। আর আপনি তো নন্দকাকুর বাড়িতে থাকেন, তাই না? আমি ঠিক চলে যাবো।
দশরথবাবু একটু অবাক হয়ে যান। ছেলেটি এত খবর জানলো কী করে? এই তো কয়েক মাস হলো আমি এখানে ভাড়া এসেছি। তার মধ্যে ওর কাছে খবর গেল কীভাবে? নিশ্চয় কোনো রহস্য আছে। ব্যাপারটা একটু দেখতে হচ্ছে।
- আচ্ছা, আমি যে নন্দবাবুর বাড়িতে আছি সেটা তুই কীভাবে জেনেছিস বল তো।
- নন্দকাকুই তো আমাকে বলেছে। আরও একটা ছেলে ওখানে থাকে তাও বলেছে। আসলে নন্দকাকু আমার দীর্ঘদিনের খদ্দের কীনা। তবে কাকু মানুষ হিসেবে খুবই ভালো। তাছাড়া পথই আমাদের জীবন। পথ থেকে কত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে রাখতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। পথের সঞ্চয় পথেই রয়ে যায়।
ওদের কথার মাঝে নীরব এসে দাঁড়ায়। নন্দবাবুর বাড়ির ভাড়াটিয়া কলেজ পড়ুয়া ছেলেটির নাম নীরব। ও এসে দশরথবাবুর পাশে বসে। দু'এক কথায় মাঠের গল্প উঠে আসে। কত-শত উত্থান-পতনের সাক্ষী নীরবের মনে নীরব যন্ত্রণা হয়ে আছে তা একমাত্র সে-ই জানে।
এই মাঠের সাথে ওর শৈশবের সম্পর্ক। মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে হকির কোচিং দেন শহরের নামকরা স্কুলের শিক্ষক গোপালবাবু। না, এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক তিনি নেন না। তাঁর হারানো স্বপ্ন ফিরে পাওয়ার জন্য তিনি স্ব-ইচ্ছায় এখানে কোচিং করান। নীরবের বেশ মনে পড়ে সেই দিনটার কথা - গোপালবাবুর একমাত্র ছেলে সায়ন ওর সাথে কলেজিয়েট স্কুলে পড়তো। সায়নের সাথে নীরবের ছিলো গলায় গলায় ভাব। ওরা একসাথে অনুশীলন করতো, একজন অনুপস্থিত থাকলে অন্যজন মনমরা হয়ে বসে থাকতো কিছুতেই মাঠে নামতো না। গোপালবাবু একজন প্রতিভাবান হকি খেলোয়াড় ছিলেন। অত্যন্ত মজবুত তেজী ঘোড়ার মতো তাঁর গতি, সেই সাথে ক্ষিপ্রতা। বিপক্ষের খেলোয়াড়েরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুহূর্তের মধ্যে তিনি টপাটপ গোল করে বেরিয়ে যেতেন। বিপক্ষীয়রা অনেক হিসেব কষে ছক সাজিয়ে গোপালবাবুকে আটকানোর চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত বিষন্ন মন নিয়ে বাড়ি ফিরে যেত। সেবার অল ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে পশ্চিমবঙ্গকে দশবারের ভারত সেরা পাঞ্জাবের মুখোমুখি হতে হয়। গোপালবাবুকে ঘিরে একটা স্বপ্ন তৈরী হয়েছিল - যে এবার বাংলা চ্যাম্পিয়ন হবেই। কেননা যে টিমে গোপালবাবুর মতো খেলোয়াড় আছে সে টিম চ্যাম্পিয়ন না হয়ে পারেই না। প্রথম অর্ধের খেলার শেষে বাংলা দুই-শূন্যতে এগিয়ে ছিলো। কিন্তু পাঞ্জাবের কোচ বিয়ন্ত সিং তাঁর দলের খেলোয়াড়দের নির্দেশ দেন - তোমাদের জয়-পরাজয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে একটি মানুষ, তিনি হলেন - গোপাল চন্দ্র ঘোষ। আগে ওটাকে আক্রমণ করো, প্রয়োজনে ওটার পা ভেঙে গুড়িয়ে দাও। নাহলে আমাদের মান-মর্যাদা ধুলোয় মিশে যাবে। আমাদের চোখের সামনে বাংলা ট্রফি নিয়ে চলে যাবে এটা কিছুতেই হতে দেওয়া চলবে না।
সেবার পাঞ্জাবের লাকি সিং হকি স্টিক দিয়ে সজোরে আঘাত করে গোপালবাবুর হাঁটু লক্ষ্য করে। ফলে যা হবার তাই হলো। প্রায় মাসখানেক হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর গোপালবাবু যখন বাড়ি ফিরলেন তখন তিনি আর সেই গোপালবাবু ছিলেন না। প্রায় মাস ছয়েক পর তিনি মাঠে ফিরলেন বটে কিন্তু হকিটা তাঁকে ছাড়তে হলো। মাঠে ফিরে তাঁর একমাত্র লক্ষ্য হলো - যেভাবেই হোক বাংলাকে তিনি চ্যাম্পিয়ন করবেনই। তার জন্য যা করতে হয় তাই তিনি করবেন। তাঁর একমাত্র পুত্র সায়নের মধ্যে সেই প্রতিভা তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন। তাই তাকে নিজের চেয়েও বেশি অনুশীলন করিয়ে তৈরী করে ফেলেছিলেন। সায়নকে বলা হতো পেনাল্টি স্পেশালিষ্ট এবং মাঝমাঠের মহারাজ। নীরব নীরবে গোলের মুখে চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। ওকে ভেদ করে একটা মশাও ঢুকতে পারতো না। এই দু'জন ছিলো গোপালবাবুর তুরুপের তাস। তিনি স্বপ্ন দেখতেন - সায়ন নীরবের কাঁধে চেপে ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফিতে চুমু খেয়ে চিৎকার করে বলছে - দেখো বাবা আমি তোমার ছেলে, আমি পেরেছি। কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল।
সেদিন নীরব হকিস্টিকটা আনতে ভুলে গিয়েছিল। কলেজ গেট পেরিয়ে যখন চার্চের গেটের মুখে গেছে তখনই সায়ন দ্রুত গতিতে ছুটে আসছিলো - নীরব ফিরে আয় আমার কাছে একটা এক্সট্রা স্টিক আছে।
ঠিক তখনই বিপরীত দিক থেকে একটা ট্রাক এসে সায়নকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। সায়নের রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন শরীরটা পথের ধারে ছিটকে যায়। ওকে ওই অবস্থায় দেখে নীরব ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। গোপালবাবু ছুটে আসেন, মাঠের অন্যান্য ছেলেরা ছুটে আসে। হাসপাতালে নেওয়ার সময় সায়ন একটা হাত তুলে কী যেন বলতে চেয়েছিল। দু'দিন পরে নীরবের জ্ঞান ফেরে। কিন্তু ও আর কোনোদিনও মাঠে ফেরেনি। গোপালবাবু আজও তাঁর স্বপ্নকে বুকের গভীরে লালন করে চলেছেন। নীরবকে একবার বলেছিলেন - বাবু মাঠে আসবি না?
নীরব শুধু চোখের জলে তার উত্তর দিয়েছিল। মাঠে প্রায়ই আসে কিন্তু গোপালকাকুর সামনে দাঁড়াতে ওর বড্ড ভয় করে।
দশরথবাবু নীরবের মুখ থেকে এমন একটা মর্মান্তিক ঘটনা শুনে নীরব হয়ে যান। মাঠের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে একবার তাকান। তাঁর মন আন্দোলিত হয়। প্রতিটি মানুষের জীবনে একটা না একটা ট্রাজেডি জড়িয়ে আছে। সময় বড়ো নিষ্ঠুর, তার বিচার আরও ভয়ানক। সে যে কার কাছে কী রূপে উপস্থিত হয় তা কারোর কাছে পূর্ব সংকেত দেয় না। প্রকৃতির কী নির্মম ও নিষ্ঠুর বিচার! নিজের অজান্তেই বলে ফেলেন - মাত্র ক'দিনের জন্য পৃথিবীতে আসা, তার মধ্যে কত ঘটনার সন্নিবেশ! কী হবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে, কিংবা নিজেকে বঞ্চিত করে? কোনো লাভ নেই।
দশরথবাবুকে নীরব অনুরোধ করে - খাও না কাকু, একটা অন্তত খাও। কী আর হবে। মানুষের জীবন ক্ষণিকের - এই আছে তো এই নেই। তার জন্য নিজেকে কষ্ট দিয়ে লাভ কী। গোপালবাবু এবং সায়নের বিয়োগান্তক পরিণতির কথা দশরথবাবু নীরবের মুখ থেকে শুনে তাঁর দু'চোখ বেয়ে নামে শ্রাবণের বারিধারা। নীরব ওঁর কাছে গিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দেয় আর নিজেকে যেন কোথায় হারিয়ে ফেলে...।