গল্প ও অণুগল্প

গুলমানিক



মনিরুজ্জামান মনির


বুড়ো বটবৃক্ষের নিবিড় ছায়ার ছোঁয়াখানি সারা গায়ে জড়িয়ে নিঃসাড় শুয়ে আছে একটি বালক। বয়স আনুমানিক দশ-বারো হবে। তেলচিটে গায়ের রঙ, ময়লা নেভী ব্লু রঙের শার্ট পরনে ছেড়া জীর্ণ প্যান্ট। উসকো খুসকো চুল, চটিজোড়া মাথায়। মরার মতো ঘুমোচ্ছে বোধহয়। পাশে কয়েকটা বই পড়ে আছে এলোমেলো হয়ে। একটা সুর ভেসে আসছে দূর থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে; সে সুর মোহাবিষ্ট করতে পারে মুহুর্তের মধ্যে। হয়ত কোনো রাখালের বাঁশির সুর। উদাস দুপুর। খড়খড়ে রোদ কোথাও মেঘের বালাই নেই, খাঁ খাঁ করছে ধু-ধু প্রান্তর। গত মাস দু'য়েকের মধ্যে বৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়না। মাটি ফেটে চৌঁচির। বটের ডালে বসে আলোচনার সারাংশ টেনে বুনো শালিকগুলো খাদ্যের সন্ধানে ডানা ঝাপটে উড়ে গেলো। অনেকগুলো কাক কা-কা স্বরে বটগাছের মাথার উপর যেমন বোমারু বিমান চক্রাকারে ঘুরতে থাকে ঠিক তেমনি করে বটগাছকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। দূর থেকে মনে হয় যেন কোনো অলীক অলক্ষুণে সময়ের ডাক দিচ্ছে।

এভাবে দুপুর গড়িয়ে গেলো, আকাশে খানিকটা মেঘের উৎপাত লক্ষনীয়, এক পশলা বৃষ্টিতে খানিকটা মাটির উপর সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে বিদায় জানালো। এখন আকাশ সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত, পেঁজা মেঘের দল অন্য কোথাও ছুটে চলেছে গন্তব্য পথ বেয়ে। গ্রাম থেকে একটিমাত্র পথ এঁকে-বেঁকে চলে গেছে গঞ্জের বাজারে। এই পথ ধরেই গ্রাম ও গঞ্জের বাজারের যোগসুত্র। এই পথেই হর পাড়ুই মাছের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে যায়, বিমল ঘোষ দুধ ও মাখন বাকে বেঁধে বেচতে যায়। রমেশ ধোপা এই বাজারে নতুন দোকান খুলে কারবার আরম্ভ করেছে। প্রতিদিন প্রায় তিন ক্রোশ পায়ে হেঁটে আসতে হয় গঞ্জের বাজারে। পথের কোল ঘেঁষে এই বটগাছের বিস্তার, তবে গাছটার কবে নাগাদ জন্মলগ্ন তা জানা নেই এই গ্রামের কারও। গোঁসাই নামের এক ব্যক্তি বছর দু'য়েক এখানে ঘরজামাই হিসাবে বসবাস করছে, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে তার টানাটানির সংসার। ছেলেকে নিয়ে তার বিরাট স্বপ্ন; ছেলেকে সে শিক্ষিত বানাতে চায়। তায় সমস্ত অভাব থাকা সত্ত্বেও ছেলেকে ভর্তি করেছে গঞ্জের বাজার সংলগ্ন লক্ষ্মণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মানিকের শিক্ষাকাল শুরু হলো। গ্রামের বুড়ো-বুড়িদের সাথে ভাবের খামতি নেই তার।

বিশেষ প্রয়োজনের তাগিদে হতে পারে এই ঘনিষ্ঠ নিবিড় সম্পর্ক। গ্রামের সবার প্রিয়পাত্র তার সাথে কারও জুড়ি মেলা ভার! স্কুল থেকে ফেরামাত্র সূর্যপিসির বাড়িতে তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, চুটিয়ে গল্পের আসর জমিয়ে তোলে মানিক। স্কুলে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা পইপই করে বিশ্লেষণ করে সূর্যপিসিকে বলতে থাকে সে। কোন স্যার খুব মেরেছে সবাইকে কিংবা কোন ম্যাডাম কাকে কাকে কান ধরিয়ে একপায়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে বা কাকে বেঞ্চের তলে মাথা রেখে ক্লাসের সময় পার করতে হয়েছে - কোনো কথাই সে গোপন করে না। নির্দ্ধিধায় সব যেন উগরে বলতে থাকে সূর্যপিসির কাছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মানিকের কথা তিনি মন দিয়ে শুনতে থাকেন। গল্প বলতে বলতে মানিক বারবার পিসির আঁচলে বাঁধা পুঁটলির দিকে আড় চোখে তাকায়, পিসি দেখেও না দেখার ভান করেন। পিসি ভাতের হাঁড়ি উনুনে চাপিয়ে আগুন জ্বালালেন, ধোঁয়ার কুন্ডলী পাকিয়ে মিশে যাচ্ছে বাতাসে। মানিকের নজর কিন্তু আঁচলে বাঁধা পুঁটলিটায়, যেন চোখ সরে তো মন সরেনা; মন সরে তো চোখ সরেনা।

পিসির চোখ এড়াতে পারেনা মানিক আবার মুখেও বলতে পারেনা, তার কোনো কিছু কারো কাছে চাইতে বেশ লজ্জিত হয় নিজের কাছে। তাও চুপচাপ কিছু না বলে বসে থাকে সে। পিসি আঁচলের গিট খুলে পুঁটলিটা বের করে খুলতে আরম্ভ করলেন, মানিকের চোখ বোধহয় এখুনি ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। একটা কৌটো বেরিয়ে এলো পুঁটলির মধ্যে থেকে। পিসি খানিকটা মুখের মধ্যে দিয়ে কৌটোটা মানিকের দিকে এগিয়ে দিতেই ছোঁ মেরে, যেমন চিল মুরগির দল থেকে বাচ্চা তুলে নিয়ে যায় তেমনি মানিক পিসির হাত থেকে ছোঁ মেরে কৌটোটা নিয়ে নিলো। দেরি না করেই খানিকটা রসদ মুখের মধ্যে ঢেলে দিলো মানিক। কৌটোটা পিসিকে ফিরিয়ে দিয়ে ঝিম ধরে বসে রইলো, কোনও টুঁ শব্দটিও করলো না সে, স্থির দৃষ্টি তার, অনেক না বলা কথার ভিড়। নতুন ভাবের উদয় পরিলক্ষিত, মুহুর্তের মধ্যে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে শিহরিত মনে স্বস্তি সমস্ত চিত্তে খেলা করতে লাগলো। ভেতরে তার নতুন সত্তা হাতছানি দিয়ে ডাকছে অন্য ভুবন।