প্রবন্ধ

চর্যাপদের সমকালীন সমাজে নারীর অবস্থা



প্রসেনজিৎ দাস


চর্যাপদ আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা সাহিত্যে স্বর্ণ উষার দ্বার উন্মোচিত হয়।কারণ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম পদ সংকলন তথা সাহিত্যিক নিদর্শন হিসাবে চর্যাপদের নাম লেখা হয়ে গেল ইতিহাসের পাতায়। পাশাপাশি এটি নব্য ভারতীয় আর্যভাষারও (New Indo Aryan) প্রাচীনতর রচনা।খ্রিষ্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই পদগুলির রচয়িতারা সকলেই ছিলেন বৌদ্ধ সহজিয়া সিদ্ধাচার্য।সেই অর্থে চর্যাপদ ছিল বৌদ্ধ সহজিয়া সিদ্ধাচার্যদের সাধন সংগীত। বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ় অর্থ সাংকেতিক রূপকের আশ্রয়ে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যেই তাঁরা পদগুলো রচনা করেছিলেন। বাংলা সাধন সংগীত শাখাটির সূত্রপাতও হয়েছিল এই চর্যাপদের হাত ধরেই। সে বিবেচনায় এটি একটি ধর্মগ্রন্থজাতীয় রচনা। ১৯০৭ সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা(Library),যেটি বর্তমানে রাষ্ট্রীয় অভিলেখাগার নামে পরিচিত,সেখান থেকে চর্যার একটি খণ্ডিত পুঁথি উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর "The origin and development of the Bengali language" (ODBL) গ্রন্থে ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে চর্যাপদের সঙ্গে বাংলা ভাষার অনস্বীকার্য যোগসূত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তিসহ প্রতিষ্ঠিত করেন।চর্যাপদে সমকালীন সময়ের মানুষদের জীবনযাত্রা,তাদের সামাজিক,রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের ছবি খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে পদকর্তাগণের পদে।পাশাপাশি নারীজীবনের বেশ কিছু টুকরো ছবিও ধরা পড়েছে।তখন কেমন ছিল নারীদের জীবন?আমরা আলোচনা করব সেইসব জানা-অজানা তথ্য।

চর্যাপদে একমাত্র মহিলা পদকার কুক্কুরী পা।তাঁর পদে তৎকালীন নারী সমাজের বেশ কিছু টুকরো ছবি ধরা পড়ে।নারীদের জীবনযাত্রা,তাদের জীবিকার ছবি পদগুলি পড়লেই আমাদের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে।কুক্কুরী পার নামে দুটি চর্যা পাওয়া যায়-২ নং এবং ২০ নং চর্যা।তাছাড়া ৪৮ নং চর্যা যেটি পাওয়া যায়নি,সেটিও নাকি কুক্কুরী পার লেখা।২ নং চর্যায় পাই -

"দুলি দুহি পিটা ধরণ না জাই।
রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ।।
আঙ্গণ ঘরপণ সুন ভো বিআতী।
কানেট চৌরি নিল অধরাতী।।
সুসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগঅ।
কানেট চোরে নিল কাগই মাগঅ।।
দিবসই বহুড়ী কাউই ডরে ভাঅ।
রাতি ভইলেঁ কামরু জাঅ।।"


এই পদটির "কানেট চৌরি... কামরু জাঅ"-অংশটুকুর দিকে আলোকপাত করা যাক।অর্ধেক রাতে চোর এসে কানেট অর্থাৎ কানের অলংকার চুরি করে নিয়ে গেল।শ্বশুর নিদ্রা গেল আর বধূ রইল জেগে।চোরে কর্ণভূষণ নিয়ে গেলে কার কাছে গিয়ে সন্ধান করা যায়?দিনে বউটি কাকের ভয়ে ভীত হয় কিন্তু রাত হলেই পরপুরুষের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য ঘরের বাইরে বেড়িয়ে পড়ে।

অর্থাৎ তখনকার দিনে রাতে চোর ডাকাতের উপদ্রব ছিল।কারণ চর্যাপদের সমকালীন অধিকাংশ মানুষই ছিল দরিদ্র।পদ্মের মৃণাল খেয়েই অনেকে খুণ্ণিবৃত্তি করত।তাই চুরি ডাকাতির উপদ্রব থাকবে এটা তো সাধারণ বিষয়।

বৌদ্ধধর্মে মহাসুখ লাভের বিষয়টি রূপকের আড়ালে কুক্কুরী পা এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন।কিন্তু এর জন্য তিনি যে ছবিটি তুলে ধরলেন এর বাহ্যিক ছবিটিও তৎকালীন নারীদেরই জীবনযাত্রার ছবি।'সুসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগঅ'-পঙক্তিটি তৎকালীন সময়ে কতটা অকল্পনীয় তা ভাবলে অবাক হতে হয়। কিন্তু তৎকালীন নিম্নবর্গীয় সমাজে নারীদের (ডোমনি, শবরী, শুঁড়ি, শুণ্ডিনি, চণ্ডালী) বাস্তব অবস্থা ছিল এমনই।পরপুরুষে আসক্তি তখনও ছিল,এখনও আছে।আবার নারীরা যে অলংকার ব্যবহার করত,এই পদটি তার প্রমাণ। এসব ছবিই কুক্কুরী পা তার পদগুলিতে তুলে ধরেছেন। তাঁরই লেখা ২০ নম্বর চর্যায় পাই -

"হাঁউ নিরাসী খমণ ভতারি।
মোহোর বিগো আ কহণ ন জাই।।
ফেটলিউ গো মাএ অন্তউড়ি চাহি।
জা এথু বাহাম সো এথু নাহি।।
পহিল বিআণ মোর বাসনয়ূড়া।
নাড়ি বি আরন্তে সেব বায়ূড়া।।
জান জৌবণ মোর ভইলেসি পুরা।
মূল ম খালি বাপ সংঘারা।।"


- এই পদে রয়েছে নারী জীবনের আক্ষেপ। পদকর্তা নিজেকে 'নিরাসী' বলেছেন অর্থাৎ আসক্তিহীন। তার স্বামী খমণ বা ক্ষপণক অর্থাৎ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। সে কাম গন্ধহীন।পদকর্তার অনুভব মুখে বর্ণনা করা যায় না। নারী দেহের চাহিদা, কামনা-বাসনা পূরণ না হওয়ার যন্ত্রণা পদকর্তা তুলে ধরেছেন অকপটে। আসলে এর রূপক অর্থটাই চর্যাপদের মূল আলোচ্য। আমরা রূপক অর্থটা ব্যাখ্যা এখানে করছি না। আমার মূল আলোচ্য যেহেতু নারী জীবনের কথা, তাদের অবস্থার কথা, তাই এই বাহ্যিক কাব্যিক অর্থটাই তাই তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। এছাড়াও এই পদে আছে নারীর সন্তান উৎপাদন,দৈহিক মিলনের অপূর্ণতার কথা।আঁতুড় ঘরে সন্তান প্রসবের পর নাড়ি টিপে তার কেনো হৃৎস্পন্দন পাওয়া গেল না,এখানে নারীর সন্তান হারানোর ব্যথাও পদটিতে লক্ষ্য করা যায় -

"মা গো, আঁতুড় দেখে প্রসব করলাম, যাকে এখানে বিয়োই তা এখানে নেই। প্রথম প্রসব আমার -বাসনার পুঁটুলি। নাড়ী টিপতে টিপতে সেও হাওয়া। যখন আমার নব যৌবন পূর্ণ হল (তখন) আমার দ্বারা মূল স্খলিত হল, বপন ক্ষেত্র নষ্ট হল।"
- 'চর্যাগীতি পরিক্রমা', ডক্টর নির্মল দাশ

আবার বিরুপার ৩ নম্বর চর্যায় পাই - এক সুন্ডিনির (শুঁড়ি-মদচোলাই ও বিক্রি করে যে) মদ চোলাই ও বিক্রির দৃশ্য -

"এক সে সুন্ডিনি দুই ঘরে সান্ধ অ।
চীঅণ বাকল অ বারুণি বান্ধ অ।।
সহজে থির করী বারুণি সান্ধে।
জেঁ অজরামর হোই দিঢ় কান্ধে।।
দশমি দু আরত চিহ্ন দেখই আ।
আইল গরাহক অপণে বহি আ।।
চউশঠী ঘড়িয়ে দেঢ় পসারা।
পইঠেল গরাহকা নাহি নিসারা।।"


আসলে শুঁড়ি মেয়েটির মদ চোলাই ও বিক্রির রূপকে মহাসুখলাভের যৌগিক সাধন পদ্ধতির কথা বর্ণিত হয়েছে পদটিতে।তখনকার নিম্নবর্গীয় নারীদের মদচোলাই ও বিক্রি ছিল সাধারণ ঘটনা।তাই পদকর্তা এই টুকরো টুকরো ছবিগুলিই তুলে এনেছেন তাঁর কাব্যের রসদ হিসাবে তথা তার কাব্যিক রূপকের মোড়কে পরিবেশন করতে।

শবর পার ২৮ নং পদে পাই শবরী বালিকার সৌন্দর্য চেতনার ছবি -

"উঞ্চা উঞ্চা পাবত
তঁহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী
গিবত গুঞ্জরী মালী।।
উমত সবরো পাগল শবরো
মা কর গুলী গুহাড়া তোহৌরী।
নি অ ঘরিনী ণামে সহজ সুন্দরী।।
ণা আ তরুবর মৌলিল রে গঅণত
লাগেলি ডালী।
একেলী সবরী এবণ হিণ্ডুই কর্ণ্ণ কুণ্ডলবজ্রধারী।।"


- উঁচু উঁচু পাহাড়ে শবরী বালিকা বাস করে।তার পরিধানে ময়ূরের পুচ্ছ,গলায় গুঞ্জা ফুলের মালা,কানে তার কুণ্ডল,কণ্ঠে শোভা পাচ্ছে বজ্র। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক জিনিস ব্যবহার করে তাদের এই রূপসজ্জা, যা দেখলে অভিভূত হতে হয়।শবরী বালিকার এই মোহময়ী রূপে মুগ্ধ শবর।বলাবাহুল্য শবরদের চমক লাগিয়ে দেওয়ার জন্যই শবরী বালিকার এই বেশ।শবরী(শিকারী)নারীদের বন্য জীবনযাপন,তাদের রূপসৌন্দর্য,প্রেম-ভালোবাসা,রূপজ কামনা বাসনা,দৈহিক মিলনের ছবিই এঁকেছেন পদকর্তা।প্রকৃতির এক অপরূপ চিত্রকল্প, শবরের প্রেমানুভূতির ব্যঞ্জনা আধুনিক কবিতা পাঠককেও বিমোহিত করে,যার আবেদন চিরকালীন।তখনকার দিনেও নারীরাও নিজেদের অঙ্গসজ্জা ও রূপসজ্জার বিষয়ে যে সচেতন ছিলেন - এই সমস্ত পদগুলি তা প্রমান করে।

তেমনি শবর পাদের ৫০ নং পদেও পাওয়া যায় -

"...হেরি সে মেরি তইলা বাড়ী খসমে সমতুলা।
সুকড় এসে রে কপাসু ফুটিলা।।
তইলা বাড়ীর পাঁসের জোহ্নাবাড়ী তাএলা।
ফিটেলি অন্ধারি রে আকাশফূলিলা।।
কঙ্গুচিনা পাকেলা রে শবরাশবরি
মাতেলা।
অণুদিন-শবরে কিম্পি ন কেবই মহাসুহেঁ ভেলা।।"


আমার উঁচুতে ঘর। কার্পাসফুলে চারিদিক ভরে গেছে। বাড়ির পাশে চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্নার আলোয় আঁধার কেটে গিয়ে যেন অজস্র ফুল ফুটে উঠেছে আকাশে।কঙ্গুচিনা ফল পেকেছে আর শবর-শবরী প্রেমাবেগে মেতে উঠেছে।এখানেও সেই একই প্রেমের ছবি ও প্রেমাবেগ প্রাধান্য পেয়েছে।

তেমনি গুণ্ডরী পা-এর ৪ নং চর্যাতেও আছে নরনারীর যৌন মিলনের ছবি -

"তি অড্ডা চাপী জোইণি দে অঙ্কবালী।
কমলকুলিশ ঘান্টে করহূঁ চিআলী।।
যোইনি তইঁ বিনু খনহিঁ ন জীবমি।
তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমি।।"


- তেওড়া (জঘন) / তিন নাড়ী (বামগা, দক্ষিণগা, মধ্যগা) চেপে যোগিনী (সাধককে) আলিঙ্গন দেয়, পদ্ম ও বজ্রের (বৌদ্ধতন্ত্রে পদ্ম ও বজ্রকে যথাক্রমে স্ত্রী ও পুরুষ জননাঙ্গের প্রতীক হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে) সংঘর্ষে কাল কাটিয়ে দাও। যোগিনী তোকে ছাড়া এক মুহূর্তও বাঁচি না, তোর মুখ চুম্বন করে কমলরস পান করি।

আবার কাহ্নু পাদের ১০ নং চর্যায় পাওয়া যায় নগরের বাইরে কুঁড়ে ঘরে থাকা ডোমনি অর্থাৎ শ্মশানে শবদাহ কার্যে সাহায্যকারী নারীর বর্ণনা। তাদের জীবিকা ছিল তাঁত বোনা, চুবড়ি, চাঙাড়ি তৈরি করা আর খেয়া পারাপার করা -

"নগর বাহিরেঁ ডোম্বি তোহোরি কুড়ি আ।
ছোই ছোই জাহ সো বাহ্ম নাড়ি আ।।
আলো ডোম্বী তো এ সম করিব ম সাঙ্গ।
নিঘিণ কাহ্ন কাপালি জোই লাগ।।
এ সো পদমা চৌসট্ঠী পাখুড়ী।
তহিঁ চড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ী।।"


- নগরের বাইরে ডোমনীর কুঁড়ে ঘর।ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় সেই ব্রাহ্মণ বাললকে।পদকর্তা তার কোমল স্পর্শ পেয়ে ডোমনির সঙ্গে প্রাণে বাঁধা পড়তে চান।ঘৃণাহীন,নগ্ন কাপালিক যোগী হয়ে হাড়ের মালা গলায় পরলেন পদকর্তা সেই ডোমনিকে পাবার লোভে -

"তুলো ডোম্বী হাঁউ কপালী।
তোহোর অন্তরে মো এ ঘলিলি হাড়েরি মালী।।"
এই চাওয়া-পাওয়া,আশা-আকাঙ্ক্ষা,...


রূপ ও দৈহিক কামনা বাসনা এ পদটিতে পদকর্তা নিপুণ ভাবে তুলে এনেছেন। ভালোবাসার জন্য,তাঁর সেই প্রিয় ডোমনি নারীটির জন্য হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে দুরন্ত ষাঁড়ের মুখে লাল কাপড় বাঁধার মত,জাত- কুল-মান ত্যাগ করা কজনই বা পারে?কিন্তু কাহ্ন পেরেছেন।এমনই এই মোহ তার তুলনা মেলা ভার। সামান্য একজন ডোমনির জন্য জাত কুল মান ত্যাগ করে কাহ্নের কাপালিক সাজা,নিজের ঘরের শাশুড়ি,ননদ ও শালীকে হত্যা করা,এমনকি নিজের গর্ভধারিণী মা কেও হত্যা করা - এ এক অদ্ভুত ঘটনা। ১১ নং পদে পাই -

"মারি অ সাসু নণন্দ ঘরে সালী।
মা অ মারি অ কাহ্ণ ভইএ কবালী।।"


ডোমনিকে একান্ত নিজের করে পাওয়ার জন্য কাহ্নের এই নারকীয় হত্যালীলা।পাশাপাশি এই পদে ফুটে উঠেছে অনুলোম(উচ্চবর্ণীয় পুরুষের সঙ্গে নিম্নবর্গের নারীর বিবাহ) বিবাহের প্রথা।

এর পরেই ১৯ নং পদে আমরা দেখতে পাই কাহ্নর ডোমনিকে বিয়ে করতে যাওয়ার প্রসঙ্গ,ডোমনিকে বিয়ে করে তার জাত যাওয়ার কথা -

"ডোম্বি বিবাহিআ অহারিউ জাম।
জউতুকে কিঅ আণুতু ধাম।।"


সে সময় বিবাহে বরপক্ষ যৌতুক নিত এবং বেশি যৌতুকের লোভে নীচ জাতের মেয়েকে বিয়ে করতেও দ্বিধা করত না।কাহ্ন পা ডোমনিকে বিয়ে করার মধ্যে দিয়ে এই সত্য সকলের সামনে তুলে ধরেছেন।

চর্যাপদে অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রার কথাই বারবার উঠে এসেছে। জাতপাতের ভেদাভেদ, সংকীর্ণতা ছিল তখনও। নগরের বাইরে ডোম্বির কুঁড়েঘর- এই অংশটি যেন তারই দ্যোতক।সব মিলিয়ে চর্যাপদে সাধারণ মানুষের জীবনের পাশাপাশি নারীজীবনেরও নিখুঁত বিবরণ কাব্যময়তার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। চারপাশের চেনা জগতের ছোট ছোট খণ্ড মুহূর্ত, বাস্তব জীবনের দৃশ্য যেন ছবির মত বারবার ফিরে এসেছে।গ্রাম্য বধূর বিষণ্ন মুখ, মাদল বাজিয়ে বরের বধূ আনতে যাওয়ার দৃশ্য , সেখানে স্ত্রী আচার, বাসর ঘরে বধূ সাজে অলংকৃত রমনীর পাশে অন্যান্য মেয়েদের ভিড় করার ছবিও কবিতায় অনায়াসে উঠে আসে।নারীদের পরনের ছেঁড়া কাপড়, ভাঙা কলসি,প্রভৃতির ছবি এক লহমায় সমাজের প্রান্তিক মানুষগুলির নিঃস্ব নিরানন্দময় জীবনের দৈনন্দিন বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে তোলে।শুধু তাই নয়,দুঃখ, যন্ত্রণা থাকলেও তারা আনন্দ উৎসবেও মেতে উঠত।পটহ,মাদল,বীণা বাজিয়ে বুদ্ধ নাটক খুব জমে উঠত।বীণা পা রচিত ১৭ নং পদে পাই -

"নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী।
বুদ্ধ নাটক বিসমা হোই ।।"


নারী পুরুষ নির্বিশেষে সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সন্ধ্যায় এক জায়গায় গোল হয়ে বসে এই নাটক উপভোগ করত।নারীরাও এই নাটকে অংশগ্রহণ করত।সবমিলিয়ে টুকরো ছবিগুলোই আসলে তখনকার দিনের বাস্তব চিত্র।

তাই প্রকৃতই মনে হয় 'Literature is the mirror of society'।

অর্থাৎ সাহিত্য হল সমাজের দর্পণ।চর্যাপদও সেই অর্থে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তী বাংলাদেশের এক সামাজিক আলোকবর্তিকা।


সহায়ক গ্রন্থপঞ্জীঃ

১) 'চর্যাগীতি পরিক্রমা', ডক্টর নির্মল দাশ।
২) 'চর্যাগীতি পদাবলী', ডক্টর সুকুমার সেন।
৩) 'বাংলা ভাষার অভিধান', সাহিত্য সংসদ, জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাস।
৪) 'চলন্তিকা', রাজশেখর বসু।
৫) 'প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ', সুকুমারী ভট্টাচার্য।
৬) উইকিপিডিয়া।
৭) বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি - একাদশ শ্রেণি, পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ।