পর্ব - ২০
নিউজিল্যান্ড সম্বন্ধে প্রায় সব তথ্য ই জেনে নিয়েছি সুমনার কাছ থেকে। তবু জিজ্ঞাসু মন আর ও কিছু জানতে চায়। ওখানকার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। ট্যাক্সের কথা। চাকরির সুযোগ কতো টা। অভিবাসন আইন। তাদের দেয় সুযোগ সুবিধা। পুরো টা না জানলে তো সম্পূর্ণতা আসে না।
সুমনার পতিদেবতা তপনের শরণাপন্ন হই। কলেজে পড়ায় বহুদিন হয়ে গেল। প্রচুর অভিজ্ঞতা। প্রচুর পড়াশোনা। বহু মানুষের সান্নিধ্য লাভ করেছে বলে সব বয়সী মানুষের সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে।
প্রথমেই যে প্রশ্ন টা করি সেই প্রশ্নের মুখোমুখি ওনাকে হতে হয়েছে অসংখ্য বার। জবাবদিহি করে করে ক্লান্ত। নিজের মুখোমুখি হয়ে নিজেকে ও এই প্রশ্ন বাণে ক্ষতবিক্ষত করেছেন শত সহস্র বার। আমৃত্যু এই প্রশ্ন তাকে তাড়া করে বেড়াবে সেটা তিনি জানেন। হয়তো এটাই তার ভবিতব্য। মুখের উপর আমরা তো কাউকে বলতে পারি না - জীবন আমার। আমার জীবন আমি কিভাবে কাটাবো সে সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা আমার আছে। তোমাদের সবার কাছে আমি জবাবদিহি কেন করবো?
না, আমাদের ভদ্রতা বোধ কটুকথা বলতে বাধা দেয়। সৌজন্য বশতঃ বহু অপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর দিতে আমরা কার্যত বাধ্য হই।
প্রশ্নটি হলো সুনিশ্চিত চাকরি ছেড়ে, স্হায়ী বাসস্থান ছেড়ে, আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব দের ছেড়ে অজানা দেশের অনিশ্চিত জীবন যাপন বেছে নিলে কেন?
তপনের উত্তর তৈরি করাই আছে। সেটাই রিপিট করেন।
- কি জানো তো, ছোট বেলা থেকেই অ্যাডভেঞ্চারের গল্প পড়ে পড়ে ঠিক করে ফেলেছিলাম নির্জন কোনো দ্বীপে বাসা বাঁধবো। দেশান্তরী হবো। থাকবো না কো বদ্ধ ঘরে। জগত কে খুব কাছ থেকে দেখার আকর্ষণে ঘর কইনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর। আমার সব সময় মনে হতো দূর কে করবো নিকট বন্ধু, পরকে করবো ভাই। দেখো, আমি ঠিক সেটাই করেছি। আমাকে নিয়ে আমার দেশোয়ালি ভাইয়েদের কি বিশাল দুশ্চিন্তা। এদেশে এসে কি খাবো, কোথায় থাকবো ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার সোজা কথা
- কুয়োর ব্যাঙ হয়ে কোনো দিন থাকতে চাই নি। নন্দলাল হয়েও নয়।
- তপন, আমি সুমনার চোখ দিয়ে এতো দিন নিউজিল্যান্ডকে দেখেছি, এবার তোমার চোখ দিয়ে দেখতে চাই। তুমি পুরুষ মানুষ। তোমার দৃষ্টিভঙ্গিতে নিজস্বতা স্বকীয়তা অনেক বেশি থাকবে। আমি সেটা জানতে চাইছি। ওদেশের কি তোমার ভালো লেগেছে আর কি ভালো লাগে নি?
- এদেশের যেটা সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে সেটা হলো রাষ্ট্রীয় নজর দারি, সবার প্রতি সমান মনোযোগ, শিক্ষা আর স্বাস্হ্য কে অগ্রাধিকার দেওয়া, ভবিষ্যত নাগরিকদের ভীষণ যত্ন সহকারে তৈরি করা। নৈতিক শিক্ষা এখানকার প্রাথমিক শিক্ষা। অসম্ভব পরিচ্ছন্নতা বোধ, সৌজন্য দেখানো, বয়স্কদের সম্মান জানানো, সহমর্মিতার মনোভাব। পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি, এই জীবন মন সকলি দাও। তার মতো সুখ কোথাও কি আছে? আপনার কথা ভুলিয়া যাও। আমরা পড়েছি। ফলো করি নি। এরাও অনুরূপ কিছু পড়েছে নিশ্চয়ই এবং সারা জীবন দিয়ে অনুসরণ করে যাচ্ছে। আমার এক জন প্রতিবেশী, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, যখনি ঘাস কাটার মেশিন দিয়ে ওনার বাগান পরিষ্কার করতেন, আমার বাগানটা যেহেতু ওনার বাগান সংলগ্ন, সেই মেশিন দিয়ে আমার বাড়ির বাগানের ঘাস ও কেটে দিতেন। আমি তো ভীষণ লজ্জিত। বারবার ওনাকে নিষেধ করছি কিন্তু উনি ভ্রূক্ষেপ ও করছেন না। পরে আমাকে বললেন - আমি এখন পারছি তাই পরিষ্কার করে দিচ্ছি। যখন পারবো না তখন তুমি ইয়ং ম্যান, আমার টা পরিষ্কার করে দিও। ভাবা যায়? অথচ উনি একজন উচ্চ পদস্থ ইঞ্জিনিয়ার।
কয়েক দিন আগের ঘটনা। দুই দিন ধরে আমি লক্ষ্য করছি রাস্তায় একটি পাঁচ টাকার কয়েন পড়ে আছে। পাঁচ টাকার কয়েন ইচ্ছে করে বললাম তোমার বোঝার সুবিধার্থে। দেখছি কয়েনটা কেউ তুলছে না। পড়েই আছে। আমার তো এসব দেখে অভ্যাস নেই। ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছি। বারবার চোখ দুটো চলে যাচ্ছ ওদিকে। তার পর আমি কয়েনটা তুললাম। এক টি বাচ্চা ছেলে ছিল কাছাকাছি, ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম - ললিপপ কিনে খাও। বাচ্চা টি খুব খুশি হয়ে নাচতে নাচতে চলে গেল। অথচ হয়তো কয়েনটা কে রাস্তায় পড়ে থাকতে ও দেখেছে কিন্তু তোলার শিক্ষা ওর নেই।
কলেজ থেকে ফেরার পথে দেখলাম - কলেজের ছেলে রা আপেল আর কমলা লেবু নিয়ে বল ছো়ঁড়াছুঁড়ি খেলছে। দেখে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের কথা মনে পড়ে গেল। বুকটা ব্যথায় টনটন করে উঠলো। এদেশের ছাত্র ছাত্রীদের প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার, ভিটামিন যুক্ত খাবার, ফল মূল যা খাওয়ানো হয় সেটা অবিশ্বাস্য। সরকারি নীতি - প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার মানেই বুদ্ধির বিকাশ, প্রতিভার স্ফূরণ, হাসপাতালে কম যাওয়া।
সঙ্গে সঙ্গে দেশের সাথে তুলনা মনে এসে যায়। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মৃত্যু হয়েছিল খেতে না পেয়ে, ক্ষয় রোগে। কবি জীবনানন্দ দাশকে চাকরির জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পান নি। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী - এদের সংগ্রাম করতে হয় দারিদ্র্যের সঙ্গে। সাধনা করতে হয় খালি পেটে। সব সময় মনে হয় - হে মোর দুর্ভাগা দেশ! কবে ঘুচবে তোমার দারিদ্র্য? কবে পেট পুরে খেতে পাবে সব নিরন্ন শিশু? কবে পোশাকে আবৃত হবে সব উলঙ্গ শিশু? খাই, শুই, চাকরি করি। বেতন পাই। কিন্তু অহরহ পীড়িত হই, ক্লিষ্ট হই এদের কথা ভাবলে। কারো জন্য কিছু করা হলো না।
আমার খুব ইচ্ছে করে,কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় যদি বেঁচে থাকতেন ওনাকে এদেশে একবার নিয়ে এসে বলতাম - আপনি যেমন দেশের স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান, এই দেশ টা ঠিক তেমনি। চলুন, আমরা সবাই মিলে ভারতবর্ষের জীর্ণ খোলস ছিন্ন করে এমন নতুন ভারত গড়ি।
Tax সম্বন্ধে জানতে চাইছিলে না? এদেশে ধনীদের ট্যাক্স অত্যন্ত বেশি, কম অবস্থাপন্ন দের সামান্য। এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ভারতীয় টাকায় দেড় হাজার টাকা। ফলের রসের দাম সামান্য। সব খাবার দাবারের ট্যাক্স খুব কম।
অবসর গ্রহণ করার পর সবার এক পেনসন। এক জন বিচারক যে পেনসন পাবেন, এক জন নার্স ও তাই।
দেশের প্রাইম মিনিস্টার যে মার্কেট থেকে বাজার করেন একজন সুইপার ও সেখান থেকে ই বাজার করেন। সবার সমান মর্যাদা। তাই মানুষের অহং বোধ তৈরি হতে পারে না।
আমি বলি - তপন, দেশভাগের বিষময় ফল আমাদের জীবনে অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে। মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের ন্যুব্জ করে রেখেছে। কথায় বলে - এক সন্তান কে সোনা দিয়ে মুড়ে ফেলা যায় কিন্তু সাত সন্তানকে ছাই দিয়ে ও ঢাকা যায় না। আমাদের অবস্থা হয়েছে তাই। এখন বহু বাঙালি ছেলে মেয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দেশকে আর ভারাক্রান্ত করতে তারা চায় না। জীবন জীবিকা নির্বাহের পথও নিজেরাই বেছে নিচ্ছে। বাঙালির ঘরকুনো বদনাম ঘুচেছে।
তপন বললেন - বাঙালির মগজের আদর। কিন্তু কায়িক শ্রমী হিসেবে তাদের কদর নেই।
বিদেশে শ্রমিক হিসেবে কেরালা বাসী, মারাঠি, পাঞ্জাবী দের খুব সমাদর। কেরালার লোক জন কঠিন পরিশ্রম করে টাকা জমিয়ে মিডিল ইস্টে চলে যায়। সেখান থেকে তাদের স্ত্রীদের International Student করে অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড নিয়ে আসে। সরকারি সাহায্য নিয়ে মেয়েরা নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারে বিভিন্ন ধরনের কোর্স করে সহজেই নার্সিং করার চাকরি পায়। ডাক্তার, নার্সদের এখানে অসম্ভব চাহিদা।
এছাড়া প্রচুর মারাঠি গুজরাটি পাঞ্জাবি রাও আসেন। সরকারি স্কলারশীপ পেয়ে তারা ও বিভিন্ন রকমের চাকরির সুযোগ পান। এ ছাড়া এখন অনেক বাংলা দেশের লোক দেখতে পাই। তাদের হোটেলের ব্যবসা খুব জমে উঠেছে।
আর আছে চীন দেশ থেকে আগত মানুষ। এক টি চীনা পরিবার যদি একটু গুছিয়ে নিয়ে বসে তাহলেই তাদের আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব ভাই বেরাদরদের ডেকে এনে চাইনিজ মহল্লা বানিয়ে নেবে। জুতো সেলাই থেকে সব ধরনের কাজ, চন্ডীপাঠ টা বাদে, তারা হাসি মুখে করে। কোনো কাজে না নেই। সর্বত্র কাজের আদর।
- তুমি জিজ্ঞেস করছিলে না, এখানকার কোন টা আমার অপছন্দের। সেটা হলো এখানকার পারিবারিক বন্ধন আমাদের মতো নয়। হরদম ডিভোর্স হচ্ছে। একটি পনেরো ষোল বছরের মেয়ে, সে মায়ের সঙ্গে রয়েছে। মা গর্ভধারিণী কিন্তু মায়ের তিন নং বিয়ে। মেয়েটি ছিল এক নং স্বামীর। এখন মেয়েটি আছে তিন নং সৎ বাবার কাছে। পিতৃস্নেহ বঞ্চিত মেয়েটি সৎ বাবার কাছে হয়তো পিতৃস্নেহের বদলে হয় লালসার শিকার। এটা সরকার থেকে জানতে পারলে অপরাধীকে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দেওয়া হয়। চুরি ডাকাতির ঘটনা বিরল। সামাজিক ব্যধির শিকার অধিকাংশ অপরাধী। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে গেছে - এমন ঘটনা অন্ততঃ এখানে ঘটে না। অপরাধীকে শাস্তি পেতেই হবে।
- তপন, তুমি খুব ভালো গান গাইতে। অপূর্ব সুন্দর আবৃত্তি করতে। নাটক করতে ভালোবাসতে।
নাটকের পরিচালক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলে।অবসর সময়ে এই সবের চর্চা করো?
হা হা করে উচ্চ কন্ঠে হাসেন তপন। বলেন - হারিয়ে গেছে মোর বাঁশি। আমি কোন সুরে গাই গান?
আমি বলি - না তপন, কিচ্ছু হারায় না। রাতের তারারা লুকিয়ে থাকে দিনের আলোর গভীরে।
পর্ব - ২১
সুমনাকে বলি - সুমনা, অনেক কথাই শুনলাম, বললাম। এখন আমার যাবার সময় হলো, দাও বিদায়। সুমনা বলে - না না, বঁধু, যাই যাই বোলো না। আমি হেসে বলি - দ্যাখ সুমনা, যেই বয়ের উপর চন্দ্রবিন্দুটা দিলাম অমনি বঁধু শব্দের অর্থ হয়ে গেল বন্ধু।কি মজার তাই না?
সুমনা বলে - মজাই বটে! চন্দ্র বিন্দুটা শব্দের আগে বসাও স্বর্গ প্রাপ্তি ঘটে যাবে। হো হো করে হেসে উঠি দুই বন্ধু। ফোনের ওপারে আর এপারে।
সুমনা বলে - তোমাকে অনেক কথা বললাম। আবার না বলা থেকে গেল অনেক কিছুই। কোনো টি দ্বিধায়, কোনো টি সঙ্কোচে, আবার কোনো টি অনাবশ্যক বোধ করে। স্মৃতি ও প্রায়শই সাথ দেয় না। পরে হয়তো মনে হবে। আজকাল এমন টা খুব হয়। কতো কথা বলি বলি করে বলা হয়ে ওঠে না।
আমি বলি - সুমনা, আমরা যখন সোয়েটার পরি, সবাই ওপরের ডিজাইনটা দেখে। সোয়েটারের ভেতরে রয়ে যায় কতো এবড়ো খেবড়ো গিঁট, উলের জোড়া তাপ্পি। সেগুলো কি আমরা দেখি না দেখাতে চাই? সবার জীবনেই কিছু কিছু কথা, কিছু ঘটনা থাকে যেটা কারো সাথে শেয়ার করা যায় না। আজীবন বুকের গভীরে লালন করতে হয়। আমার সঙ্গে সঙ্গে ছাই হয়ে যাবে সেই সব কথা।
সুমনা অভিমান ভরে বলে - আমার সব চাইতে বেশি উপকারী বন্ধুর গল্প টা তো তুমি বললেই না।
- কেন? এথেনার গল্প তো আমি তিন এপিসোড ধরে বলেছি।
- আর এলিজাবেথ? সে বুঝি বানের জলে ভেসে যাবে?
- ও, তাই তো? আচ্ছা, আজ তাহলে এলিজাবেথের গল্প হোক।
এলিজাবেথের একটি অভ্যাস ছিল কোনো বিদেশি দেখলেই নিজের থেকে এগিয়ে এসে আলাপ পরিচয় করতেন। সুমনার সাথে ও পরিচয় করে জানতে চাইলেন কোথা থেকে এসেছ? কেন দেশ ছেড়ে এলে? তোমার বাড়িতে কে কে আছেন? ভদ্রতা করে সুমনা তাকে বাড়িতে নিয়ে এলো। ছেলে মনোজের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল - ইনি তোমার একজন আন্টি হন।
যেমনটি আমরা সবাই বলে থাকি - ইনি তোমার বীণা মাসী, ইনি সুরভি মাসী। এলিজাবেথ প্রতিবাদ করে বলে উঠলেন - না না, আমি কিভাবে তোমার আন্টি হবো? আমি তোমার প্রতিবেশী। তুমি আমাকে এলিজাবেথ বলে ডাকবে।
বড়ো দের নাম ধরে ডাকার কথা তো আমরা কস্মিনকালেও ভাবতে পারি না। কিন্তু ওখানে ওটাই রীতি। এলিজাবেথ সুমনাকে বললেন - তোমার নাম টা আমাকে ইংরাজি তে লিখে দাও। তাহলে আমি সঠিক ভাবে উচ্চারণ করতে পারবো। আমার যা খটোমটো নাম, এদেশের মানুষ কে খুব কষ্ট করে উচ্চারণ করতে হয়। আর নামের যে কতো রকম অপভ্রংশ হয়- শুনলে হাসবে।
সব কাজ নিখুঁত ভাবে করতে ভালোবাসেন এলিজাবেথ। স্কুলের শিক্ষিকা। বাচ্চাদের সাথে সাথে সবাইকে কিছু না কিছু শিখিয়েই চলেছেন।
সুমনা কে শেখান -কেউ যদি তোমাকে নিমন্ত্রণ করেন তুমি তাকে বলবে -আপনি নিমন্ত্রণ করাতে আমি খুব সম্মানিত বোধ করছি।
কারো বাড়িতে গিয়ে তার আদব কায়দা পর্যবেক্ষণ করবে। তাহলে ই তুমি শিখতে পারবে কিভাবে চা পরিবেশন করতে হয়। কিভাবে মুখে শব্দ না করে খেতে হয়। খাবার সময় কাঁচের প্লেটে কাঁটা চামচ আর ছুরি এমন ভাবে টাচ করবে যাতে টুং টাং শব্দ না হয়। বাড়ি ফিরে ফোন করে বলবে - আপনার আতিথেয়তা আমার খুব ভালো লেগেছে। খাবার গুলো খুব সুস্বাদু ছিল।
সুমনার বাড়িতে একজন অতিথি এসে রাতে থাকবেন। সুমনা আমাদের দেশের প্রথা অনুযায়ী সবচাইতে বড় ঘর টা, সব চাইতে ভালো বিছানা বালিশ, লেপ কম্বল দিয়ে ঘর সাজাতে ব্যস্ত, এমন সময় এলিজাবেথ এসেছেন। তিনি সব দেখে শুনে চোখ কপালে তুলে বললেন - তুমি তোমার বেডরুম ছেড়ে দিচ্ছো কেন? কখনো এমন টা করবে না। অতিথি কে গেস্ট রুমে থাকতে দাও।
সুমনা কিন্তু কিন্তু করে বলে - আমাদের গেস্ট রুম টা যে বড়ো ই ছোট। তেমন সাজানো নয়।
এলিজাবেথ বলেন - তা হোক। গেস্ট রুমে ই তুমি গেস্ট কে থাকতে দেবে। তিনি তো জেনে শুনেই আসছেন যে তোমাদের ছোট বাড়ি।
সুমনা পরে দেখেছে এখানে কেউ গেস্ট কে নিজের বেডরুমে শুতে দেয় না। সুমনা বলে- এটা আমার কাছে খুব অস্বস্তিকর লাগতো। দেশের বাড়িতে অতিথি কে বেডরুম ছেড়ে দিয়ে কতো সময় আমরা সোফায় শুয়েছি। মেঝেতে বিছানা করে শুয়েছি। এটা ওরা ভাবতেই পারে না।
এলিজাবেথ খুব ফটো তুলতে ভালবাসেন। বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে গিয়ে ফুলের ঝাড়ের পাশে দাঁড় করিয়ে সুমনা র ফটো তুলে বলেন - তোমার বাবা মা কে ছবি টি পাঠিয়ে দাও। তারা খুব খুশি হবেন।
সুমনার বাবা মা ছবি পেয়ে খুব খুশি হয়ে এলিজাবেথ কে লিখেছেন " ওগো আমাদের বিদেশিনী কন্যা"। সেই চিঠি পেয়ে এলিজাবেথ আনন্দে আত্মহারা। তার পর থেকে প্রায় ই সুমনা র বাবা মায়ের সঙ্গে তার পত্রালাপ চলতো। চিঠিপত্র লিখতে এবং চিঠির উত্তর পেয়ে এলিজাবেথ রোমাঞ্চিত হতো। এতো তার চিঠির প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা।
এলিজাবেথরা ছোট বেলা য় জাহাজে করে সপরিবারে হলান্ড থেকে এই দেশে এসে বসবাস করতে থাকেন।আর তাদের নিজেদের দেশে ফেরা হয় না। স্বদেশ ছেড়ে আসার মর্মবেদনা তিনি হয়তো কোনো দিন ভুলতে পারেন নি বলেই বহিরাগতদের প্রতি তিনি চোরা টান অনুভব করতেন। বুঝতে পারতেন দেশ ছেড়ে এখানে এসে ওদের ও হয়তো তার মতো ই মনোবেদনা হয়।
এলিজাবেথ খুব সরল মনের মানুষ ছিলেন। তাই তিনি সুমনাকে প্রশ্ন করতে পেরেছেন - সুমনা, তুমি তো কতো বড়ো বড়ো লোকের বাড়িতে বেড়াতে যাও। তাদের কতো বড়ো বাড়ি, গাড়ি। সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র। ফ্রিজ, টিভি, ওয়াশিং মেশিন। এগুলো দেখে তোমার হিংসে হয়? মনে হয় - আমার কেন নেই?
সুমনা বলে - এক দম না। আমার কোনো হিংসে টিংসে হয় না।
- জানো, আমার খুব হয়। জানি, হওয়া উচিত নয়, তবু হয়।
এলিজাবেথ খুব সুস্থ নন। তার ইঞ্জিনিয়ার স্বামী ও অসুস্থ। তবু তার বাড়িতে গেলে খুব আদর যত্ন করে চা, কফি খাওয়াবেন। সুন্দর সুন্দর দামী প্লেটে খাবার পরিবেশন করবেন। গ্রামোফোন রেকর্ডে গান চালাবেন।
নিজের বিয়ের কবেকার সেই কনের সাজে সজ্জিত ফটো দেখাবেন। বিয়ের পোশাক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাতে খুব ভালবাসেন। আসলে এই অছিলায় নিজের রঙিন সোনালী দিন গুলি তে স্মৃতির সরণি বেয়ে ঘুরে আসেন।
এলিজাবেথের একটি কন্যা। তিন পুত্র। কন্যাটি অতি শৈশবাবস্হায় অসুস্থ হয়ে মারা যায়। এই শোক এলিজাবেথ কে ভয়ানক ভাবে ভেঙে দিয়েছিল। কন্যার মৃত্যু দিবসে সারা দিন চুপ করে কন্যার সমাধিতে ফুল দিতেন। সাজাতেন। না খেয়ে বসে থাকতেন। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে স্বামী পুত্র রা গিয়ে জোর করে ধরে ঘরে ফিরিয়ে আনতো। সেই রাতে ও এলিজাবেথ এক ফোঁটা জল স্পর্শ করতেন না।
তিন ছেলে মাকে অসম্ভব ভালোবাসে। ও দেশে সচরাচর এমন টা দেখা যায় না। ছেলেরা একটু বড়ো হলেই বাড়ি ছেড়ে আলাদা বাড়ি তে থাকতে শুরু করে।
নিজের রোজগার নিজেই ব্যয় করে। কিন্তু বোনের শোকে মাকে শোকাতুর দেখেই হয়তো এলিজাবেথের তিন পুত্র স্নেহ, প্রেম, মায়া, মমতা দিয়ে মাকে সর্বদা ঘিরে রাখতো।
এলিজাবেথের এক ছেলে গোয়ার মেয়েকে বিয়ে করায় এলিজাবেথ ভীষণ গর্বিত। সুমনা কে ডেকে ডেকে বলতেন - সুমনা, তোমাদের দেশের মেয়ে। তোমার মতো ই ভালো।
সুমনা যখন দেশে আসতো, এলিজাবেথ সুমনাকে বাবা, মা, দিদি, দাদা, বৌদি সবার জন্য আলাদা আলাদাভাবে গিফট পাঠাতেন। সুমনা ফিরলে দেশের গল্প শুনতে চাইতেন।
গল্প করে সুমনা বলেছে- বাবা মায়ের বিছানায় বসে আমরা ভাই-বোনেরা মিলে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে বাবা মা কে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়তাম।
শুনে এলিজাবেথ মহা বিস্মিত! তোমরা বাবা মায়ের বেডরুমে ঢুকতে? তাদের বেডে বসতে? কেন? তাদের প্রাইভেসি নেই? তোমরা প্রাইভেসি কে রেসপেক্ট দাও না?
সুমনা বলে - সে কি বিপদ। ওকে কি করে বোঝাই আমাদের দেশের সিস্টেম টাই অন্য রকম। অনেক বড়ো হয়ে ও আমরা বাবা মায়ের কোলে কাঁখে ঝুলে থাকি। দুই বোন বা দুই ভাই এক বিছানায় ঘুমাতাম। বললে ওরা আমাদের কি ভাবতো কে জানে? ওদের এক ফালি বিছানা। কিন্তু সবার আলাদা আলাদা। ঢালাও বিছানায় ঠাকুমা দিদিমার গায়ে পা তুলে দিয়ে শোয়ার যে কি আনন্দ সে এদেশের অভাগা গুলো জানতেই পারলো না।
অথবা বিয়ে বাড়িতে, এক মশারীর নীচে আত্মীয়, অনাত্মীয় এক সাথে।
মানসিকতার দিক দিয়ে দুস্তর ব্যবধান। কে ঠিক, কে ঠিক নয় - এই বিতর্কে যেতে চাই না। শুধু বাস্তব টাই তুলে ধরলাম।
এলিজাবেথ সুমনাকে সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে শেখাতেন। সুমনাকে যথাসম্ভব ত্রুটি বিচ্যুতি এড়িয়ে চলতে সাহায্য করতেন।
কোনো ভারতীয় মুভি এলে দেখাতে নিয়ে যেতেন। সুমনা কি সে একটু আনন্দ পাবে সেদিকে তার সজাগ দৃষ্টি।
এলিজাবেথ টিউলিপ ফুল খুব ভালোবাসতেন। টিউলিপের পাশে সুমনার কতো ছবি যে তুলতেন তার ইয়ত্তা নেই। ছবি তুলে আবার সেগুলো বাঁধিয়ে সারা বাড়িতে সাজিয়ে রাখতেন।
এলিজাবেথ বই পড়তে ভালোবাসতেন। নতুন বই কিনেই সুমনাকে ডেকে নিয়ে বাগানের সবুজের মাঝে চেয়ার পেতে বসে বলতেন - আমি পড়ছি। তুমি শোনো। অথবা তুমি পড়ো। আমি শুনছি। বই পড়া হয়ে গেলে বইয়ের চুল চেরা বিশ্লেষণ।
একটু বয়স হয়ে গেলে অসুস্থ এলিজাবেথ কেমন যেন ঝুঁকে পড়েন। ছয় ফীট লম্বা শরীরটা যেন আর টানতে পারছেন না। লাঠি হাতে ঠুক ঠুক করে চলা ফেরা করেন।
অসুস্থ স্বামী অসুস্থ স্ত্রীর খুব সেবা যত্ন করতেন। আবার স্বামী যখন অসুস্থ হয়ে শয্যা নিতেন, স্ত্রী রোগশয্যা ত্যাগ করে স্বামীর পথ্য তৈরি করতেন। ফলের রস খাওয়াতেন। জামা কাপড় পাল্টে দিতেন। গরম জলে গা মুছিয়ে দিতেন। সারা গায়ে লোশন লাগিয়ে দিতেন।
এই সব সময়ে প্রতিবেশীরা এসে খুব সাহায্য করবে - এটাই এখানকার প্রথা। এলিজাবেথরা কারো সাহায্য নিতে চাইতেন না। বলতেন - যতোদিন পারছি ততোদিন অন্যের সাহায্য কেনো নেবো। অশক্ত হলে তখন তো এই সাহায্য নিতে ই হবে। প্রতিবেশীদের সাহায্যের হাত ফিরিয়ে দিতেন অবশ্যই অত্যন্ত বিনয়ের সাথে।
সুমনা বলে - হরদম ডিভোর্স হওয়া দেশে এমন প্রেমিক দম্পতি বিরল। এদের দেখার পর কিভাবে বলি - নিউজিল্যান্ডে প্রেম নেই?
পর্ব - ২২
পাহাড় পর্বত সমুদ্র নদী ফুলের সম্ভার, ফলের প্রাচুর্য পশু পাখি নিসর্গ প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য বর্ণনা করা যায় কিন্তু চাক্ষুষ উপভোগ না করলে সম্যক জ্ঞান অর্জন করা যায় না।তেইশ বছরের অভিজ্ঞতা মাত্র কয়েক পাতা জুড়ে লিখলে জীবন খাতার প্রতিটি পাতা জুড়ে উত্থান পতনের রোজনামচা, কতো নোনা জলের দিন লিপি,তার প্রতি সুবিচার করা হয় না। তবু সুমনা আর তপনের মুখে মুখে বলা কথা কাহিনী বিধৃত করেছি নিজের মতো করে। আমার অনুরাগী পাঠকেরা ও আমার সাথে সাথে পরিভ্রমণ করে এলেন নিউজিল্যান্ডের সৌন্দর্য মন্ডিত বালুকা বেলায়, গ্রাম, শহর, শহরতলির ফল বাগিচার আনাচে কানাচে।
ফলের ভাঁড়ারে উপচেপড়া দেশ পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠবে এতো জানা কথা। টুঁই পাখি, থ্রাস পাখি, black bird আর ও কতো নাম না জানা পাখি নেচে নেচে বেড়াচ্ছে সারা উঠোন জুড়ে। কিন্তু সুমনা সব চাইতে বেশি খুশি হয়েছিল চড়াই পাখি দেখে। এক দম আমাদের দেশের মতো পাখি। চমকে উঠে সুমনা ভেবেছিল ওর পেছন পেছন চলে এলো নাকি?আদর করে জিজ্ঞেস করেছিল - ও পাখি, তুমি বাংলা বোঝ? বাংলায় কথা কইতে না পেরে আমি হাঁফিয়ে উঠেছি গো। আমার সঙ্গে বাংলায় তুমি গল্প করবে? দেশের কথা, আমার আপন জনেদের কথা।
এক দিন হাততালি দিয়ে হেসে বলে উঠেছিল - চড়াই পাখি বারোটা। ডিম পেড়েছে তেরোটা। একটা ডিম নষ্ট। চড়াই পাখির কষ্ট। ও চড়াই, ডিম নষ্ট হলে তোমার খুব কষ্ট হয় বলো? হবেই তো। তুমি যে মা। সব মায়েরা তাদের সন্তানদের জন্য কষ্ট পায়।
পাখি রা সবার আগে টের পায় কোন গাছের ফল পেকেছে। আর পাখিদের আনাগোনা দেখে বাগানের মালিক টের পান এবার পাকা ফল পাড়ার সময় এসে গেছে। ফল পাড়ার সময় টাকে Picking Season বলে। এই সময় সব অল্প বয়সী ছেলে মেয়ে রা দল বেঁধে নেমে পড়ে ফল পারার জন্য। পকেট মানি জোগাড় করার জন্য। বিদেশ থেকে ও অনেক স্টুডেন্ট কিছু রোজগার করার জন্য এখানে চলে আসে।
ম্যাকপাই পাখি আমাদের দেশের দাঁড়কাকের মতো দেখতে। স্বভাব টাও। বাচ্চাদের হাতে খাবার দেখলে ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে ছুট।
নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত পাখি হলো আলবাট্রস পাখি ( Albatross). এদের পৃথিবীর বিস্ময়কর পাখি ও বলে। দক্ষিণ মহাসাগর ও উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের আকাশে এদের উড়তে দেখা যায়। এরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাখি। বিশালাকার ডানা প্রসারিত করে একটানা দশ/ বারো দিন এরা আকাশে ভেসে বেড়াতে পারে। এরা ডানা ভাঁজ করতে পারে না। এরোপ্লেনের ডানার মতো ডানা মেলে রাখে।
এরা বহু বছর বাঁচে। এক সঙ্গিনীর সঙ্গে জীবন যাপন করে। ডিভোর্স অথবা পুনর্বিবাহে এদের রুচি নেই। কথিত আছে এক নাবিক একটি উড়ন্ত আলবাট্রসকে গুলি করে হত্যা করেছিল। তার পর থেকে নাবিকেরা উড্ডীয়মান আলবাট্রসকে দেখলেই নাকি জাহাজের কোনো না কোনো নাবিকের মৃত্যু হয়। তাই নাবিক দের কাছে আলবাট্রস পাখি দেখা আতঙ্কের ব্যাপার। এটি উপকথা মাত্র। লোকের মুখে মুখে প্রচার করা। ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত নয়।
এখন সবচেয়ে বড় জীবিত আলবাট্রস পাখি টির নাম উইজডম। ছেষট্টি বৎসর বয়সী পাখিটি সম্প্রতি মা হয়েছেন। তার একটি ডিম চুরি হয়ে গেছে। তাই নিয়ে সারা নিউজিল্যান্ড তোলপাড়। সুমনা বললো - স্কুলে বের হবার আগে টিভিতে খবর দেখছিলাম। দেখলাম সবাই এই ডিম খুঁজতে যুদ্ধ কালীন তৎপর হয়ে ওঠেছে। অত্যন্ত মহার্ঘ এই পাখির ডিম। বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে এটি একটি বিরল প্রজাতির পাখি।
আর একটি কথা না বললেই নয়। সমগ্র নিউজিল্যান্ডে একটি ও সাপ নেই। জল জঙ্গল ঝোপ ঝাঁড় আছে অথচ একটি সাপ ও নেই এটা খুবই বিরল ঘটনা। হয়তো নিউজিল্যান্ডের জলবায়ু সাপেদের পক্ষে অনুকূল নয়।প্রতিবেশী দেশ অষ্ট্রেলিয়ায় অজস্র বিষধর সাপ। অনেকে ঐ দেশ থেকে এই দেশে সাপ আনার চেষ্টা করেছে কিন্তু কাস্টমস আটকে দিয়েছে।
নিউজিল্যান্ডে বাইরে থেকে কোনো ফল, খাবার, পশু পাখির শরীরের অংশ এমন কি ফুল পর্যন্ত আনতে দেয় না।
একবার কোনো এক বিদেশী পরিবার খুব গোপনে কাঁচা মাংস নিয়ে এদেশে এসেছিল। কাঁচা মাংসে তৈরি হওয়া ব্যাকটেরিয়া বিপুল আকার ধারণ করে এমন ভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে যে বাগানের পর বাগানের ফল সব নষ্ট হয়ে যায়। কোনো ফল রপ্তানি করা যায় নি বলে দেশের অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়েছিল। সেই থেকে কড়াকড়ি আরো বেড়ে গিয়েছে।
প্রথম প্রথম সুমনা বুঝতে পারতো না। বাড়ি থেকে অনেক খাবার দিয়ে দিত। কাস্টমসের লোক জন সেগুলো ধরে ফেলে দিতেন অথচ রান্না করা খাবারে নিষেধাজ্ঞা নেই।কারণ রান্না করা খাবারে ব্যাকটেরিয়া থাকে না।
নিউজিল্যান্ডের ভেতরে অনেক অনেক ছোট ছোট গ্রাম আছে যেখানে বিশেষ বিশেষ জিনিস বা পশু পাখি পাওয়া যায়। সেই সব গ্রামে ঢোকার মুখে Welcome লেখা আছে আর তার সঙ্গে ছবি আঁকা আছে। যেমন হরিণ, খরগোশ, ভেড়া, ষাঁড়। অর্থাৎ ওখানে গেলে এই গুলো দেখা যাবে। এখানে খুব গামবুট তৈরি হয়। শহরতলির প্রবেশদ্বারে বাঁশ কাঠ দিয়ে বিশাল বড়ো এক গামবুট তৈরি করে রাখা।
এখানে প্রচুর ফার্ম হাউস। সেখানে সারা বছর ধরে বিভিন্ন রকমের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। টিকিট কেটে সেই সব প্রতিযোগিতা দেখতে হয়।
যেমন কে কতো তাড়াতাড়ি ভেড়ার গায়ের পশম কাটতে পারবে। ভেড়ার গায়ে এতটুকু ব্যথা যেন না লাগে। ভেড়ার পশম থেকে উল তৈরি করে। এছাড়া কাঠ কাটার প্রতিযোগিতা হয়। কে কতো তাড়াতাড়ি কাঠ কাটতে পারবে এবং কতো টা নিপুণতার সাথে।
আবার মেশিন দিয়ে গরু দোয়ানো হয়। তার ও প্রতিযোগিতা আছে। পাইপ বেয়ে দুধ ড্রামে এসে পড়বে। কে কতো তাড়াতাড়ি ড্রাম ভর্তি করতে পারবে।
এই সব প্রতিযোগিতা ই শিক্ষা মূলক। ভবিষ্যত নাগরিকদের জীবিকা নির্বাহের পথ তৈরি করে দেওয়া। শিশুদের মাঝে মাঝেই ট্রেনে করে বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়। পাঁচ বছর বয়সী দের ট্রেনে বাসে টিকিট লাগে না। হৈ চৈ করতে করতে নগর ভ্রমণ করে তাদের কি আনন্দ।
সব গল্প শুনে মনে মনে এটাই উপলব্ধি করলাম মানুষ যখন যেখানে থাকবে তখন সেটা ই তার দেশ। যে দেশে বসবাস করছি সেই দেশের মাটিকে যদি ভালো না বাসি, সেই দেশের মানুষ কে যদি আপনার করে নিতে না পারি তাহলে কখনোই বিদেশের মাটিতে নিজেকে প্রোথিত করতে পারবো না। বিদেশে বাস করে স্বদেশের জন্য হাহুতাশ করলে সে অবস্থাই হবে - রাত্রে যদি সূর্য শোকে ঝরে অশ্রু ধারা সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা।
স্বদেশ সব সময়ই থাকে মানুষের বুকের গভীরে, শোণিত কণিকার বিন্দুতে বিন্দুতে।
স্বদেশের মাটিতে ফিরে মাথা ঠেকাবার জন্য মন প্রাণ যখন উথালপাথাল করে সেটাই হলো দেশপ্রেম।
দিন যাপনের প্রাত্যহিকতার মাঝেই হঠাৎ করে শেকড়ে টান লাগে। সব কিছু ছেড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিকট চিৎকার করে মনে হয় ছুটে চলে যাই স্বদেশের মাটিতে।
কি আছে সেখানে?
জানা নেই।
কি পাবো সেখানে?
জানি না।
শুধু ভিটের টান। শেকড়ের সন্ধান।
বন্ধুরা ফোনে বলে - ওরে, আসিস না রে।
বিদেশে খুব ভালো আছিস। সব পেয়েছির দেশে আছিস। আমাদের নেহাত কোথাও যাবার জায়গা নেই তাই এই পোড়া দেশে পড়ে আছি।
এখানে শিক্ষা নেই। স্বাস্হ্য নেই। চাকরি নেই। টাকা পয়সা নেই। আছে শুধু বাবা মায়ের দীর্ঘ শ্বাস। হতাশা।
বেকারত্বের জ্বালা বুকে নিয়ে আমরা সবাই প্রাণে বেঁচে আছি। মনে মরে গেছি। শিক্ষিত বেকাররা মাথা কুটে মরে। ডোমের চাকরি পাবার জন্য MA Pass শিক্ষিত যুবা দরখাস্ত পেশ করে। এই জীবনের কি মূল্য আছে? দেশের মাটি কি খাওয়া যায়? তাতে পেট ভরে? ছেলে রা চাকরি পাচ্ছে না বলে জীবন সঙ্গিনী রূপে যাকে নির্বাচন করে রেখেছিল তার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। কতো মেয়ে বিবাহ যোগ্যা কিন্তু পাত্র নেই। শুধু টিঁকে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। শিক্ষিত বেকাররা সবাই বিদেশে চলে যেতে চায় শুধু দুই বেলা দুমুঠো সম্মানের ভাত খাবার জন্য।
সুমনা বলে - হ্যাঁ গো। সেই নদীর এপার আর ওপারের গল্প। ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। ওদেশ থেকে কিছু নিয়ে তো আসি নি। ভেবেছি যদি বিদেশ ভালো না লাগে তাহলে বাড়ি ফিরে যাবো। স্হায়ী চাকরি আছে। স্হায়ী বাসস্থান আছে। আমার আর ভাবনা কিসের? কিন্তু আর ফেরা হয় নি। এখানকার মানুষ জন এমন ভালোবাসার বন্ধনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো যে সে বাঁধন ছিন্ন করি আমার সাধ্য কি! তুমি একবার এদেশে এসে দেখো। আমি তোমাকে এথেনা, ভিক্টোরিয়া, ক্রিশ্চিনা, এলিজাবেথের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দেবো। দেখবে তুমি শুধু মাত্র সুমনার বন্ধু, সুমনার প্রিয় পাত্রী জেনে কি আদর, যত্ন আত্তি আর সমাদরটাই না করে। তেইশ বছরে বহু মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছি গো। মনে করি এটা ই তো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। সব চাইতে বেশি সাফল্য। নয়তো মাঝে মাঝেই মনে হয় মানুষের এক জীবনে যা যা পাওয়ার ছিল তার অনেক বেশি ই তো আমি পেয়েছি। দেখো আমার স্বামী পুত্র দুজনেই কলেজে পড়ায়, আমি বাচ্চাদের পড়াচ্ছি। তিন জনের উপার্জনের যোগফল ঈর্ষণীয়। জিনিসপত্র, বিলাস দ্রব্য, জীবন ধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন সব আমার আছে। তাও কখনো কখনো মনে হয় বস্তুগত প্রাণহীন জিনিসের ঢিবির ওপর বসে আছি। যা আমাকে অমৃতের সন্ধান দেবে না সেই উপচীয়মান বস্তুতে আমার কি প্রয়োজন? কুসুম, তোমার মন নাই? বয়ে বেড়াচ্ছি এই প্রশ্ন। জিনিসপত্র আর ভোগ্যবস্তুই কি সব? মন কি চায় মন কি জানে? কখনো মনকে বুঝাই - এই তো, বেশ ভালো আছি। আবার কখনো কখনো অন্তরাত্মা আর্তনাদ করে বলে- হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোন খানে।
তবে আমার উপলব্ধি বলে-এদেশ ওদেশ নয়, সব দেশের মানুষ ই এক রকম। সবাই ভালোবাসার কাঙাল। সবাই মানুষ কে ভালো বাসা দিয়ে আপনার করে নিতে চায়। সবার ভালোবাসা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা পেয়েছি বলেই তো এতো গুলো বছর আত্মীয় পরিজন বর্জন করে বিদেশ বিভুঁইয়ে কাটিয়ে দিতে পারলাম। এটা কি কম কথা? ফিরে তো যাই নি। কেন? প্রয়োজন অনুভব করি নি। তাই তো। ভাষা আলাদা। রীতি নীতি আলাদা। কিন্তু সবটাই বাহ্যিক। অন্তরে আমরা সবাই সমান। মনে পড়ে - নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান /বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান।
বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ আমাদের শিরায় শিরায়।
আমরা সবাই মহা মিলনের মন্ত্রে দীক্ষিত।
সবার ওপরে মানুষ সত্য- এই হলো আমাদের দর্শণ।
তার পরেও আমরা সবার সঙ্গে মিলে মিশে একাত্ম হয়ে থাকতে পারবো না? তা কি হয়?
এই বেশ ভালো আছি গো। তোমার লেখার মধ্য দিয়ে নিউজিল্যান্ড কে যারা দেখেছেন তাদের সবাইকে এই বার্তা তুমি জানিয়ে দিও আর সুমনাকে যারা ভালো বেসেছে তাদের সবাইকে, আমার পক্ষ থেকে তুমি আমার ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা জানিও।
সবাই যেন নিজ নিজ জায়গায় ভালো থাকেন - এই কামনা করি।
।। সমাপ্ত ।।