ভ্রমণ ও দেশ-বিদেশ

ক্যালিফোর্নিয়ার ডায়েরি (দ্বিতীয় পর্ব) [ধারাবাহিক]



অনসূয়া চন্দ্র


অদ্ভুত ওয়েদার নেমেছে এ পৃথিবীতে। ভিডিও কলে বাড়িতে দেখছি,প্রচন্ড গরমে, তীব্র দাবদাহে লোকে হাঁসফাঁস করছে। এক মুহুর্ত স্বস্তি নেই। আবার এদেশে স্কুলে স্কুলে সামার ক্যাম্পের আয়োজন শুরু হলেও সামারের দেখা নেই।আকাশ অংশত মেঘলা। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। বাচ্চা-বয়স্ক নির্বিশেষে সর্দি-কাশি লেগে আছে।

ক্যালিফোর্নিয়ায়, বছরের এ সময়টা হয়ে ওঠে বেড়াতে যাওয়ার আদর্শ সময়। রোদেলা দিনে, দুরন্ত হাওয়ায় স্বল্প পোশাকে, প্রশান্ত মহাসাগরের বিচে, পাহাড়ের কোলে বেশ ভিড় জমে প্রত্যেক উইকেন্ডে।

এমনই এক উইকেন্ডে আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম সমুদ্র থেকে একটু দূরে। পাহাড় আর হ্রদে ঘেরা ম্যামথ লেকস নামক ছোট্ট শহরে। আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে প্রায় ৬ঘন্টা দূরে এই জায়গায় আমরা রওনা দিলাম শুক্রবার বিকেলে।সঙ্গী দুই বন্ধু-ফ্যামিলি। একসাথে যাওয়ার জন্য একটা সাত সিটের গাড়ি বুক করা হল।গান,গল্প,কফি,চিপস সহযোগে যাত্রা শুরু হল।প্ল্যানমাফিক ৪ঘন্টা ড্রাইভের পর বিশপ নামে এক জায়গায় আমরা একটা মোটেলে (হোটেলের ছোট সংস্করণ,মূলত রাত্রিবাসের জন্য) থাকলাম। পরদিন সকাল সকাল কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের পর আবার গাড়ি চলল। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই রাস্তার দুপাশে বরফাবৃত পাহাড়, কোথাও কোথাও যেন চকলেট ব্রাউনির ওপর ভ্যানিলা আইসক্রিম এর মত পাহাড়; দৃষ্টিপথ জুড়ে ছেয়ে থাকল। এবারে এই অঞ্চলে খুব বরফ পড়েছে এমনকি এপ্রিল -মে নাগাদও তা দৃশ্যমান। প্রচন্ড তুষারপাতের জন্য রাস্তাও বন্ধ থেকেছে, কোনো কোনো স্থানে কাজ চলছে তাও দেখলাম। বেশিরভাগ লেকে এসময় জল দেখা গেলেও এ বছর প্রায় সব লেকই ছিল বরফের কাঁচে ঢাকা।"মোনো "লেক অবশ্য ব্যতিক্রম। অতিরিক্ত লবণাক্ত জল হওয়ায় এই লেকে সারাবছর জল থাকে,হাঁস ও ছিল খানকতক। কাঠের পাটাতনের উপর হাঁটতে হাঁটতে এই লেকের সামনে এসে পৌঁছলাম,বসার বেঞ্চের সাথে সাথে কিছু স্মৃতিফলক ও চোখে পড়ল;যাঁরা এ অঞ্চলের উন্নয়নে অবদান রেখেছেন।

কিছুটা ঘোরাঘুরির পরে এয়ারবিএনবি থেকে বুক করা কটেজে ঢুকলাম।এই কটেজের প্রবেশপথ ছাড়া পুরোটা বরফে ঢাকা ছিল।রাতের স্বচ্ছ আকাশে অগুন্তি তারা যতটা উজ্জ্বল,চাঁদের মায়াবী আলো বরফের ওপর পড়ে কটেজ টা ততটাই মোহময়ী হয়ে উঠেছিল।

মূলত এ অঞ্চলের আকর্ষণ পাহাড়ের সৌন্দর্য দর্শন; সঙ্গে সঙ্গে তাকে জয় করা।স্নো বোর্ডিং,স্কিইই, হাইকিং এর অন্যতম বিখ্যাত জায়গা এটি।পরের দিন সকালে আমরা ম্যামথের স্কিই রিসর্টে গিয়ে এই ট্যুরের সেরা অভিজ্ঞতা লাভ করলাম।মাটি থেকে ১১হাজার উচ্চতায় গন্ডোলা (একটি কাঁচে ঢাকা রোপ ওয়ে)করে বরফাবৃত পাহাড়ের সর্বোচ্চ উচ্চতায় আসীন হলাম।হাত-পা দু লেয়ারের জামা কাপড়ে ঢাকা থাকলেও পুরো ফেটে যাবে মনে হচ্ছিল।হাওয়ার তীব্রতা ছিল বেশি। ওখানে সেলফি তোলার হিড়িক ও ভ্লগারদের ভিড়ও ছিল মারাত্মক।

উঁচু থেকে দেখছিলাম,কী অভূতপূর্ব দৃশ্য পুরো অঞ্চল যেন পেঁজা তুলোর বসতি। আরো দেখলাম, বয়সের সীমারেখা নির্বিশেষে স্কিই করে বরফের পাহাড়ের এই চূড়া থেকে ওই চূড়া নিমেষে যাতায়াত করছে সকলে।কী অদম্য তাদের সাহস,কী দক্ষতা তাদের গতিতে।

মোনো প্রজাতির কয়েক হাজার বছর আগের বাস এই ম্যামথ লেকস অঞ্চলে। শুরুতে সোনার খনির সন্ধানে শ্রমিকরা এখানে বসতি গড়লেও এখন মূলত ট্যুরিজমের ওপর এ অঞ্চলটার অর্থনীতি দাঁড়িয়ে।প্রায় ৭হাজার লোকের বাস এ স্থানে। পাহাড়ের কোলে এ স্থানে দোকানপাট কম থাকায় খাদ্যদ্রব্য বা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেশি।

এবার ফেরার পালা। তিনদিনের সফর শেষে রোববারের বিকেলে ৬ঘন্টার টানা বিরতিহীন পথ যেন হুস করে শেষ হল। স্টারবাকসের কফিও ঠান্ডা হল। একঘেয়ে দিন যাপনে,আপন করা এই পাহাড়িবরফ তার শীতলতা ও সৌন্দর্য যোগে যে মুগ্ধতা প্রদান করল; নিঃসন্দেহে তা আগামীতে জীবন রসদ যোগাবে।

।। সমাপ্ত ।।

আলোকচিত্রঃ লেখিকার কাছ থেকে প্রাপ্ত।