শরৎ এসেছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের খেলা। মেঘের মনেও ছুটির দোলা।ঠিক হলো, মহালয়ায় এবার যাব সমুদ্রে। সূর্যোদয়র সাক্ষী থাকব। প্রতিবার মহালয়ের ভোরে জলঙ্গী নদীর তীরে, গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো হয়। পথে পথে পুজোর চালচিত্র। রেডিওকে সঙ্গী করে মেয়ের প্রিয় বন্ধু অস্মিতার পরিবারকে নিয়ে মহালয়ার আগের রাতে রওনা দিলাম মন্দারমনির উদ্দেশ্যে। সারারাত জেগে থাকা। রাতের পথ আমার বড্ড প্রিয়।রাতের পথের গল্প বেশ অন্যরকম। একসময় রাতের হাইওয়ে নিয়ে লিখেছিলাম -
নিশ্চুপ রাত স্তব্ধ অন্ধকার
ঘুমের চাদরে বিষণ্ণ ফুটপাত
বৃষ্টি নেমেছে চকচকে হাইওয়ে
ধাবার উনুনে উষ্ণ শীতল ভাত।
ট্রাক-ড্রাইভার, তোমার প্রেমিকা পথ
শিশু বড় হয়ে গল্প লিখছে ভালো
তোমার উঠোনে জ্যোৎস্নার মাখামাখি
রাজপথ জুড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হয় আলো।
ডানকুনি হয়ে আমাদের গাড়ি যখন কোলাঘাট এসে পৌঁছালো তখন রাত গভীর। কত না মানুষ ধাবাগুলিতে। বাঙালির বেড়ানোর নেশা দেখলে একটু অবাক হন বোধহয় অন্য রাজ্যের মানুষ। বাঙালির ছুটি পেলেই হল - দীঘা কিংবা দার্জিলিং। সমস্ত বাঙালি রেকর্ড ব্রেক করতে চান। চারটে বাজলো রেডিয়োতে শুরু হলো মহিষাসুরমর্দিনী। মহালয়ার ভোরে রেডিয়ো শোনা কোনোদিনই মিস হয়নি। এবার পথেই। হালকা শীতের আমেজ। চাঁদ আকাশে। রেডিয়োতে 'বাজলো তোমার আলোর বেণু'। পথের ভিডিও করছিলাম। পুলিশ দাঁড় করিয়ে দিল গাড়ি। আমার হাতে রেডিয়ো চলছে, মহালয়া, রাতে টহল দিচ্ছে তারা, জানিনা কেন থামালেন। বোঝা গেল আমার ভিডিওতে আপত্তি হাতে। রেডিয়ো দেখে অবাক হয়েছেন। সাউন্ড বাড়াতে বললেন।আজকাল আর দেখাই যায় না এসব। নতুন পথটা দেখিয়ে দিলেন। ভোরের আলো ফোটেনি তখনও। কন্টাই থেকে নতুন মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে পুরুষোত্তমপুর হয়ে আমরা পৌঁছলাম মন্দারমণি। বুঝতে অসুবিধা হলো সমুদ্রকে পাশে রেখে চলেছি আমরা। নির্জনতাকে উপলব্ধি করতে হলে, সমুদ্রকে দু'চোখ ভরে দেখতে হলে মন্দারমণিতে যেতে হবে। যেহেতু মন্দারমণিতে হোটেল বা রিসোর্ট ভাড়া একটু বেশি তাই মন্দারমণি বেশ ফাঁকা এখনো। হোটেলের বারান্দায় বসেই সমুদ্রকে আলিঙ্গন করতে চাইলে আসতে হবে মন্দারমণি। এই সমুদ্রসৈকত আমাকে বারবার আকর্ষণ করে। আমাদের নির্ধারিত রিসোর্টে চেকিং টাইম যেহেতু দুপুর বারোটা তাই খুব ভোরে পৌঁছানোর পর একটা অতিরিক্ত রুম নেওয়া হল,লাগেজ রেখে নেমে পড়লাম সমুদ্রে। আকাশে তখনও রাত্রির নেশা, শীতল জলে পা ছোঁয়াতেই অন্যরকম অনুভূতি,সারা রাতের ক্লান্তি দূর চলে গেল। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল। মেঘের আড়াল থেকে সূর্য একটু একটু করে মুখ বের করতে থাকলো। রঙিন আভায় আকাশ ভরে উঠলো। গরম গরম চা নিয়ে হাজির হলেন একজন। তর্পণে ব্যস্ত কিছু মানুষ।ট্রলিতে করে ডাব নিয়ে হাজির শিবশঙ্কর। ওর সঙ্গে গল্প হল অনেক। পরে ওর কথা বলছি। হোটেলের ঘরে ফিরে কিছুটা সময় রেস্ট। তখন জোয়ার এসে গেছে।ঢেউ এসে ধাক্কা দেয় রিসোর্ট-লাগোয়া বোল্ডারে। তারপর ব্রেকফাস্ট ছেড়ে সমুদ্র স্নান। জল আবার নেমে গেছে অনেকটা,সূর্যের কিরণ ম্লান হলে ভালোই।মেঘলা আকাশ আর সমুদ্র আমাদের মন ভোলালো। বিস্তৃত সমুদ্রসৈকতে হেঁটে চলার মধ্যে আনন্দ অপার। মাঝে মাঝে সূর্য উঁকি দেয় মেঘের আড়াল থেকে।সমুদ্রে জলের ঝিকিমিকি। সমুদ্র নিয়ে কতনা কবিতা লিখেছেন কবিরা। 'সমুদ্র স্নান' কবিতায় বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন -
"দ্যাখো না সমুদ্র তোমার কী করে,
এই লোনা নীল জল আর চাবুকের মত হওয়া।
যেমন শঙ্খ আর চকচকে ঝিনুক
এই ঢেউয়েরা হাজার বছর ধরে আঁকে
কত অফুরন্ত রঙে, কত বিচিত্র নকশায়,
বাদামি আর বেগুনি আর অপরূপ মসৃণ,
আর আঁকাবাঁকা ঢেউ-খেলনো রেখায় -
তেমনি তারা তৈরি করুক তোমার শরীরকে
শঙ্খের মত মসৃণ তোমার শরীর!
একবার নিজেকে দাওনা সমুদ্রের কাছে
তারপর দ্যাখো সে তোমাকে নিয়ে কী করে।"
এবারের মন্দারমণিতে আমাদের আবিষ্কার শিবশঙ্কর। সকালে সমুদ্র সৈকতে ওর সঙ্গে আলাপ।দুপুরে মন্দারমণিতে আমরা লাঞ্চ সারলাম শিবশঙ্করের হোটেল 'দীপ'-এ। পরম যত্নে আমাদের দুপুরের খাবার খাওয়ালো শিবশঙ্কর ও তার স্ত্রী। তাদের হোটেলটি সমুদ্রের উপরেই মাচার উপরে নির্মিত। শিবশঙ্কর ভোরবেলায় সমুদ্র সৈকতে ডাব বিক্রি করছিল এবং সে জানায় তার খাবার হোটেলের কথা। দু-তিনবার ফোন করে সে আমাদের খোঁজও নেই এবং আমরা দুপুরে তার সেই অসামান্য খাবার হোটেলে হাজির হয়েছিলাম। যেন নিকট আত্মীয়জনের হাতে খাবার খাচ্ছি আত্মীয়র বাড়িতেই। আমরা সন্ধেবেলায় আড্ডা দেবো ওর ওখানে এবং রাতের খাবারটা খেয়ে ফিরব। ওদের একমাত্র সন্তান ক্লাস সিক্সে পড়ে। ওদের সাথে আলাপ হয়ে ভালো লাগলো খুব। আপনারা এলে শিবশঙ্করের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন লাঞ্চ-ডিনার-ব্রেকফাস্টের ব্যাপারে।
বিকেলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম তাজপুর সমুদ্রসৈকত দেখতে।মন্দারমণি থেকে তাজপুর যাবার নতুন পথ নির্মিত হয়েছে।তাজপুর মোহনা হয়ে আমরা যাব। চিংড়ি মাছের ভেড়ি দুপাশে। প্রচুর জলাভূমি।মেরিন ড্রাইভ এই রোড বড়ো চমৎকার। চারপাশ ছবির মতো। সমুদ্রকে পাশে রেখেই চলা। নতুন ব্রিজ তৈরি হয়েছে। সমুদ্র দেখা যাচ্ছে প্রাণভরে মোহনায় অসংখ্য ট্রলার। জোয়ারের সময় এর রূপ আলাদা। সূর্য অস্ত যাচ্ছে তখন। চিত্রকল্প মনের ভেতরে যত্নে রাখলাম। ব্রিজের উপর থেকেই মাছ ধরার বড়শি ফেলেছে অনেকে। এতটা উঁচু থেকে মাছ ধরা যায় ভেবে অবাকই হলাম। দূরে মোহনার ধারে জাল বিছানো। ভোররাতে ট্রলারগুলি ফিরবে। সরগরম হয়ে উঠবে মোহনা।মাছের বিকিকিনি। দিঘার মোহনায় গিয়েছি অনেকবার।আঁশটে গন্ধ নাকে লেগে রয়েছে এখনো। এসে পৌঁছালাম তাজপুর। সন্ধ্যা নামছে তখন। চোখের সামনে উন্মুক্ত বিস্তৃত দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত। নির্জনতা তাজপুরকে ঘিরে। সমুদ্রের পাশ দিয়ে নতুন রাস্তা চলে গেছে শঙ্করপুর হয়ে দিঘার দিকে, তাজপুর সমুদ্রসৈকত একেবারে নিরিবিলি।ঝাউবন কমে গেলেও কিছু কিছু চোখে পড়ল। সমুদ্রসৈকতের উপরে খাবার হোটেল অনেক। সন্ধের আলো জ্বলে উঠেছে - বড়বেশি মায়াবী। হাঁটলাম বেশ কিছুক্ষণ। সমুদ্র চেহারা পাল্টেছে। আলো-আঁধারের যুগলবন্দী সমুদ্রতটে, এবার ফিরে চলা মন্দারমণি। জোয়ার এসে গেছে। আমাদের রিসোর্টের পাশেই সমুদ্র তখন অন্য রূপে। সন্ধ্যার আড্ডা হওয়ার কথা শিবশঙ্করের ওখানে। শিবশঙ্করের স্ত্রী আলো দেখিয়ে নিয়ে চলল আমাদের। সান্ধ্যকালীন আড্ডা জমে উঠলো। সমুদ্র তখন উত্তাল। পরম তৃপ্তিতে রাতের খাবার খাওয়া হল। রাতের সমুদ্র দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার পঙক্তি -
"রাতের সমুদ্র তীরে দেখা হবে রাত্রির সমুদ্র
আর কিছু নয়
জলের কিনার ঘেঁষে জলের গভীর মর্ম ছুঁয়ে
বসে থাকা হবে
শব্দ দেবে প্রতিচ্ছবি বর্ণ দেবে নিবির বন্ধুত্ব
স্বপ্নে যে-রকম"
পরের দিন সকাল থেকে সমুদ্রের ধারে। ভোর হলো, সূর্য উঠলো। সৈকত ধরে অনেকটা পথ হাঁটা - পা ভেজানো। সমুদ্রের ধারে বসেই চা পান। মেঘ করছে আকাশে, এর জন্যই বোধহয় অপেক্ষা। জোয়ার এলো তাড়াতাড়ি। জোয়ারের জলে স্নান!সম্ভব নাকি? ইচ্ছে পূরণ হল। বৃষ্টিও নামল।
রিসোর্ট লাগোয়া বাঁশের মাচার হোটেলের সিঁড়িতে বসেই সমুদ্রের ঢেউ স্পর্শ করা। কী আনন্দ! সমুদ্রের ভিতরেই এই খাবার হোটেলগুলি তৈরি হয়েছে। রিসোর্ট থেকে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে গিয়ে আবার সিঁড়ি বেয়ে সমুদ্রের গভীরে নেমে যাওয়া - সমুদ্রের ভিতরে সিঁড়িতে বসেই জোয়ারের ঢেউ স্পর্শ করা - মাথার উপর দিয়ে সমুদ্রের ঢেউ চলে যাচ্ছে,আছড়ে পড়ছে আমাদের পিছনে রিসোর্ট-সংলগ্ন বোল্ডারে। বৃষ্টি ভিজে সমুদ্রস্নান মনে থাকবে বহুদিন। ফিরতে হবে। ফেরার সময় পুরুষোত্তম বীচে অনেকটা সময় কাটল। নতুনভাবে সেজে উঠেছে এই বীচ। আধুনিক সমস্ত সুবিধা যুক্ত টৈন্ট তৈরি হচ্ছে। সমুদ্র এখানে বড় শান্ত। আসলে সমুদ্র সৈকত এখানে খুব চওড়া এবং দীর্ঘ। নিরিবিলি নির্জনতায় এখানে কাটাতে পারেন এসে। এই সমুদ্রসৈকত লাল কাঁকড়ার জন্য বিখ্যাত। পুরো সৈকতে অসংখ্য লাল কাঁকড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে, সমুদ্র সৈকতের রং বদলে দিয়েছে এরাই।
সমুদ্র সৈকতকে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে চলা আমাদের।রূপনারায়ণের বীজ পেরোতেই মনে পড়ল শরৎচন্দ্রের কথা।এই নদীর তীরেই দেউলটিতে শরৎচন্দ্রের বাসভবন।দেউলটিতে শরৎচন্দ্রের বসতবাড়িতে অনেকটা সময় কাটল আমাদের। অদ্ভুত এক অনুভূতি হল। অনেক দিনের ইচ্ছে পূরণ হল। রূপনারায়ণ নদীতে তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে।
* * * *
হাওড়া জেলার সামতাবেড় - এখানেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাসভবন। ২০০৭ সালে ঐতিহ্যভবন হিসেবে ঘোষিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের প্লেটে লেখা -
"বাংলার বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯২৬ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত এই বাড়িতে কাটিয়েছিলেন। এখানে তাঁর শেষ লেখা উপন্যাস 'বিপ্রদাস' সহ বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় ছোটগল্প ও উপন্যাস রচিত হয়েছিল। স্বাধীনতার সংগ্রামের সময় বিপ্লবীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয় হয়েআছে উঠেছিল এই আবাস"।
ঘুরে ঘুরে দেখলাম। গাইড আছেন দুজন।তারা গল্প শোনালেন অনেক। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এই বাড়ির ভূমিকা অনেকখানি। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী এই বাড়িতে এসেছেন। ফিরে যাচ্ছিলাম ইতিহাসের পাতায় ।আমার মেয়ে কথা রোমাঞ্চিত হচ্ছিল, পিছনের দরজা দিয়ে বিপ্লবীদের পালিয়ে যাওয়ার গল্প শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠারই কথা। কত গোপন বৈঠক হয়েছে এই বাড়িতে। শরৎচন্দ্রের ব্যবহার করা না না জিনিস সাজিয়ে রাখা হয়েছে খুব যত্নে। বাড়ির বাইরের গেটের দেওয়ালে লেখা রয়েছে শরৎচন্দ্রের গল্প উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি। শরৎচন্দ্রের লেখা মনের ভিতর নিয়ে রওনা দিলাম কৃষ্ণনগরের পথে।
আলোকচিত্রঃ লেখক।