বিবিধ

কৃষ্ণনগরে কাজী (প্রথম পর্ব) [ধারাবাহিক]



ইনাস উদ্দীন


[১৯২৬ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর এসেছিলেন, এনেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। কবিকে কেন এনেছিলেন তিনি? শুধুই বন্ধু বলে? প্রতিভাবান কবি বলে? মাস ছয়-সাতেক গোলাপট্টিতে থেকে কবি গ্রেস কটেজে আসেন। ঠিক কবে আসেন তিনি? জুলাই, নাকি আগস্ট? কেনই বা এলেন এই বাড়িতে? ভীষণ দারিদ্র্যের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে? অনেক কিছুই আমরা জানি না, জানাও যায় না। এখান-ওখান থেকে জোগাড় করা তথ্য আর তার সাথে খানিক অনুমান মিশিয়ে টুকরো কথার কিছু দৃশ্য সাজিয়ে তোলার চেষ্টা এই কাহিনীতে।]
 

পর্ব - ১

- কাজীদা!

- আরে, বিজয় যে! দে গরুর গা ধুইয়ে!

কাঁধের ঝোলা নামিয়ে রেখে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলেন নজরুল। 'দোলন, এই সেই বিজয়। বহরমপুর জেলে আমাদের কী আড্ডাই না হতো! বিজয়ের যেমন সুন্দর গান, তেমনি সুন্দর কথা।'

উৎফুল্ল বিজয়লাল গিরিবালা দেবীকে প্রণাম করলেন।

- হেমন্তদা যখন বললেন আপনারা কৃষ্ণনগরে আসছেন, এখানেই থাকবেন, তখন থেকে আমার ঘুম হচ্ছে না। কতদিন পর আবার কাজীদাকে দেখব। কাজীদা, তুমি কিন্তু অনেক রোগা হয়ে গিয়েছ।

গিরিবালা দেবী বললেন - ‘আর বোলো না বাবা, যমের দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে এটাই ভাগ্যি।'

পিছন থেকে হেমন্ত সরকারের গলা ভেসে এলো - ‘গল্প করার অনেক সময় পাবে বিজয়। তুমি এখন ওদের নিয়ে চলো, আর দ্যাখো কাসেম গাড়ি নিয়ে এসেছে কিনা’।

'এইতো, আমি এখানেই আছি!' বলতে না বলতেই হুড়মুড় করে সামনে এগিয়ে এলো এক বলিষ্ঠ বৃদ্ধ। হাতে চাবুক, মাথায় পাগড়ীর মতো করে গামছা বাঁধা। দাড়ি-গোঁফ চোখের ভুরু পর্যন্ত সাদা, কিন্তু গলার জোর কম নয়। ‘দাদাবাবু, তুমি ইস্টিশনে এসেছো আর আমি গাড়ি নিয়ে আসিনি, এরকম কখনো হয়েছে? লাটফারাম থেকে বার হয়ে যেদিন দেখবে আমি নাই, জানবে সেদিন কাসেম মাটির তলায় চলে গিয়েছে।

সরকার বাড়ির সব কাজে কাসেমের গাড়ি একদম বাঁধা বলেই নয়, ওবাড়ির ছোট থেকে বড় হওয়া সবার উপরে কাসেমের কর্তৃত্ব ফলানো একটা অভ্যাস। এ নিয়ে তার নিজেরও একটু অহংকার আছে। আর এই জন্য জজকোর্ট পাড়া বটতলায় কোচোয়ানদের ভিতরে একটা হিংসেও আছে। কলকাতা থেকে অতিথিরা এলে তাদের সামনে কাসেমের অভিভাবকত্ব যেন আরো বেড়ে যায়। হেমন্ত সরকার ধমক লাগালেন - ‘কথা না বাড়িয়ে জিনিসপত্র গাড়িতে তোলো’।

কাসেম আলী সব আগে হারমোনিয়ামটা কাঁধে তুলে নিয়ে রেখে আসতে গেলেন। গিরিবালা দেবীর হাত থেকে মস্ত ব্যাগটা নিয়ে বিজয়লাল সবাইকে সঙ্গে করে উঠলেন কাসেমের গাড়িতে।

স্টেশন থেকে গোয়াড়ি অনেকটাই পথ। ক্রোশ খানেক তো হবেই। তার উপর বেলা পড়তে না পড়তেই কৃষ্ণনগরে শীত যেন জাঁকিয়ে নেমেছে। পথের দুপাশে গাছ-গাছালির ছায়া, ফাঁকে ফাঁকে দুচারটে ঘরবাড়ি। অনেকটা জায়গা জুড়ে গাছপালা নিয়ে একেকটা বাড়ি। নজরুলের ভালো লাগছে বেশ।অনেকদিন পর বাতাসে কেমন একটা ভালো লাগার স্বাদ। ঝলমলে মিষ্টি রোদের সাথে ঠান্ডা বাতাসের মিশেল কেমন একটা মাদকতা ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে শরীরে। মাত্র একটা বেলা, তাতেই মনে হচ্ছে অন্য একটা জগৎ। গত কয়েক মাস ধরে হুগলির ঘরখানায় যে দুঃসহ যন্ত্রণার ঝড় বয়ে গেল - যেন একটা বিভীষিকা, একটা দুঃস্বপ্নের ঘোর। বসিরহাট থেকে ফিরেছিলেন ম্যালেরিয়া আর আমাশয় সঙ্গী করে। একদিন ভালো, তো একদিন জ্বরের তান্ডব। দুঃসহ তাপে গা পুড়ে যায়। যন্ত্রণায় মাথার শিরা ছিড়ে যাবার অবস্থা। বলতে গেলে একরকম মৃত্যুর হাত ফিরে আসা। মাসিমা একা হাতে কী করে যে এতোসব সামাল দিয়েছেন কে জানে। কলকাতার বন্ধুরা কেউ কেউ মাঝে মাঝে বরফ এনে দিত। দোলন সেই বরফজলে কাপড় ভিজিয়ে সারা শরীর মুছিয়ে দিত। তারও তো শরীরের অবস্থা ভালো না। সদ্যোজাত শিশুকে নিয়ে সেও জেরবার। জন্মাষ্টমীর দিনে ঘর আলো করে এসেছিল তাদের ভালোবাসার সন্তান আদর করে নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মহম্মদ।

বিয়ের পর কলকাতায় মুসলমান পাড়ায় ঘর মেলেনি। সাহিত্যের বন্ধুরাও ছিল একরকম মুখ ফিরিয়ে। অভিমান হয়েছিল খুব। সেই অভিমান থেকেই বোধহয় স্বপ্ন দেখেছিলেন কবি - পুত্রের মধ্যে কৃষ্ণ আর মহম্মদ একসাথে বিকশিত হোক। কিন্তু অভাগা যেদিকে চায় - চার মাস না পেরেতেই সে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। নিজেকে অপরাধী মনে হতো খুব। দোলনকে এরকম অবস্থায় রেখে বসিরহাটে না গেলেই বোধহয় ভালো ছিল। কিন্তু তাই বা কী করে হয়? কুতুবউদ্দিন ভোটে দাঁড়িয়েছে। হারা-জেতা পরের ব্যাপার, কিন্তু এই সুযোগেই তো দরিদ্র কৃষক- শ্রমিকদের কথা মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে? অনিয়ম হয়েছে খুব সেটা ঠিক। দুই সপ্তাহ ধরে গ্রামে গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছেন - কিন্তু ম্যালেরিয়ার জীবাণু তাঁকে ছাড়েনি, জাঁকিয়ে সংসার পেতেছে শরীরে। একদিকে শরীরের এই জরাজীর্ণ অবস্থা, অপরদিকে পুত্রশোকে পাথর হয়ে যাওয়া দোলনের মুখ, ধার করে ছাপাতে গিয়ে তিন-তিনটে বই বাজেয়াপ্ত, তার উপর প্রবাসীর আড়ালে একদল সাহিত্য-বন্ধুর ক্রমাগত কদর্য আক্রমণ। এরই মধ্যে হেমন্তদার আগ্রহে অতি উৎসাহ নিয়ে তৈরি হয়ে গেল 'লেবার স্বরাজ পার্টি'। কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা, কত উদ্দীপনা এই সংগঠনকে ঘিরে। কিন্তু শরীর? সংসার? ঈশ্বর বুকের মধ্যে এতো স্বপ্ন দিলেন, কিন্তু শরীরে শক্তি দিলেন কই?

আড়ালে বসে ঈশ্বর বোধ হয় শুনছিলেন। হেমন্তদার কথাগুলো যেন আশীর্বাদের মতোই নেমে এলো -

'চলো কাজী, কৃষ্ণনগরে। এই শরীর নিয়ে হুগলিতে পড়ে থেকে নিজেকে শেষ করে দেবে নাকি? সামনে তোমার কত কাজ!'

(ক্রমশ)

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।