বাঙালি এবং "....", এইরকম বহু বিষয় নিয়ে বহু লেখা চারিদিকে জমে রয়েছে। চাইলে আশেপাশের সবকিছু এবং সমস্ত বিষয়ের সাথেই বাঙালি'কে জুড়ে দেওয়া যায়। সেরকমই একটি অদ্ভুত 'বিষয়' হল - ছাদ। বাঙালির ছাদ।
চাইলেই কি ছাদ পাওয়া যায়? ওই 'ভবাপাগলা'র কথা বাদ দিতে হবে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি'তে ভবা সত্যিই পাগল। কিন্তু ভবার দৃষ্টিভঙ্গি'তে দেখলে, ভবা পৃথিবীর সবথেকে 'রইস্' ব্যক্তি। রাস্তার ফুটপাথে, পার্কের বেঞ্চে ঘুমিয়ে রাত কাটানো ভবা'র আকাশজোড়া 'ছাদ'। কিন্তু ভবাপাগলা'কে এই দৃশ্য থেকে লাথি মেরে বার করে দেওয়ার পর থেকেই, একটা বিরাট বড়- 'হাঁ'! মাথার ওপর 'ছাদ' দরকার তো! একদম একখানা ইঞ্জিনিয়ারিং মাথা দিয়ে তৈরি কংক্রিটের ছাদ। বাঙালির কাছে ছাদ হওয়াটা বেশ প্রশংসনীয় একটা ঘটনা। বটেই তো! ফিরতে ফিরতে ৭০ ছুঁইছুঁই রিকশাওয়ালা, ঠেকের সামনে চিৎকার করে বলে উঠলো," ঢালাই কমপিলিট্!" তার মানে বাড়ি তৈরি। সেইসময় রিকশার সিটে বসে, অফিসে দুপুরে টিফিনকৌটো'তে হাত ডুবিয়ে টিফিন সারা 'অমুক' বাবু ভাবতে বসবেন, "বাড়ির ছাদ?"; পাড়ার সবথেকে তাক লাগানো বাড়ি করতে গিয়ে ভাল করে আগে ছাদটা'ই ঢালাই করতে হয়েছিল। তার প্রমাণ তো রয়েইছে, রাজমিস্ত্রি'দের খাওয়ানো হয়েছিল তো মাংসভাত। দুটো আলাদা সংসার, আলাদা জীবন। কিন্তু দুই বাঙালির কাছেই 'ছাদ ঢালাই' মানে বাড়ি তৈরি।
বাঙালির কাছে ছাদ একসময় 'রান্নাঘর'ও ছিল। বাংলাদেশের চল। আগে বাড়ির বউয়েরা ইলিশ মাছের টুকরো গুলো পাথরের একটা বাটি'তে রেখে নুন, লঙ্কা, সর্ষের তেল দিয়ে ভাল করে মাখিয়ে ছাদে রেখে দিত। ছাদে রোদ খাওয়ানো হতো কয়েক ঘণ্টা প্রতিদিন। ওই ইলিশের তারপর ঝাঁঝালো 'সর্ষে ইলিশ' হত। অপূর্ব তার স্বাদ। এইরকম চলতো প্রায় দিন সাতেক।
আগে বাঙালির ঘরে ঘরে বাগান ছিল। এখন আর নেই বললেই চলে। তবে এখন 'ছাদবাগান' আছে। আর আছে সারি সারি টব। আর এই ছাদবাগানে নামে বৃষ্টি। বাড়ির ছোট ছেলে হয়তো ছুটে বেড়াতে চাইবে। ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে চাইবে। মা-বাবা আটকাবে। বাঙালির চিরাচরিত "মাথায় জল বসে যাবে!"; আসলে এটাই প্রকৃত বাস্তব না। বাবা'র মনে পড়ে, "এই ছাদেই নিজের ছোটবেলাতে আকাশে তাকিয়ে জিভ বের করে বৃষ্টির জল খেতাম...", আর মা'এর চোখের সামনে ভেসে ওঠে," বৃষ্টি এলেই ছাদে ছুটতাম, নতুন নতুন তোলা নাচটা'ও প্র্যাকটিস হয়ে যেত..."। পরম্পরা। চলতে থাকবে। বাঙালির পরম্পরা।
আগের দিনের বাংলা ক্লাসে স্যার গ্রামবাংলার লোকসংগীত পড়ালেন। সেরকম কিছুই আগ্রহ বোধহয় জন্মায়নি। নিরাশ করেনা ছাদ। একনাগাড়ে সারাদিন ধরে পাশের কোন বাড়ির ছাদ পেটানো হবে। সেই বাড়ির ছাদ অপেক্ষা করে থাকে ওই বাড়ির ছেলেটার কখন মন থমকে যাবে। থমকালো। ছেলেটা শুনলো 'ছাদপেটানোর গান'। সেই গান ছেলেটাকে দূরে, দূরে নিয়ে চলে গেছে। প্রাথমিক বিভাগের স্কুলের দিদিভাই 'দিদিমণি' হয়ে হঠাৎ হঠাৎ করে বলতো, ভয় দেখাতো। পড়া না পারলে খালি পায়ে স্কুলের ছাদে দাঁড় করিয়ে দেবে।
ছাদ মানে," মাধ্যমিকের আর এক মাস।".... ছাদ মানে," উচ্চমাধ্যমিক এসে গেল।" ছাদ মানে একটা মাদুর। ছাদ মানে এক খন্ডের টেস্টপেপারের সাত খন্ডের রামায়ণ হয়ে যাওয়া। ছাদ এভাবেই একধাক্কায় দেখতে দেখতে ছাত্রজীবনে'র দুটো বছর গিলে নেয়। সাত বছর ধরে যে প্রাচীর ছিল, হঠাৎ করে সেই প্রাচীর ভেঙে পড়ে যাবে আর ছাদ ঠেলে ফেলে দেবে। জীবনের আসল সংগ্রামের শুরু হয় এরপরই।
ক্রমশ ধীরে ধীরে, হারিয়ে যাচ্ছিল - ছাদ; অস্তিত্বে থেকেও অস্তিত্বজনিত সংকটের মুখে দাঁড়িয়েছিল - বাঙালির ছাদ। হঠাৎ করেই একদিন নেমে আসলো অতিমারি। কার্ফু থেকে শুরু হয়ে পরিস্থিতি এসে দাঁড়ালো 'লকডাউন'এ। থমকে গেল স্বাভাবিক জীবন। থমকে গেল বাঙালি। আর তখন বাঙালির আড্ডার ঠেক নেই। বিকেলের খেলার মাঠ নেই। বাঙালি তখন আরো বেশি করে একা, বেশি করে হতোদ্যম। স্বার্থপর, বাঙালি। স্বার্থপর ছিলনা সিমেন্ট -বালি-রডের 'কঙ্কাল'এ তৈরি সেই বরাবরের 'বন্ধুটা'! আবার হঠাৎ করেই ছাদের লোহার দরজা'র তালাটা খুলে গেল। কেউ কাউকে কিছু বলেনি, জানায়নি। বাঙালির বিকেলের ছাদ আবার ভরে উঠলো। পশ্চিমের পড়ন্ত বিকেলের রোদ জানিয়ে দিয়েছিল। চিৎকার করেছিল। হয়তো সেই বিকেলে সূর্য একটু দেরীতে অস্ত গিয়েছিল। আবার ছুটতে শুরু করেছিল সেই ছোট্ট ছেলেটা। তার বাবা-মা ব্যস্ত অন্য ছাদের প্রতিবেশীদের সাথে আড্ডায়। সারাদিন চাকরির জন্য পড়ে চলা 'দাদা'টা অনেকদিন পর আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে নিজেকেও উড়িয়ে দিল। আর তার উড়ানের গোপন সাক্ষী থেকে গিয়েছিল একজন, কেউ জানতে পারেনি। ছাদ হয়ে গিয়েছিল সেই খেলার মাঠ, আড্ডার ঠেক। আর আকাশ হয়ে গিয়েছিল এইসব মানুষদের 'ছাদ'।
'ভবাপাগলা' সেদিন মনে হয় খুব হেসেছিল!
এখন সবকিছু স্বাভাবিক। এখন বাঙালি ব্যস্ত। মা এখন আবার শুরু করেছে 'ছাদবাগান'। বাবা এখন রাতে খেয়েদেয়ে উঠে রোজ রাতে ছাদে হাঁটে। ছোট্ট ছেলেটা ঘুমাচ্ছে একতলায়। দোতলার ছাদ ঘর ঠাণ্ডা রেখেছে। পড়াকু দাদা'টা এখন অন্য শহরে, এক চিলতে ছাদে দাঁড়িয়ে। সবকিছু স্বাভাবিক আবার। সবাই ব্যস্ত। বাঙালি ব্যস্ত...
ছাদ কথা বলতে পারেনা। ছাদ আসলে জন্ম থেকেই বোবা। তবে মাঝেমধ্যে বড় বড় ফোঁটার সঙ্গে সজোরে শিলা বৃষ্টি হলে, ছাদ তখন তার আজন্ম লালিত কষ্টের কথা বলার চেষ্টা করতে থাকে...
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।