অত্যন্ত প্রিয় শিল্পী শ্রদ্ধেয় মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের শেষ দিককার গান প্রসঙ্গে আমাদের সুরসিক শিক্ষক মন্তব্য করেছিলেন -পাঞ্জাবীর হাতায় গিলে করলেই দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু সারা পাঞ্জাবী গিলে করা মোটেই দৃষ্টিনন্দন নয়। সত্যিই। যেসব নজরুলগীতি বা আধুনিক গান তাঁর কন্ঠলাবণ্য ও পরিবেশনায় বাংলাগানের এক একটি মাইলস্টোন,সেই গানই পরবর্তীকালে শিল্পীর সুরবিহারের প্রাবল্যে মস্তিষ্কে আঘাত করতো। গান হারাতো তার মাধুর্য।সংগীত সাত সুর ও রাগরাগিণীর সমাবেশ হলেও কন্ঠসংগীতের ক্ষেত্রে বাণীর একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে. বিশেষ করে আধুনিক বাংলাগানের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে যে গানের পদসঞ্চার শুরু হয়েছে তার ধারার সঙ্গে হিন্দুস্থানী সংগীতের ধারার একটা মূলগত প্রভেদ আছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন " হিন্দুস্থানী সংগীতে সুর মুক্তপুরুষভাবে আপনার মহিমা প্রকাশ করে,কথাকে শরিক বলে মানতে সে নারাজ - বাংলায় সুর কথাকে খোঁজে,চিরকুমারব্রত তার নয়,সে যুগলমিলনের পক্ষপাতী।" হিন্দুস্থানী সুর ও বাংলাগান সম্পূর্ণ আলাদা। এই কথাটি বাংলাগান গাইতে গিয়ে অনেক সংগীত শিল্পীই ভুলে যান।
ঘটনাটি সবচেয়ে বেশী ঘটে নজরুলসংগীতের ক্ষেত্রে। এমনিতেই নজরুলসংগীতের কোনো মান্য স্বরলিপি না থাকায় একই গানের বিবিধ সুর শোনা যায়। আট ও নয়ের দশকে কাজী সাহেবের গানের দুই দিকপাল প্রশিক্ষক শ্রদ্ধেয় সুকুমার মিত্র ও শ্রদ্ধেয় বিমান মুখোপাধ্যায়ের মতানৈক্য সর্বজনবিদিত। নয়ের দশকে রাজ্য সংগীত একাডেমিতে নজরুলগীতির প্রশিক্ষণ শিবিরে শ্রদ্ধেয় সুকুমার মিত্র "তোমার মনে ফুটবে যবে প্রথম মুকুল" গানটি শেখাতে গিয়ে সুরকার হিসেবে কমল দাশগুপ্তের কথা এবং প্রথম রেকর্ডেড শিল্পী হিসেবে মৃণালকান্তি ঘোষের উল্লেখ করে মধুমাধবী সারং রাগে যে গান শেখাচ্ছেন তার সাথে বিন্দুমাত্র মিল নেই সে সময়ে বিমান মুখোপাধ্যায়ের প্রশিক্ষণে ইন্দ্রাণী সেনের কন্ঠে বহুল জনপ্রিয় এই গানটির। আবার "এত কথা কিগো কহিতে জানে চঞ্চল ঐ আঁখি" গানটি দাদরা তালেই সমধিক প্রচলিত। কিন্তু অভিনেতা ধীরেন দাসের কন্ঠে প্রথম রেকর্ডেড এই গানটি সুকুমার মিত্র মহাশয় শেখাতেন যৎ তালে। নজরুলের গানের সুর ও তাল প্রসঙ্গে এরকম অজস্র নিদর্শন তুলে ধরা যায়। এতো গেল সুরের প্রসঙ্গ। এবার আসি নজরুলের গানের যথেচ্ছ সুরবিহারের কথায়। তিনি তাঁর গান গাইবার ক্ষেত্রে শিল্পীর স্বাধীনতাকে সমর্থন করেছেন বলেই কি "সাঁঝের পাখিরা ফিরিল কুলায় তুমি ফিরিলে না ঘরের মতো কাব্যগীতিতে ইমনের আড়াই মিনিটের আলাপ,গানের মাঝখানে যথেচ্ছ সুরবিহার করতে হবে? শুনতে শুনতে কোথায় যেন খেই হারিয়ে যায়। গানে চমক থাকে কিন্তু প্রাণ থাকেনা। রবীন্দ্রনাথ যেমন নিজেই বলেছেন যে তার গানে তিনি কোনো ফাঁক রাখেন নি,যা অপরকে ভরাট করতে হবে। বাংলা গানে রবীন্দ্রনাথের পরেই স্বকীয়তায় ভাস্বর সংগীতস্রষ্টা কাজি নজরুল। অথচ তাঁর গানের সুর তো বটেই,বাণীর সংরক্ষণেও আমরা যত্নবান হইনি। অনেক গানের বাণীই একেক বইতে একেকরকম। নজরুলসংগীতের পর্যায়ক্রমিক যে বিভাজন তাও বিভিন্ন বইতে বিভিন্ন রকম। একটি গান হয়তো কোনো বইতে ঠুংরী হিসেবে উল্লিখিত অন্য একটি বইতে সেই একই গান গজল শিরোনামে উপস্থাপিত। আমাদের দুর্ভাগ্য যে নজরুলসংগীতকে রক্ষা করার জন্য বিশ্বভারতীর মতো কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। আনমনে সৃষ্টির আনন্দে তিনি যে সব অসামান্য উপহার আমাদের দিয়ে গেছেন তাকে লালন ও ধারণ করতে আমরা কি একটু যত্নবান হতে পারিনা?
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।