১) কোথাও একটা পড়েছিলাম এই ঘটনাটা। কোথায় বা কে লিখেছেন, আজ আর মনে নেই, তবে মনে আছে সত্তর দশকের শেষ দিকের ঘটনা ছিল সেটি, কলকাতা ময়দানের সত্তর-আশির এক বিস্ময়কর ফুটবলারকে নিয়ে। ওই ফুটবলারের উপাধিই ছিল তখন পেশার তাগিদে দিল্লিতে থাকা লেখকের উপাধি। তার মা, দিদি আর ভাগ্নী হঠাৎ করে কলকাতা থেকে দিল্লি যাবার প্ল্যান করলেন পুজোর সময়। দিল্লি যাবার টিকিট পাওয়া গেলেও কলকাতায় ফেরার জন্য টিকিট পাওয়া মুশকিল হয়ে গেল, কারণ পুজো আসতে বাকি ছিল ঠিক এক মাস। যাই হোক, লেখক মরিয়া হয়ে শেষবারের মত লাইনে গিয়ে দাঁড়ালেন কীর্তিনগরে। তারিখ দেখেই গোমড়া মুখে সর্দারজী ক্লার্ক বললেন "ইয়ে তো নেহি হোগা।" তাহলে কি আর করা? লেখক সর্দারজীর কাছে ওয়েটিং লিস্টের পজিশন দেখার জন্য বললেন।
তখন সর্দারজী দ্বিতীয়বার এক ঝলক দেখে লেখকের দিকে তাকিয়ে বললেন "আপ সেনগুপ্তা হো'? লেখক ঘাড় নাড়িয়ে ইতিবাচক জবাব দিতেই আবার জিজ্ঞাসা "সুর্জিত কো জানতে হো? সুর্জিত সেনগুপ্তা?' এই নামে একজনকেই চিনতেন লেখক, তাই একটু নার্ভাস গলায় প্রশ্ন করলেন "ফুটবলার (৫০% স্টেটমেন্ট আর ৫০% জিজ্ঞাসা মিলিয়ে)?" বলার সঙ্গে সঙ্গে সর্দারজী এক গাল হেসে বললেন "আরে হাঁ দাদা ওহি সুর্জিত। কেয়া প্লেয়ার থা দাদা, হম তো ময়দান মেঁ হি পড়ে রহতে থে। এক বার ডুরান্ড মে...।" এদিকে লেখক কিন্তু সুরজিতের খেলা দেখেন নি কোনদিন, তাই বিশেষ উত্তর দিতে না পেরে হুঁ হাঁ দিয়ে কথা চালাচ্ছিলেন। তবে সর্দারজী ওসবের পরোয়া না করে এসব কথা বলতে বলতে টাইপ করছিলেন। তারপরে এক সময় হাত বাড়িয়ে বললেন "লো দাদা, আপকা টিকিট কনফার্মড।"
লেখক অবাক হয়ে তাকাতেই সর্দারজী বললেন "লেডিজ কোটা মে লাগা দিয়া দাদা। আপ বেফিকর রহো। সুর্জিত সে কভি মিলা হ্যায় দাদা?" দু'হাতে চাঁদ পাওয়া লেখক একটা আলগা মিথ্যা ঘাড় নেড়ে জানিয়ে, লাইনের থেকে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আর মনে মনে বললেন "জয় সুরজিত। জয় কলকাতা। জয় ফুটবল।
২) কলকাতার ফুটবল কি এই জাদুময়তা আজকের পরে ফিরে পাবে আর কোনদিন? জানি না। এতটাই ছিল সে জাদু যে তাঁকে ভালবাসতে বাধ্য হতেন ক্লাব সমর্থনের গন্ডী পেরিয়ে সে সময়ের সমস্ত ফুটবলপ্রেমীরা। আর কে না জানে, ভালবাসার লোককেই সবচেয়ে বেশি গালমন্দের শিকার হতে হয়।১৯৭৩য়ে বড় ম্যাচ হারা অথবা ১৯৭৪য়ে ক্লাব বদলানো অথবা ১৯৭৫য়ে পাঁচগোলের ম্যাচ, তারপরেই একটি দলের ভালবাসা বদলে গিয়েছিল তাঁর প্রতি কটূক্তিতে। একইভাবে ১৯৭৯র ব্যর্থতম মরশুম বা ১৯৮০র দল বদলানো কিংবা ১৯৮০রই ফেডারেশন কাপ ম্যাচে ভাস্কোর বিরুদ্ধে মহমেডান স্পোর্টিং দলের হয়ে খেলায় তাঁর কার্টিলেজ ছিঁড়ে যাওয়ার পরে অন্য একটি দলের ভালবাসা বদলে গিয়েছিল তাঁর প্রতি কটূক্তিতে। তাঁর খারাপ লাগলেও সহজাত ভদ্রতায় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাননি। একান্তই ভদ্রতায় মুড়ে রাখা তাঁর ফুটবল একটা সময় আমাদের প্রজন্মর “শেষ পারানির কড়ি” ছিল। যে ফুটবল আমাদের প্রজন্মকে ফলাফলের উর্দ্ধে উঠে শিল্পে বিশ্বাস করানো স্মৃতিপথ নির্মাণ করতে করতে গভীর প্রশান্তির নিরাপদ দূর্গে নিয়ে যেত। তাঁর জাদুসম ফুটবল ছিল তাঁর মতই সবসময়ে ভদ্র আর অভিজাত পোশাকে ঢাকা।
৩) ১৯৮০তে আট ফুটবলারকে মহমেডান স্পোর্টিং ছিনিয়ে এনেছিল অথবা তিনি এনে দিয়েছিলেন, এখনো জমাট বিতর্ক চালু এটা নিয়ে। ১৯৭৫য়ের শীল্ড ফাইনালের আগের দিন গায়ে অত জ্বর নিয়ে পরদিন ওই খেলা, ওই গোল কি করে সম্ভব হয়েছিল, আজও উত্তর মেলেনি এই প্রশ্নেরও। ১৯৮৩র পিয়ারলেস ট্রফির সেমিফাইনালে কেরিয়ারের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েও রবীন দাসের সেন্টার না ধরে পায়ের চেটো দিয়ে ঘুরিয়ে করা বড় ম্যাচের গোল কিভাবে সম্ভব হলো, তা নিয়েও ধাঁধা এখনো অমীমাংসিত। আসলে তাঁকে বা তাঁর ফুটবলকে কোন সিলেবাসের গন্ডীতে বাঁধা যায়নি কোনদিনই। পায়ের সোল দিয়ে টেনে ছবির মত ড্রিবলিং করা অথবা অনুশীলনে অহরহ এবং কিছু ম্যাচেও কর্ণার থেকে সরাসরি গোল করা কিংবা বন্ধুকৃত্যহেতু তিন বছর পরে অবসর ভেঙ্গে ক্লাব ফুটবলে ফেরা বা গতিতে বিপক্ষের রক্ষণভাগকে নাকানিচোবানি খাওয়ানো, তাঁর যাবতীয় ফুটবলদক্ষতাই ছিল ঐশ্বরিক। ১২ বছরের বড় টিম কেরিয়ারে ২৪টি ট্রফি (১০টি মোহনবাগানের হয়ে, ২টি মহমেডানের হয়ে আর ১২টি ইস্টবেঙ্গলের হয়ে) জিতেছেন সুরজিত সেনগুপ্ত তার অনবদ্য স্কিলের বিচ্ছুরণে, যা না পেলেও কলকাতা ফুটবল তাকে মনে রেখে দিত তার শৈল্পিক ফুটবলের জন্য। রবার্ট হাডসন থেকে খিদিরপুর হয়ে তিন প্রধানে খেলা, ১৯৭৪ এর তেহরান এশিয়াডে দেশের হয়ে খেলা, ১৯৭৮ এর ব্যাঙ্কক এশিয়াডে কুয়েতের বিরুদ্ধে অলৌকিক গোল করা, বাংলাকে টানা পাঁচ বছর সন্তোষ ট্রফি জেতানো (১৯৭৫-১৯৭৯), ১৯৭৮য়ে কলকাতায় সন্তোষ ট্রফির পুনরনুষ্ঠিত ফাইনালে মোহনবাগান মাঠে পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে ৩-১ গোলে জেতার ম্যাচে গোল করে বারপোস্ট ধরে ঝুলে পড়া, আর ওইদিনের ম্যাচের জন্য মুক্তকণ্ঠে পি কে ব্যানার্জীর (যিনি বাংলার কোচ ছিলেন না সেবার) টিপসের কাছে ঋণস্বীকার, এসব ছিল তাঁর সহজাত বুদ্ধিদীপ্ত ও শৈল্পিক ফুটবলের কোল্যাটারাল অর্জন।
৪) সেই শিল্প আসলে মাঠে লোক টেনে আনত ময়দানী বিকেলগুলোতে, সারিবদ্ধ হ্যামলিনবাসীদের মত। প্রচন্ড গতিময় এক রাইটউইঙ্গার, যিনি অনায়াসে জাদুময় ড্রিবল করতেন দু’তিনজনকে এবং গোল করতেও পিছপা হতেন না, তাকে কোনদিন ভুলতে পারে নাকি ময়দান? কলকাতা ময়দান কোনদিন ভুলবেনা যে, মাঠে এক উদাসীন সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে ফুটবলশিল্পের বিদ্যুতচমকের নাম ছিল সুরজিত সেনগুপ্ত, যিনি তার স্কিল দিয়ে বিনা আপসে আর বিনা পক্ষপাতে আলো ছড়িয়েছেন তাঁর টিমের হয়ে, যখন যেখানে ছিলেন। আজও ময়দান খুঁজে ফেরে তার সেই ফুটবল চকমকির পরশপাথর আর সেই আলো ছড়ানো ড্রিবলিং আর স্বপ্নিল দৌড়। অথচ ভারতীয় ফুটবল কর্তারা সে ভাবে কাজে লাগাননি স্পষ্টবক্তা ও আপোসহীন সুরজিতকে, এটা ভারতীয় ফুটবলেরই লজ্জা।
৫) সত্তর দশকের শেষাংশে খেলার এক পত্রিকায় তাঁর লেখা ধারাবাহিক "এসো আমরা ফুটবল খেলি" তখন ছোট ছোট ফুটবল শিক্ষার্থীর অবশ্যপাঠ্য ছিল।পরবর্তীতে তাঁর আত্মজীবনী "ব্যাকসেন্টার" ও সাড়া ফেলে দিয়েছিল ময়দানে।
অধুনালুপ্ত "ফুটবলার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন" যাকে সংক্ষেপে বলা হত "এফ ডবলু এ", আশির দশকে অতীতের ফুটবলারদের জন্য অনেক ভাল কাজ করেছিল। এই এফ ডবলু এ-র যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে সুরজিত সেনগুপ্তর অবদান ছিল অনস্বীকার্য।অনেকেই বলেন, তিনি না থাকলে এফ ডবলু এ দাঁড়াতই না। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে আবাল্য বেড়ে ওঠা তিনি শেষ অবধি বাংলা সংস্কৃতির হাত ধরেই ছিলেন। তবলিয়া, সঙ্গীত, লেখক, নাট্যাভিনয় এইরকম বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ব্যাপ্তি ছিল তাঁর।
৬) ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশী “অন্ধকারে” ঢেকে যাওয়া সন্ধ্যেয় ময়দানের দুই বড় ক্লাবে ঢুকেছিলেন প্রাণহীন সুরজিত সেনগুপ্ত, যেখানে ছিল উপচে পড়া ভীড়, তাঁর প্রাণবন্ত ফুটবলের দিনকালে যেমন হত। সেই অনুষ্ঠান “কভার করা” এক নবীন ক্রীড়াসাংবাদিক আমাকে ফোনে বলছিলেন, “আপনাদের সময়ে ফুটবলে স্টার ছিল, মিডিয়া ছিলনা। আর এখন মিডিয়া আছে, স্টার নেই।” এরকমই এক মহাতারকা সেদিন অনন্ত আকাশের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন, সত্তর বছর পেরিয়ে। আর আমাদের বয়সের ভারে ছিঁড়ে যাওয়া পকেট গলে স্মৃতির ব্যাঙ্কে চিরকালের জন্য জমা হয়ে গিয়েছিল কিছু সযত্নে জমিয়ে রাখা কৈশোর-যৌবনের ঐশ্বর্যের আশ্চর্য নুড়িপাথর।
৭) শান্তিতে থাকবেন আপনি, সুরজিত সেনগুপ্ত। আপনার নির্মাণ করে যাওয়া স্মৃতির উইং ধরে এবার দৌড় শুরু হবে, তা তৈরী হতে দেখা আমাদের মত প্রত্যক্ষদর্শীদের।
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।