শীত সকালের রোদটা বড়ো মিষ্টি। রতন রোদের দিকে পিঠ দিয়ে উবু হয়ে বসে অঙ্ক করছিল। শীতের পোশাক তেমন একটা না থাকায় বেশির ভাগ দিনই মায়ের পুরনো কাপড় অথবা মায়ের হাতে সেলাই করা নকশী কাঁথা গায়ে চাপিয়ে শীতের সাথে পাঞ্জা লড়তে হয়। ওদের বাড়ির পূর্ব দিকে খোলা মাঠ। তাই সকালে সূর্যের নরম রোদে গা-টা সেঁকে নিতে বেশ লাগে। ওর ছোটো ভাই নিমু বড্ড ঘুমকাতুরে। অনেক ডাকাডাকির পর যদিও বা ওঠে তথাপি চোখ বন্ধ করে ঝিমুতে থাকে। নিমুর ঘুম থেকে ওঠার আগেই রতন সব অঙ্ক শেষ করে নেয়। তারপর বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে মাঠভর্তি সর্ষে ফুলের দিকে চেয়ে থাকে। সর্ষে ফুলের রঙটা ওর খুব পছন্দের। মাঠভর্তি সর্ষে ফুল ওর মনটাকে যেন কেমন একটা অচেনা আনন্দে ভরিয়ে দেয়। বেলা একটু বাড়লে বাজারের মাসিরা সর্ষে ফুল তুলতে আসে, সর্ষে ফুলের সাথে নানারকম শাকপাতা তুলে বাজারে বিক্রি করে। সর্ষে ফুল ভাজা খেতে নাকি খুব ভালো লাগে। রতন কোনোদিন সর্ষে ফুল ভাজা খায়নি। তাছাড়া ফুল ভাজা খাওয়াটা ওর কাছে একটা অপরাধ বলে মনে হয়। ''ফুল শিশু গান, ঠাকুর দেবতার প্রাণ" - লোকে বলে। এই তিনটি ঈশ্বরের খুব প্রিয়। এদের যাঁরা ভালেবাসতে পারেন না তাঁরা নির্দ্বিধায় মানুষ খুন করতে পারে। তাই ফুল ভাজা খাওয়াটাকে রতন ঠিক মেনে নিতে পারে না। একবার মাকে কথাটা বলাতে মা ধমক দিয়ে বলেছিলেন - ওরে আমার সবজান্তা পণ্ডিত এলোরে। সারা পৃথিবীর মানুষ প্রতিদিন কত ফুল নষ্ট করছে, অকারণে শিশুহত্যা করছে এবং গানের জগৎ কে বিকৃত করে তুলছে আর আমার ছেলে সেই কারণে সর্ষে ফুল ভাজা খাবে না। বাহ্! বেশ, বেশ।
তারপর থেকে রতন কোনোদিন মাকে কিছু বলতো না। যারা অকারণে ফুল ছেড়ে তাদেরকে ও ঠিক পছন্দ করে না। শিশুহত্যা কে বা কারা করে সে ধারণা এখনো ওর বুদ্ধিতে ধরা পড়েনি। একদিন বাবার কাছে জেনে নেবে। সকাল ন'টায় নিমুর ঘুম ভাঙে। ঘুম থেকে উঠে এসেই রতন কে জড়িয়ে ধরে
- এ দাদা, তুই এতো পড়াশোনা করিস কেন রে? তোর জন্যই তো আমাকে মায়ের কাছে বকুনি খেতে হয়।
- তা, তুই তো একটু সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসতে পারিস। তাহলে আর বকুনি খেতে হবে না।
- দুর ছাই, আমার পড়তে একদম ভালো লাগে না। পড়া মুখস্ত হয় না। কী করবো বল?
- আচ্ছা। তোর কী করতে ভালো লাগে?
- আমার ঘুমোতে ভালো লাগে।
- দাঁড়া, তোর ঘুম ছোটাচ্ছি।
পিছন থেকে মা একটা কঞ্চি নিয়ে ছুটে আসেন। মায়ের রুদ্রমূর্তি দেখে নিমু সর্ষে ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে সোজা এক দৌড়। ওর দৌড়ানো দেখে রতন হেসে ফেলে। সর্ষে ফুলের পরাগ আর শিশিরে ওর পা দু'খানা এক বিচিত্র রূপ ধারণ করে। খানিকটা দৌড়ে মাঠের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা আমগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে হাফাতে শুরু করে। মা ওকে দেখে আরও রেগে যান - দাঁড়া, আজ তোকে কে খেতে দেয় দেখছি।
ঠিক দশটার দিকে সারা শরীর ভিজিয়ে যখন উঠোনে এসে দাঁড়ায় তখন মায়ের রাগ বিন্দুমাত্র নেই। বরং ওকে দেখে মায়ের মনটা নরম হয়ে যায়। একটা গামছা এনে ওর গা, হাত, পা মুছিয়ে দেয়। তারপর বলে - যা, তাড়াতাড়ি স্কুল ইউনিফর্মটা পরে নে। আমি ভাত বাড়ছি, খেতে আয়। রতনের সব হয়ে গেছে, ওর সাথে স্কুলে যাবি। কেন এমন করিস বাবা, তুই কী একটুও বুঝিস না আমাদের টানাটানির সংসার, তোর বাবাকে কতটা পরিশ্রম করতে হয়? যা, তাড়াতাড়ি কর, একদম দেরি করিস না। রতনের দেরি হয়ে যাবে।
আজ রতনের বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে। বাড়িতে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কখন সুখবরটা নিয়ে রতন বাড়ি ফিরবে। বাবা জানেন তাঁর এই ছেলেটির মধ্যে এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। ও অনেক অনেক দূরে যাবে, এমন কিছু একটা করবে যাতে দেশ ও দশের মুখ উজ্জ্বল হয়।
রতন স্কলারশিপ পেয়েছে। জেলায় প্রথম এবং রাজ্যে তৃতীয়। প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানাধিকারীর সঙ্গে মাত্র এক নম্বরের ব্যবধান। রাজ্য সরকারের নিকট থেকে পাঁচ হাজার টাকা অনুদান পাবে, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রতি মাসে দুশো টাকা করে মাসিক বৃত্তি এবং বিনা বেতনে জেলার সব থেকে সম্ভ্রান্ত স্কুলে পড়ার সুযোগ পাবে। কোনো হোস্টেল খরচ লাগবে না। আগামী সপ্তাহের প্রথম দিনেই ওকে চলে যেতে হবে। ওদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ব্রজমোহন বাবু নিজে উদ্যোগী হয়ে রতনকে সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেছেন। রতন শুধু তার স্কুলের সম্মান বাড়ায়নি, গর্বিত করেছে তার গ্রাম এবং জেলাকে। ব্রজমোহন বাবুর দীর্ঘ বত্রিশ বছরের শিক্ষকতার জীবনে এমন ঘটনা ঘটেনি, তাই তিনিও আপ্লূত।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষ হতে বিকেল গড়িয়ে গেল। বাড়ির সবাই উপহার, মানপত্র ও অন্যান্য দ্রব্যাদি নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। আর দুদিন পরে রতন চলে যাবে শহরের নামকরা স্কুলে, তাই কিছুটা সময় ওর ছোটো ভাই নিমুর সাথে কাটাতে চাইলো। দুই ভাই পরস্পর পরস্পরের হাত ধরে এগিয়ে গেল বোস বাবুদের পুকুর পাড়ে। ওদের নানান সুখ দুঃখ হাসি কান্না জড়িয়ে আছে এই পুকুরের সাথে। আজকের গোধূলির ম্লান আলোয় রতন আর নিমু বোস পুকুরের সিঁড়িতে পা ঝুলিয়ে চুপচাপ বসে আছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। কে কী বলবে তা বুঝতে পারছে না। পুকুরের জলে বিকেলের সোনা রোদ ঝলমল করছে। ঝিরঝিরে বাতাস জলের উপরিভাগে নকশীকাঁথা এঁকে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে গোধূলি বেলায় মায়ের হাতে সেলাই করা নকশীকাঁথা খানি পুকুরের জলে কে যেন বিছিয়ে দিয়েছে।
- দাদা, তুই আমাকে ভুলে যাবি না তো।
- কেন রে পাগল, হঠাৎ করে এধরণের চিন্তা তোর মাথায় এলো কেন? তুই তো জানিস আমি তোকে কত ভালোবাসি। আমার মা-বাবা, দাদা-বৌদি, তুই সবাই যে আমার বুকের ঠিক এইখানটাই আছিস। তোদেরকে ছেড়ে যেতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু আমাকে যে যেতেই হবে নাহলে...
- হ্যাঁ দাদা। তোকে বাবা খুব বিশ্বাস করেন। বাবার আশা তোকে পূরণ করতেই হবে। তুই যা দাদা, তুই যা। আমি যেন গর্ব করে বলতে পারি
- হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি রতন কুমার নাথের ছোটো ভাই নিমাই চন্দ্র নাথ।
রতন ভাইয়ের মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। এই কটা দিনে তার ছোটো ভাই নিমু কত বড়ো হয়ে গেছে। বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে রতনের মুখ। ওর ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছে ওর ছোটো ভাই নিমুর মুখখানি। যেন একটা চাপা অন্ধকার এবং এক আকাশ যন্ত্রণা ওর শরীর থেকে মনের গভীরে প্রবেশ করে মনটাকে বিষন্ন করে তুলেছে। গোধূলির সোনালি আলো ভরে গেছে অদ্ভুত এক বিষন্নতায়।
রতন আরও কাছে এসে ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে। এতক্ষণ ওরা নিজেদেরকে ধরে রেখেছিল। কিন্তু সময়ের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে বাঁধভাঙা বন্যার জলের ধারা ওদের চারটি চোখ দিয়ে এমনভাবে গড়িয়ে পড়তে লাগলো যার কাছে গোধূলির সোনালি আলো ফিকে হয়ে গেল।
বিকেলের ট্রেন যখন হুইসেল বাজিয়ে তীব্র গতিতে স্টেশন ছেড়ে অনেক দূরে একটা বিন্দুতে মিলিয়ে গেল তখনও নিমু দাদার গমন পথের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় ওর চোখের জল চিকচিক করে উঠলো। সূর্যের দিকে তাকিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করে কী একটা বলে সবার সাথে নিমুও বাড়ির পথ ধরলো। গোধূলি লগ্নটা সবার কাছে মিলনের ও আনন্দের বার্তাবহন করলেও নিমুর কাছে তা করুণ ও বিষাদের জীবন্ত প্রতিমূর্তি হয়ে ধরা দিল।