- হ্যালো, ব্যথাটা কম এখন?
- হ্যাঁ, অনেকটা কম। আজ স্নান করবো। তোর কি খবর?
- ভালো। তোমার মনে আছে ছোট পিসির ক্লাস থ্রির বন্ধু সুষমা মাসির কথা? সুষমা মাসি কাল সকালে মারা গেছেন।
- হ্যাঁ আবছা মনে পড়ছে। ছোড়দি দেখতে গেছিল?
- না না, এই ৮৩ বছর বয়েসে আর যাবার মতো শরীরের অবস্থা নেই। রুপাদিদি খবর পেয়েই গেছিল। সুষমা মাসি দেহ দান করতে বলেছিলেন। মেসোর পিজিতে ডাক্তার চেনা ছিল। তাই দেহদান সম্ভব হলো। বাড়ি ফিরে ছোট পিসিকে জানানো হয়েছে।
- শুনে ছোড়দি কী বলল?
- মনটা খুব খারাপ হয়েছে। নানা স্মৃতিচারণ করছিল। সেই বাগেরহাটে ঘরের পাশে পুকুর ঘাটে পা ডুবিয়ে দুজনে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করতো। কথা যেন আর ফুরোতেই চাইতো না।
- সুষমা দি দেহ দান করল? চোখও?
- হ্যাঁ, দেহর মধ্যে তো চোখও পড়ে। তুমি চোখ দান করবে? তোমাকে তো কতবার বলেছি আগে, রাজি হওনি। পুরো দেহ না, শুধু চোখ দুটো। কত জন্মান্ধ শিশু, দুর্ঘটনায় চোখ হারানো মানুষ তোমার চোখ দিয়ে নীল আকাশ, সবুজ ধানের ক্ষেত, গাছপালা, ফুল-পাখি দেখতে পাবে। প্রিয়জনের মুখ দেখতে পাবে। যদি রাজি থাকো আমি ফর্ম ফিলাপের ব্যবস্থা করি।
- শুধু চোখ? লিভার কিডনি হার্ট লাংস দিবি না?
- তোমার তো পেসমেকার। সেটা অবশ্যই কোনো গরীব মানুষকে দেয়া যাবে। পুরো দেহদানে অনেক ঝামেলা। নেওয়ার ব্যবস্থা এখনো তেমন ভালো করে হয়নি। তাছাড়া তোমার বাপের বাড়ির লোকেরা কি রাজি হবে?
- মানে? আমার দেহ আমি যাকে খুশি দেবো, তাতে কার কি? তাছাড়া ওদের কাউকে খবর দিবি না। কেউ একবার চুপি দিয়েও দেখতে আসে না।
- না না - তা কি হয়? তোমার ভাই-বোন, ভাইপো ভাইজি, বোনপো বোনঝি - এদের খবর না দিলে হয়!
- আজ তোকে বলে দিলাম - আমার ছোট বোন রীতা ছাড়া আর কাউকে জানাবি না। রীতার থেকে শোনে শুনুক।
- কিন্তু অনুষ্ঠানের কি হবে? আমার যে শ্রাদ্ধ শান্তিতে বিশ্বাস নেই!
- কেন, স্মরণসভা করবি! তুই তো মানিস না, আমি জানি।
- কিন্তু স্মরণসভায় তো মামাবাড়ির সবাইকেই বলা উচিত।
- কোনও ঝামেলায় যাবি না। সন্ধেবেলা সবাইকে ডাকবি। একটা করে প্যাকেট ধরিয়ে দিবি। ব্যাস।
- প্যাকেট! প্যাকেটে কী থাকবে?
- কী আবার! কিছু শুকনো খাবার। ধর, রাধাবল্লভী, আলুর দম আর দুটো সন্দেশ। বা, সিঙাড়া, খাস্তা কচুরি, দুটো মিষ্টি।
- সন্ধেবেলা ঠান্ডা সিঙাড়া টিঙাড়া খেলে আবার অ্যাসিড হয়ে যাবে না?
- আর তুই যদি ভাত খাওয়াতে চাস... তাহলে ইলিশ মাছ ভাত করিস।
- কিন্তু... তুমি যদি ধরো ডিসেম্বর-জানুয়ারির শীতে মারা যাও তাহলে ইলিশ মাছ পাওয়াটা একটু মুশকিল হয়ে যাবে না!
- কেন, সোজা বাগমারী বা বড়বাজার চলে যাবি। ওখানে সারাবছর ইলিশ পাওয়া যায়। অবশ্য তোর অনেক হ্যাপা হয়ে যাবে। কাকেই বা পাঠাবি। তার চেয়ে প্যাকেটই ভালো। কী বল!
- তাহলে কাল সোমবারই ফর্মের জন্য যোগাযোগ করছি। ঠিক আছে তো? পরে আবার অন্য কথা বলো না।
- ঠিক আছে - কিন্তু...
- কিন্তু কি?
- না - ধর, পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে... তুই তো আবার মানিস না। অবশ্য, তুই মানিস না বলেই যে সেটা নেই... তা তো নয়। তাহলে আমি যদি অন্ধ হয়ে জন্মাই! না... না, আমি জন্মান্ধ হতে চাইনা।
- যারা অন্ধ হয়ে জন্মাচ্ছে তারা কি আগের জন্মে চোখ দান করেছিল? যদি তুমি আবার জন্মাও এবং অন্ধ হয়ে - তোমার কথামতো - তাহলেও কোন ব্যাপার না। তখন সবাই চোখ দান করবে। আই ব্যাঙ্কে জোড়া জোড়া চোখ অপেক্ষা করবে নতুন মানুষের জন্য। তার থেকে নিয়েই তোমাকে দিয়ে দেব। কোনও চিন্তা করো না।
- শোন শোন, আমার মনে হয় কি জানিস, বাপের বাড়ির লোকেরা প্যাকেটে ঠিক খুশি হবে না। ওরা পাত পেড়ে খেতেই ভালোবাসে। তুই বরং মাছ-ভাতই খাওয়াস।
- শুধু মাছ আর ভাত? আর কিছু না!
- হ্যাঁ... ডাল আর একটা কোনো ভাজা। শীতকাল হলে ফুলকপির ডালনা করতে পারিস। গরমকালে পটল পোস্ত হতে পারে...
- আচ্ছা, তোমার পছন্দের মেনু জানা থাকল। তাহলে ওই কথাই রইল। আমি ফর্মটা আনাচ্ছি কিন্তু...
- দাঁড়া একটু ভাবি। ক্যাটারারকে ডাক। কথা বলব মেনুটা নিয়ে।
- এই যে মাসিমা, এই মেনু কার্ডে স...ব পাবেন।
- এ কি! এ যে দেখছি সবই নিরামিষ!
- কত আমিষ চাই আপনার? উল্টো পিঠটা একবার দেখুন।
- হুঁ, ভেটকি মাছের পাতুরিটা চলতে পারে। আর পাবদার হরগৌরী। আচ্ছা বাপু, এই হিলশা দক্ষিণীটা কী জিনিস?
- আপনার নজর আছে বলতে হয় মাসিমা। ইলিশ মাছের এক জবরদস্ত প্রিপারেশন।
- আচ্ছা, তাহলে এক কাজ করো, এই তিনরকম মাছ দু প্লেট করে, সবজির নবরত্ন, পনির রেশমি বাটার আর পঞ্চবটি ছোলার ডাল, বেগুন ভাজা। চাটনিটা কিন্তু আমেরই দিও। কবে টেস্ট করাবে শুনি?
- আগামী রবিবার পাক্কা।
- নাহ্, খাওয়ালো বটে জীবন ক্যাটারার। একেবারে পারফেক্ট রান্না যাকে বলে। চিরটাকাল ভালো খেয়ে বুঝলি পেটটা বড় দিলখুশ হয়ে গেছে। তা, আমি মরলে চোখ, পেসমেকার, কিডনি, হাত-পা যাকে খুশি দিস, কিন্তু পেটটা কাউকে দিস না। কোনো গরীবগুর্বো সামলাতে পারবে না।