প্রবন্ধ

জানি দুশমন (দ্বিতীয় ও অন্তিম পর্ব) [ধারাবাহিক বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ]



সুবল দত্ত


দয়াবান ঘাতক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিকআগে থেকে একটি উপকারী অধাতুর বাণিজ্যিক বিষপ্রয়োগ হচ্ছে এখনো অব্দি, যেটি এখন আমাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেটির অতি ব্যবহার এখন মানবকুলের ধ্বংসের প্রত্যক্ষ কারণ হতে পারে। এটি আবিষ্কার হয়েছিল ১৮৮৬ সালে এবং এই আবিস্কারের জন্য আবিষ্কারকর্তা হেনরি মইসানকে নোবেল পুরস্কারে সন্মানিত করা হয়েছিল। যে পদার্থটি আমাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তার নাম ফ্লোরিন। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ক্লোরিন ও আয়োডিন যা সোডিয়ামের সাথে সাধারণ নুন হয়ে বিশাল সমুদ্রে ছড়িয়ে রয়েছে, এবং ফ্লোরিন ব্রোমিন ও এস্টেটিন এই পাঁচটি মৌল পদার্থ একই পরিবারভুক্ত। এদের চরিত্র প্রায় এক কিন্তু গুনাগুন আলাদা। আমাদের বিষয় ফ্লোরিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফ্লোরিনের রাসায়নিক যৌগ আবিষ্কার নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা এতবেশি মেতে উঠেছিল যে পরপর বেশ কয়েকটি ভয়ানক অমঙ্গল বস্তু পরীক্ষাগারে সৃষ্টি হল। একটি হলো, ইউ এফ সিক্স, ইউরেনিয়ামের সাথে ফ্লোরিন পাঞ্চ করা এমন একটি যৌগ যা ইউরেনিয়ামের ধ্বংসাত্মক গুণকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয় এবং ইউরেনিয়াম পরিশোধন করে। যার ধ্বংসলীলা হিরোশিমা নাগাসাকিতে দেখেছি। এখন তো আরো নিখুঁত ও পরিশীলিত। দ্বিতীয়টি সিএফসি, ক্লোরোফ্লুরোকার্বন যা আলাদীনের প্রদীপ দৈত্যের মত আমাদের সুখের খেয়াল রাখে। সিএফসি আমাদের জন্যে কী না করে। বিনা সিএফসি গ্যাসে ফ্রিজ চলবে না এসি চলবে না। সেই যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রশান্ত মহাসাগরের যুদ্ধ ময়দানে বোমারু বিমান ওড়াতে এরোসোল প্রোপেলেণ্ট ব্যবহার শুরু হোলো, এখনো সমস্ত উড়োজাহাজ গুলোতে তাই ব্যবহার হচ্ছে। সেইসময় সিএফসি-র আবিষ্কার হতেই তাকে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বাগ বম্ব’। এখন সেই বোমার সর্বত্র ব্যবহার। হেয়ার স্প্রে, রূপচর্চার জন্যে সবরকম কসমেটিক আইটেম তৈরিতে, ঘর পরিষ্কার করার লিকুইড, পেণ্ট তৈরিতে, ওষুধ তৈরিতে, বীজানুনাশক ইঁদুর মারা বিষ আরো আরো অনেক কিছুতে সিএফসি-র ব্যবহার। মোটের উপর এটি একটি এমন বস্তু যে আমাদের সুখ চাহিদা অনায়াসে মেটায়, বিশ্ববাণিজ্যের বাজারে একেবারে হট জিনিস। তাহলে এর প্রোডাকশন? ধরুন, ১৯৭০-৮০ সালে সারা বিশ্বে এর প্রোডাকশন ছিল নয় লক্ষ টন। তা দেখেই বৈজ্ঞানিকদের হাহাকার। এই জিনিষটির এমন বাড়বাড়ন্তে প্রাণীকূল রসাতলে যাবে। পৃথিবীর আবহমন্ডলে স্ট্রটোস্ফেয়ারে রক্ষাকবচ ওজোনস্তর এই সিএফসি-র জন্যেই পাতলা হয়ে যাচ্ছে। ওই স্তরের ছিদ্র দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি পৃথিবীর বুকে পড়লে মানুষের দ্রুত ক্ষয় অবশ্যম্ভাবী। তখন থেকে প্রোডাকশন ধাপে ধাপে কমতে লাগলো। কিন্তু সেটির ব্যবহার মানুষ কি কমিয়েছে? জানিনা কোভিড ভাইরাসের মত এই বস্তুটি কবে শিক্ষা দেবে।

অবশ্য মানুষের দৈহিক মানসিক স্তরে ফ্লোরিনের অবদান অপরিসীম। আমরা এর ব্যবহার থেকে বিরত হতে পারিনা। অপারেশনের সময় যে এনেস্থেসিয়া ব্যবহার হয়, সেটি ফ্লোরিনেরই যৌগ। মানসিক ভারসাম্য হারালে যে ওষুধ দিয়ে উপাচার হয় সেটিও ফ্লোরিনের যৌগ। এরকম বহু মানসিক অসুস্থতার ওষুধ তৈরি হয় ফ্লোরিন দিয়ে। ফার্মাকোলজিতে প্রচুর ফ্লোরিনেটেড ওষুধ যেগুলোর অনেকগুলিই জীবনদায়ী। বেশ কয়েকবছর ধরে কৃত্তিম রক্তের ব্যবহার চলছে। সেটিও ফ্লোরিনের যৌগ। নাম পি এফ সি, পারফ্লুরোকার্বন। গুরুত্বপূর্ণ সার্জারীতে এই সিন্থেটিক রক্তের ব্যবহার সম্বন্ধে ডাক্তারের বক্তব্যঃ ব্লাড টেস্টের দরকার হয় না, হাতের কাছেই পাওয়া যায়। ফ্রিজে ঠান্ডা করার দরকার হয় না। বহিরাগত রক্তের জন্য ঘটিত কোনো হাড়ের ইনফেকশন হয় না ইত্যাদি। তবে হতে পারে ঈশ্বর না করুন, অদূর ভবিষ্যতে বিকট আকারে কোনো পেণ্ডেমিক রোগের জন্যে এই কৃত্তিম রক্তের প্রয়োজন হতে পারে।

আত্মবোধে বাধক

হিরোশিমা নাগাসাকির পর কয়েক প্রজন্ম জাপানের প্রচুর মানুষ দুরারোগ্য ক্যান্সার পীড়িত হয়ে জীবনযাপন করছিল। কিন্তু হৃদয়ে ছিল দেশপ্রেম, ঈশ্বরপ্রেম, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা, আত্মজ্ঞান। তাই সেই দেশ এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যদি আত্মজ্ঞান সম্পন্ন দূরদর্শী কোনো মানুষকে বলা হয়, তোমার কাছে দুটো মাত্র অপশন আছে, সুস্থ শরীর কিংবা সুস্থ মন। কোনটা নেবে? এই দুটির মধ্যে একটিকে বেছে নাও। তখন সে নিশ্চয় বলবে, সুস্থ মন চাই। সুস্থ মন মানেই বিকশিত মানবতা। পৃথিবীতে ক্রমবিকাশের শেষ পর্যায়ে মানব প্রজাতি। বিজ্ঞানীরা বলেন, ক্রমবিকাশ থেমে নেই। এবার প্রকৃতিতে যে বিকাশ হচ্ছে, তা হল বুদ্ধির বিকাশ, ব্রেন ইভালুয়েশন এবং তা হচ্ছে মস্তিষ্কের পিনিয়াল ও পিটুইটারি গ্ল্যাণ্ড কেন্দ্র করে। এখানেই বুদ্ধির বিকাশ ঘটে, আত্মজ্ঞান হয়। এই পিনিয়াল গ্রন্থিটি দুই ভূরুর মাঝখানে এক ইঞ্চি ভিতরে মস্তিষ্কে অবস্থান করে বলে এর আরেক নাম তৃতীয় নয়ন বা থার্ড আই। একে মনের চোখও বলে থাকে লোকে। অধ্যাত্মিকতা ও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এখান থেকেই স্ফুরিত হয়। হৃদয় থেকে যে নিঃস্বার্থ অকৃত্তিম ভালোবাসা স্ফুরিত হয় তা এই পিনিয়ালের কামাল।

দেখা গেছে ফ্লোরাইড যুক্ত কসমেটিক ও পানীয় জল শরীরে গেলে তার অধিকাংশই এই পিনিয়াল গ্ল্যাণ্ডে জমা হয়ে সেটিকে শক্ত করে তোলে। প্রথমে ঘুম ও জাগরণের সমস্যা দেখা দেয়। তারপর উল্লেখিত সূক্ষ্ম জ্ঞান ও অনুভুতিগুলি কমে যায়। এছাড়াও স্কেলেটাল ফ্লুরোসিস, আর্থারাইটিস, অস্টিওপোরেসিস ইত্যাদি বেশ কয়েকটি রোগ বয়েস চল্লিশের পর দেখা দেয়। বিদেশে পানীয় জলে ফ্লোরাইড মেশানোর রেওয়াজ আছে। সেখানে অনেক মানুষের দাঁতে ক্যাভিটি ও দাঁতের এনামেল খারাপ। তাই দাঁতের মাজনে ফ্লোরাইড নুন মেশানো হয় এবং পানীয় জলে ও দুধে ফ্লোরাইড মেশায়। এখন সারা পৃথিবীর ৩৭২ মিলিয়ন মানুষ ফ্লোরাইড মিশ্রিত জল পান করছে। আমাদের ভারতের ভূমিজ জলে যেহেতু প্রচুর পরিমাণে ফ্লোরাইড রয়েছে, তাই পানীয় জলে এখানে ফ্লোরাইড মেশানো হয় না। তবে অনেক রাজ্যে স্কেলেটাল ও ডেন্টাল রোগ এণ্ডেমিক।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন, বিষয় সম্পত্তি, স্ট্যাটাস, লোকাচার, এমনকি দেশ বিদেশের জ্ঞান এইসবের জন্যে রয়েছে আমাদের মস্তিষ্ক। বিজ্ঞানীরা বলেন ব্রেন হচ্ছে এই বিশ্বব্রম্হান্ডের সবচেয়ে জটিলতম বস্তু।ব্রেনের ভিতরে রয়েছে অসীম মনো আকাশ চিদাকাশ জ্ঞান বুদ্ধি স্মৃতি আবেগ সৃষ্টি ও মহা সময়। কম্প্যুটারের সাথে ব্রেনের তুলনা করা যায়।কম্প্যুটারের জন্য দরকার হার্ডওয়ার আর হার্ডওয়ার চালানোর জন্য চাই সফটওয়ার। কিন্তু মস্তিষ্ক ও মন এই দুটিই কম্প্যুটারের এর চাইতে বহুগুণ জটিল। আমাদের জ্ঞানত অজ্ঞানত একটি বিষ অনু ফ্লোরিন যদি ক্রমে ক্রমে বংশানুক্রমে সৃষ্টির বিস্ময়কর দান ব্রেনের অতি কোমল সূক্ষ্ম পিনিয়াল গ্রন্থিটি খারাপ করে ফেলে তো ভবিষ্যত্‍ মানুষের কী দশা হবে ভাবতে পারেন? আমরা প্রকৃতির কাছে কি জবাব দেব?

(সমাপ্ত)