জীবকুলে মানুষই শ্রেষ্ঠ বটে। তবে অতীব দুঃখের বিষয়, মানুষের সমাজ শ্রেণি- বিভক্ত। অর্থ-বিত্ত, বংশ-পদ-পদবি দিয়ে মানুষ মানুষের মর্যাদা নিরূপণ করতে অভ্যস্ত। বাঙালি সমাজে এইসব জাত-পাত প্রথার দাপট যখন তুঙ্গে, গেরুয়া পোশাকের এক বাউল কবি গেয়ে উঠলেন -
"জাত গেল, জাত গেল বলে একি আজব কারখানা।
সত্য পথে কেউ নাই রাজি, সব দেখি তানা-নানা।
যখন তুমি ভবে এলে
তখন তুমি কি জাত ছিলে
কি জাত হবা যাবার কালে - সেই কথা কেনো বলো না।"
ফকির লালন শাহ্ (রেখাচিত্রঃ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৮৮৯, শিলাইদহ)
এই বাউল কবি আর কেউ না, ফকির লালন শাহ। তাঁর জন্মস্থান নিয়ে গবেষকরা একমত না, না একমত তার ধর্মমত নিয়ে। কোন জীবনীকার মনে করেন তিনি হিন্দু, জন্ম কুষ্টিয়া জেলার নিকটে ভাঁড়ারায়। কোন জীবনীকার মনে করেন তিনি মুসলমান, জন্ম যশোর জেলার হরিশপুরে। এমনকি লালন শাহের গানের সংকলিত পাঠেও জায়গা বিশেষে কিঞ্চিৎ ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। তিনি শিষ্যদের মাঝে প্রকাশিত কোন পুস্তক রেখে যেতে পারেননি। তাঁর জীবনী রচনার প্রামাণ্য তথ্যের যথেষ্ট অভাব; শিষ্যরাও এ ব্যাপারে যথেষ্ট নীরবতা অবলম্বন করেছেন। তবে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় তার আখড়া ছিল, এখনও সেখানে তার মাজার বর্তমান। একদল বাউল তার মাজারকে কেন্দ্র করে সেখানে গান-বাদ্য করে গুরুকে স্মরণ করে। শিষ্যপরম্পরায় চলতে চলতে তার দেহতত্ব বিষয়ক দর্শন চর্চায় কিছুটা নবসংযোজন দেখা দিয়েছে।অন্য বাউলের রচিত গানও লালনের নামে চলে আসাটা অসম্ভব না। ধর্ম-গোত্র বিষয়ে গবেষকদের ভিন্নমতের জন্য লালন শাহ নিজে কিছুটা দায়ী। কিছুই খোলসা করে যাননি তিনি, বরং নিজেকে আড়াল করতেই পছন্দ করেছেন তিনি।
যেমনটি তিনি বলেছেন,
"সব লোকে কয়, লালন ফকির হিন্দু কি যবন।
লালন বলে, আমার আমি না জানি সন্ধ্যান।"
অপর একটা গানে শুনি একই সুর -
"সব লোকে কয় লালন কি জাত এ সংসারে।
লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না দুই নজরে।"
এখানে স্মর্তব্য যে, লালন-যুগে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভালো গড়ে ওঠেনি। যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলের দরীদ্র-অশিক্ষিত লোকজনই তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। শিক্ষিত-মোল্লা-পুরুতঠাকুরদের সাথে তার শুধু দূরত্বই ছিল না, বিরোধও ছিল। লালন শাহের প্রাতিষ্ঠানিক লেখা পড়া ছিল, এমন প্রমাণ মেলে না। তবে প্রবল জ্ঞান পিপাসা তাকে তাড়া করে ফিরেছে। গয়া, কাশি, বৃন্দাবন ভ্রমণ করেছেন বলে জানা যায়। পায়ে হেঁটে মক্কা শরীফ গমন করেছেন বলেও কথিত আছে। বিদেশ বিভুইয়ে ভ্রমণের ফলে তার একটা ভূয়োদর্শন জন্মেছিল মনে করা যেতেই পারে। ভ্রমণ পথে সাধু-সূফি-দরবেশদের সাক্ষাৎ পাওয়া অসম্ভব না। লালনের গানে যে আধ্যাত্মিক চেতনা তার মূলে সূফি-দরবেশদের প্রভাব পড়তে পারে বলে অনুমান করা যেতে পারে।
ফকির লালন শাহ্ (রেখাচিত্রঃ নন্দলাল বসু)
তবে নিজেকে চেনা-জানার উপর তার বিশেষ আগ্রহ ছিল, একথা তার গানের বাণীতে প্রকট হতে দেখি।
গানে তার উচ্চারণ -
"আপন ঘরের খবর নে না।
অনায়াসে দেখতে পাবি
কোনখানে সাঁইর বারামখানা।"
তিনি আত্মপ্রচার বিমুখ সাধক ছিলেন। সেকারণে, সেকালে তার ব্যাপক পরিচিতি গড়ে ওঠেনি। তার জীবনী লেখার ব্যাপারে যে তথ্য-উপাত্ত অপ্রতুল, লালনের এই নির্লিপ্ততা এ জন্য দায়ী বললে অত্যূক্তি হবে না।
এই সাধক কবিকে সুধীমহলের নজরে প্রথম এনেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। লালন ফকিরের ২০টি গান কলকাতার প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন কবিগুরু। একদা কিছু বাউল গান ইংরেজিতে অনুবাদও করেছিলেন কবি। একদা বাউল মতাদর্শে রবীন্দ্রনাথ প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন; রবীন্দ্র-লালন এ দু'জনের গান পাশাপাশি রাখলে এর সত্যতা মেলে সহজেই। তবে লালন-রবীন্দ্রনাথ সাক্ষাৎ নিয়ে মতপার্থক্য দেখতে পাই। কুষ্টিয়ার শিলাইদহে জমিদারি দেখভাল করার সময়ে কবিগুরর সাথে লালন শাহের সাক্ষাৎ হলেও হতে পারে। 'গোরা' উপন্যাসে প্রথম পৃষ্ঠায় রবি কবি লিখছেন, আলখাল্লা পরা একটা বাউল নিকটে দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া গান গাহিতে লাগিল -
"খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়,
ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতেম পাখির পায়।"
প্রচলিত ধর্মমতের বাইরে এসে মানব ধর্মকে ধারণ করেছেন এই মরমি সাধক। ধর্ম শাস্ত্রে পাপ পূন্যের একটা রূপরেখা আছে বটে। কিন্তু লালন শাহ আর পাঁচজনের মতো তা শিরোধার্য করেননি।অভিজ্ঞতাবাদীদের মতো তিনি বলেছেন, 'এ দেশে যা পাপ গণ্য, অন্য দেশে তা পূণ্য হয়। পাপ-পূণ্যের কথা আমি কারে বা সুধাই। তার গানে হিন্দু মুসলিম উভয় ধর্মীয় সংস্কৃতির মিশ্রণ দেখতে পাই। তার মতবাদ যতটা না ধর্মীয় চেতনা সমৃদ্ধ, তার চেয়ে বেশি দার্শনিক চেতনায় সমৃদ্ধ। গানে গানে যে তত্ব তিনি প্রকাশ করেছেন তা কিছু ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিপন্থী। ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের সাথে তার যে বিরোধ তার কারণ এই যে, তিনি ধর্মবেত্তা না, তিনি দার্শনিক - দার্শনিকরা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে চেয়ে প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় মত থেকে সরে আসে।
তাঁর জীবন জিজ্ঞাসা আমাদের মুগ্ধ করে। জীবন আর জগৎকে ঘিরে নানান দার্শনিক প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। গানের কথায় তাকে বলতে দেখি -
"আমার এ ঘরখানায় কে বিরাজ করে।
আমি জনম ভরে একদিন দেখলাম নারে।"
মানুষকে চরম জ্ঞান করে ভক্তি করতে বলতেন এই সাধক। তার গানে দেখি, মানব-গুরু নিষ্ঠা যার সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার।
অন্যত্র বলতে শুনি -
"মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষ ছেড়ে খ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।"
লালনের গান আজ দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চর্চা হচ্ছে। তাকে নিয়ে আগ্রহ রয়েছে গবেষকদের মধ্যে। তার উদার মানবতাবাদের আকর্ষণে দূর পাশ্চাত্য থেকে কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছে এবং এখনও পাড়ি দিচ্ছে এই বাংলায় - আউল বাউল লালনের দেশ কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায়। ইতোমধ্যে বেশ কিছু ভাষায় অনুদিত হয়েছে তার গান। তার গানে তাত্বিক মূল্যের সাথে সাহিত্যিক মূল্যও রয়েছে। বাঙালির ভাবুক দার্শনিক মনের খোরাক রয়েছে তার গানে। তার গান মানবিক ও আধ্যাত্মিকভাবে সিক্ত। এসমস্ত কারণে কালকে অতিক্রম করে টিকে আছে লালনের অমর সংগীত।
তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লিখেছেন, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লিখেছেন। এই বিবেচনায় লালন শাহ আজও প্রাসঙ্গিক। জাতিতে-জাতিতে, মানুষে-মানুষে ভেদাভেদের বিরুদ্ধে তার লেখনি আজও মানবতাবোধকে জাগরিত করে চলেছে।
বাউল সঙ্গীত ও তার ধারা যতদিন বেঁচে থাকবে, লালন ফকিরও তার সঙ্গেই আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।