কবি ও প্রাবন্ধিক দেবজ্যোতি কর্মকারের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'শিকড় এবং কয়েকটি দাগ' পড়লাম। এই কাব্যগ্রন্থে মোট ৫৭টি কবিতা রয়েছে। অসাধারণ লেখনিতে সমৃদ্ধ প্রতিটি কবিতা। শব্দ চয়ন, বাকভঙ্গি যেন ছুরির ফলার মতো। পাশাপাশি প্রচ্ছদ, রূপায়ন, অলংকরণ এবং সর্বোপরি কাব্যগ্রন্থের নামাঙ্কনেও কবির স্বকীয়তার পরিচয় পাই। প্রকাশক ধীমান ব্রহ্মচারী ও তাঁর প্রকাশনা সংস্থা 'এবং অধ্যায়'-কেও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি অসাধারণ একটা বই উপহার দেবার জন্য। এবার আসি মূল আলোচনায়।
'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি' - আধুনিক কবি জীবনানন্দের সুরে আমাদেরও একবাক্যে একথা স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। কিন্তু কবি দেবজ্যোতি কর্মকার সেই 'কেউ কেউ কবি'-র দলে। অন্তত এমনটা আমার মনে হয়েছে এই কাব্যগ্রন্থটি পড়ে। যদিও কবিতা আমি খুব একটা বুঝি না, কিন্তু পড়তে ভীষণ ভালোবাসি। সেই পড়ার সূত্রেই কিছু কথা। কবির কবিতার পরতে পরতে উঠে এসেছে প্রেম, যন্ত্রণা, বিরহ, হতাশা। আবার মানুষের সামাজিক দায়বদ্ধতা, মানুষকে মানুষে সম্পর্কের মূল ধারাপাতটিও কবি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। প্রথম কবিতা 'শিকড়'। এতে উঠে এসেছে স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস। দেয়ালে সাজিয়ে রাখা ছবিটার কাচ ঝুরঝুর করে ভেঙে যাওয়া আসলে সাজানো স্বপ্নের অপমৃত্যু। শৈশবে হারানো প্রেম যেমন করে মাঝে মাঝে দপ করে জ্বলে ওঠে, তেমনি আবার নিভেও যায়। পুরোনো বিশ্বাস বুকে নিয়ে আবারও আমরা স্বপ্ন সাজাই। কবি বলছেন -
"ঘরের দেয়াল জুড়ে আবার
সেজে উঠবে স্বপ্ন এবং ইতিহাস আরও মজবুত কোনো ফ্রেম,
প্রচণ্ড ঝড়েও সামলে রাখবে আমাদের।"
শুধু স্বপ্নের অপমৃত্যু নয়, কবি ব্যক্তিগত শোককেও ভাসিয়ে দিতে চেয়েছেন - এমনই আশাবাদ ছড়িয়ে দিয়েছেন 'স্বপ্নের মৃতদাগ' কবিতায় -
"এসো একবার অন্তত ভাসিয়ে দিই ব্যক্তিগত শোক
পরিত্যক্ত জীবন
গাইবে নির্জনতার গান
আর কোনও আক্ষেপ রেখো না
পূর্বাহ্নের শিকড় বরাবর।"
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত যেমন বলেছিলেন -
"প্রেম বলে কিছু নাই
চেতনা আমার জড়ে মিশাইলে
সব সমাধান পাই।"
কিন্তু কবি তার বিরোধিতা করেছেন। কবির বিশ্বাস ফুটে উঠেছে 'উপশম' কবিতার কয়েকটি ছত্রে -
"কেউ যেন বলেছিল
শুদ্ধ প্রেম বলে কিছুই নেই।
আমার প্রবল আপত্তি ছিল।
তর্ক করেছি।
এখনও আমার বিশ্বাস,
একমাত্র প্রেমেই নেই কোনো ক্ষয় -
যতটা তাই প্রেমে থাকা যায়।
সেটুকুই বিশুদ্ধ সময়।"
তাই যতটা সময় পান কবিতাকে ছুঁয়েই তাঁর দিন কাটে। কবিতার গন্ধ পান কবি। পান বৃন্তের স্বাদ। এ সবই কবির বেঁচে থাকার উপশম। এটুকুও যদি না পেতেন তবে -
"...একদিন মিথ্যে হয়ে যেত
পৃথিবীর নিজস্ব ঘোরাটুকুও।"
প্রেয়সীকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রনা ভুলতে দূর থেকেই তাকে স্পর্শ করতে হয়। এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে? 'স্পর্শদাগ' কবিতায় উঠে এসেছে সেই হতাশা ও প্রেমের যন্ত্রণার ছবি -
"এভাবেই তোমাকে স্পর্শ করি
কত দূরে আছ -
এই অপূর্ণ সময় খোঁজ রাখে না
কতটা কাছে এলে
শুকনো পাতাটির উঠোনে গড়াগড়ি খাবে
এই অবেলার রোদ।"
প্রেয়সীকে কাছে পাওয়া, অভিমান, গোপন অভিসারের চিহ্নগুলি এক সময় প্রকট হলেও সময় সব কিছুকেই বদলে দেয়।
"স্নানঘাট বদলে গেছে কবে
ঝর্ণা জল ধুয়ে যায়
আমাদের সমস্ত ঘ্রাণ।"
তাই সবকিছু ছেড়ে ঘর গৃহস্থালী ভুলে কবি যমুনা হয়ে থাকতে চান। যদি একবার আবারও তার প্রেয়সী তাতে অবগাহন করেন, কবি মিটিয়ে নেবেন মনের সমস্ত আশ স্পর্শসুখে। সময়ের এই প্রবাহমানতা, বিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যায় তার 'যমুনা' কবিতাটিতে।
কবি চেয়েছেন দুঃখ ভুলতে, কিন্তু দুঃখ গুলো যেন আবারও কবিকে আঁকড়ে ধরেছে। আসলে দুঃখের অশ্রু সাগর মন্থন করেই কবির পথ চলা। রবীন্দ্রনাথের মতে "আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন।" ঠিক তেমনি আঘাতে-আঘাতে, বেদনা-বেদনায় মানুষ তার প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে। তাই প্রিয় বিষাদকে আঁকড়ে ধরেছেন কবি -
"প্রিয় বিষাদ-আবার ফিরে এলাম
রক্ত খুঁটে খুঁটে যেটুকু আমার বলে জেনেছি এতদিন
সে সব স্খলিত সুখ রেখে এলাম
এক নির্জন মায়াবী দরজায়।"
আবার 'জীবন' কবিতায় ধরা পড়েছে -
"প্রতিটি ঢেউয়ে কারা যেন লুকিয়ে আছে!
আমাকে একা পেয়ে
মাঝ সমুদ্রে আঘাতের পর আঘাত।"
কিন্তু আঘাত, যন্ত্রণা, দুঃখই শেষ কথা বলে না। দুঃখের মধ্য থেকেই আনন্দকে খুঁজতে হয়। তাই অনন্ত শূন্যতাকে বুকে নিয়েও বিষাদকে ভেঙে দিতে চেয়েছেন কবি। উপভোগ করতে চেয়েছেন জীবনকে। অন্ধকারে ফসফরাসের মতো জেগে উঠে প্রেয়সীর মুখ। তাই সকল শূন্যতা, তুচ্ছতাকে তিনি সাদরে গ্রহণ করেছেন -
"আমাকেই দাও সব শূন্যতা
অথবা, প্রবল তুচ্ছতা।
আমি আগুনে আগুন পোড়াই
সেতারের সুরে বিরহ এঁকে।
দু'চোখে অঝোর তোমাকে দেখে
কী হবে আজ বিষাদে থেকে?
এসো, ভেঙ্গে দিই স্তব্ধ এ রাত
প্রবাহ জুড়ে রাখি উপভোগ
আগুনে শিখি, আগুনেই লিখি
হাহাকার ভুলে তবু ছুঁয়ে থাকি।"
কারণ যন্ত্রণা দুঃখের মধ্য দিয়ে জীবনকে উপভোগ করাই হচ্ছে জীবনের সার্থকতা। তবুও কোথায় যেন একটা আক্ষেপ ছড়িয়ে পড়েছে কাব্যগ্রন্থের বেশ কিছু কবিতার মধ্যে -
"রেখে যাব সব আক্ষেপ
শিকড় থেকে আরও গভীর নির্জনে রেখে যাব
প্রিয় বাঁশিটির কৃষ্ণসুর।"
আবার লেখা 'অভিমান নিয়ে' কবিতায় আমি লিখেছিলাম -
"মেঘ এসেছিল -
কিন্তু আমি বৃষ্টি চাইতে পারিনি
বুকভরা অভিমান নিয়ে
সে ফিরে গেছে।
কারণ আমি তো বৃষ্টি আনার
মন্ত্রটাই ভুলে গেছি।"
তেমনি তাঁর অজস্র কবিতাতেও আমরা দেখি প্রিয় বিষাদের বাঁশির সুর, আক্ষেপ আর হতাশার চিত্র। 'মাতৃযোগ' কবিতায় কবি লিখেছেন -
"আমি এক জন্মের কথা জানি
গর্ভ যন্ত্রণার কথা জানি
ঈশ্বর কী নির্দয়!
নিজ হাতে কেটে দিল মাতৃযোগ
তারপর থেকে
ধরে রাখতে পারিনি কিছুই।"
এখানেও আক্ষেপ। মায়ের সঙ্গে নাড়ির যোগ যখনই ছিন্ন হয়, আমরা ভুলে যাই মাতৃত্বের যন্ত্রনা, গর্ভ যন্ত্রণার ইতিহাস। আসলে ঈশ্বরই তো নির্দয়, নিষ্ঠুর। নিজ হাতে মাতৃযোগ ছিন্ন করে দেন তিনি। 'জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী' অর্থাৎ জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও বড় - এই ধারাপাতটিও কবি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সামাজিক দায়বদ্ধতার কথাও। 'আগুন' কবিতায় কবি লিখেছেন -
"তোমার নাভিকুন্ডে জ্বলছে
আমার ভারতবর্ষ।
যারা যজ্ঞের নেশায়
জন্মভূমিতে পুঁতে ছিল নিশান
শরীরে সিঁদুরে যন্ত্রণা এঁকে
তুমি চেয়ে আছ তাদের দিকে।"
এই কবিতাটিতে ধরা পড়েছে দেশপ্রেম। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ, হানাহানি আর মিথ্যা অহংকার এর জাল বুনে একদল মানুষ নিজেদের মধ্যেই বাধাচ্ছে স্বার্থের সংঘাত। তেমনি ভারতবর্ষের মতো দেশের নগ্নরূপও ধরা পড়েছে 'এখন নির্বাচনে মগ্ন আছি' কবিতায় -
"গর্ভের শিশুটি গোঙাতে গোঙাতে জেনে গেল
কীভাবে এই দেশ এখনও
ভাতের জন্য কাঁদে।
ভাগ্যিস সে কান্না আমরা কেউ শুনি না!"
আবার
"নির্বাচনের আগে এই দেশ এখন
মগ্ন আছে মন্দিরের নেশায়, মসজিদের আকাঙ্ক্ষায়।"
বা
"যে শিশুটি চলে গেল
তার ছিল না কোন কিছুই।
শুধু একটুখানি রক্ত
আর সামান্য কিছু বাতাস।"
এই একটুখানি বাতাস - এটাই তো বেঁচে থাকার রসদ। একটুখানি বাতাস কিন্তু আমরা তাকে জোগান দিতে পারিনি, সঠিকভাবে বেঁচে থাকার আশ্বাসও আমরা দিতে পারিনি। নির্বাচনের আগে উঠে আসে প্রতিশ্রুতির বন্যা, অথচ নির্বাচনের পরে আমরা সেই বন্যার জলেই হয়তো ভেসে যাই খড়কুটোর মতো। তাই এদেশের কোন মায়ের গর্ভের ভ্রূণ হয়তো ভারতবর্ষের এই অবস্থা দেখে না হেসে পারে না। আমরা তো এমন ভারতবর্ষ চাইনি, আমরা চেয়েছিলাম সেই ভারতবর্ষ, যেখানে থাকবে শান্তি, মানুষ খেয়ে পরে বাঁচবে। একমুঠো ভাতের অভাবে কারো মৃত্যু হবেনা, হানাহানি বন্ধ হবে। নবারুণ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন,
"এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না।"
ঠিক তেমনি মানুষে-মানুষে সম্পর্ক, তাদের দায়বদ্ধতাকে স্মরণ করিয়ে দিতেও কবি ভোলেননি। একদিকে হতাশা, প্রেম, দুঃখ, যন্ত্রণা, অন্যদিকে সংশয়, ভয় সব মিলিয়ে কবির কবিতার অবয়ব। তাই 'মানুষের কথা' কবিতায় কবিকে বলতে শুনি -
"এবার নিজেকেই পাল্টে নেব
- কথা দিচ্ছি;
কথা দিচ্ছিঃ মানুষের মত কথা শিখে নেব আমি।
যেমনটা দিয়েছ বলে!
কাউকে বলবো না কোনও দিন -
এখনও হৃদয় ভাঙার শব্দ শুনতে পাচ্ছ?
এখন থেকে বারবার মুখস্থ করে নেব 'কোথাও কিছু হয়নি তো'!"
আসলে সব দুঃখ, বেদনা, হতাশার পরেও খুব সহজেই মেনে নেওয়া - 'কোথাও কিছু হয়নি তো' - এই আন্তরিকতা, এই প্রাপ্তি, এই অকপট স্বীকারোক্তি, এই ধনাত্মক চিন্তাভাবনা আমাদের নতুন করে বাঁচার আশা, মদত জোগায়।
"একটা বিরাট শিকড় যেভাবে মাটি ভেদ করে অতল স্পর্শ করে, কবির চিন্তা ঠিক সেই তল ছুঁয়ে গভীর থেকে আরো গভীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে।"
প্রত্যেকটি কবিতাতেই উঠে এসেছে বাস্তবতা।
আসলে কবি কিন্তু পৌঁছে গেছেন শিকড় থেকে শিকড়ে, মাটির আরো গভীরে, তার প্রত্যেকটা মূলরোম, মূলত্রে। সেখান থেকেই সংগ্রহ করেছেন কবিতার রসদ। কবি হিসাবে এখানেই তার সার্থকতা।
কাব্যগ্রন্থঃ শিকড় এবং কয়েকটি দাগ
কবিঃ দেবজ্যোতি কর্মকার
প্রকাশকঃ ধীমান ব্রহ্মচারী
প্রচ্ছদ রূপায়নঃ অয়ন চৌধুরী
নামাঙ্কনঃ হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
অলঙ্করণঃ প্রিতম ঘোষ
উৎসর্গঃ দেবাত্মিক (রোদ্দুর)-কে