শ্রী অরবিন্দ ও মাদারের ধাম পন্ডিচেরি ভ্রমণের শখ অনেকদিন থেকেই ছিল, কিন্তু সাধারনভাবে আমাদের কাছে তেমন কোন তথ্য ছিল না। ভ্রমণ সংস্থাগুলি দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ কালে পন্ডিচেরি বুড়িছোঁয়ার মতো করে ছুঁয়ে যায়। হঠাৎ করে ফেসবুকে পন্ডিচেরি সম্পর্কে কিছু সদার্থক তথ্য পাওয়ার ফলে আমরা হঠাৎ ঠিক করে ফেললাম, পন্ডিচেরি ভ্রমণ করব। শ্রী অরবিন্দ আশ্রমের সাথে বিশেষভাবে যুক্ত এক ভক্ত ভদ্রমহিলার সাথে আমার গৃহিনির হঠাৎ করে যোগাযোগ হয়ে গেল। তিনি বিশেষ উদ্যোগী হয়ে গেস্ট হাউস বুকিং করে দেন। এটা ছিল আমাদের আশাতীত পাওনা।
ট্রেনের বিষয়ে মনে কিছুটা ধন্দ ছিল কারণ পন্ডিচারী এক্সপ্রেস সপ্তাহে দুদিন মাত্র যায় এবং ৩৪ ঘণ্টা যাত্রা পথ । আমরা বরিষ্ঠ নাগরিক, এত সময় ট্রেনে টু টায়ার ছাড়া যাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। ভাগ্য প্রসন্নই ছিল। দুটি টিকিট পাওয়া গেল। ট্রেনের খাওয়ার সম্বন্ধে আমাদের ধারণা এবং অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো নয়। যাওয়ার দিন এগিয়ে এলো, ২৭শে নভেম্বর ২০২২। বাড়ি থেকে কিছু খাবার তৈরি করে আর বাকিটুকু কিনে নিয়ে যাত্রা করলাম । মনের সংশয় তাও দূর হয় না, ফেরার সময় কি হবে ভাবলাম, ফলমূল, চিঁড়ে, দই দিয়ে ভাতের অভাব দূর করা যাবে। শেষ মুহূর্তে দুর্বল বিরোধী দলের মতো মত বদলাতে হল। ভাবলাম, পন্ডিচারীতে চিঁড়ের মতো সামান্য জিনিস কি পাওয়া যাবে না? অতএব চিঁড়ের প্যাকেটটা বাড়িতে রেখেই আসলাম। অযথা বোঝা না বাড়ানোই ভালো।
ট্রেন যথারীতি রাত এগারোটা ত্রিশ মিনিটে কুড়ি নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছেড়ে গেল। ২৭ তারিখ রাতটা ভালোই কাটলো। পরদিন সকালে সহযাত্রীদের সাথে আলাপচারিতা শুরু করে দিলাম। প্রচুর যাত্রী ভেলোর যাচ্ছেন চিকিৎসার জন্য। আমাদের সাথে দুজন বাংলাদেশী ভদ্রলোকের পরিচয় হলো তারাও চলেছে চিকিৎসার জন্য তাদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলাম। পন্ডিচেরিতে থাকাকালীন ওনাদের খোঁজ-খবর নিয়েছিলাম এবং কুশল আছেন জেনে আশ্বস্ত হয়েছিলাম।
নির্ধারিত সময় সামান্য কিছু আগেই ট্রেন পুদুচেরী স্টেশনে পৌঁছে গেল। স্টেশনে নেমে একটা অটো নিলাম গন্তব্য নিউ গেস্ট হাউস। মিনিট দুয়েকের মধ্যে পৌঁছালাম এবং ভাড়া নিলো দেড়শ টাকা। স্টেশনের এত কাছে! আমরা চমৎকৃত হলাম।
শ্রী অরবিন্দ আশ্রম এর নিউ গেস্ট হাউস খুব সুন্দর এবং খোলামেলা আধুনিক ব্যবস্থায় সমৃদ্ধ দৈনিক ভাড়া মাত্র সাড়ে ছ'শো টাকা। সমুদ্র মাত্র ২০০ মিটার ।আশ্রমে সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার পাওয়া যায়। আমরা কোনরকমে ধোসা খেয়ে বার হয়ে পড়লাম মধ্যাহ্ন ভোজের ঠিকানাটা যোগাড় করতে। কারি পাতা স্বাস্থ্যসম্মত বহু পানীয় বিক্রি হচ্ছে। বহু স্বাস্থ্য সচেতন নাগরিক তার আস্বাদনে ব্যস্ত, কিন্তু আমরা এই মাথা ও মাথা চষে ফেলেও বাঙালি হোটেল কোথাও পেলাম না। একটি হোটেলে এক বাঙালি ছেলের দেখা পেলাম। সে জানালো বাঙালি হোটেল ছিল তবে উঠে গেছে। আমরা প্রমাদ গুনলাম, মাছ আর ভাত ছাড়া যাদের জীবন অচল তাদের এবার কি হবে! আমাদের ফেরার টিকিট আবার ৮ দিন পর। ওই বাঙালী ছেলেটির হোটেলে কারিপাতা বিহীন মাছ অতি যত্নে সে রান্না করে দিল। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যখন যাই সাথে থাকে গাওয়া ঘি, তবে এখানে আলু সিদ্ধ জোগাড় করা গেল না। কারণ ওদের মেনু চার্টে নেই অতএব...
দুপুরের দিবানিদ্রা সাঙ্গ করে আবারো গেলাম সমুদ্রের ধারে, অতি অপূর্ব চারিদিকে বসার ব্যবস্থা এবং আলো দিয়ে সাজানো একটি পার্ক আছে। সুন্দর ফুলের গাছগুলো আরো মায়াবী লাগছিল, বেশি সময় বসা হলো না কারণ ওখানে আইন শৃঙ্খলা অতি কঠোর। আমরা আবার রাতের খাবার সন্ধানে বার হলাম। চারিদিকে ইডলির সুঘ্রাণ, আবিষ্কার করে ফেললাম, জোনাকির আলোর নাও গুলো টুনি লাইট সজ্জিত কতগুলি স্টল। সেখানে রয়েছে লোভনীয় চিকেন বারবিকিউ। আমরা মনোযোগ সহকারে ভোজন পাঠে নিমগ্ন হলাম।
পরদিন সকালে অফিসের রিসেপশন থেকে খোঁজখবর নিয়ে চললাম শ্রী অরবিন্দ আশ্রম এবং মায়ের বাড়ি। ভাষাটা ওখানে একটা সমস্যার কারণ হিন্দিটা কেউ জানে না আর ইংরেজিটাও সাধারণ মানুষ জানে না।কয়েকটা ঠোক্কর খেতে খেতে প্রায় আশ্রমের কাছাকাছি চলে এলাম। এক সাইকেল আরোহী আমাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসলেন, আমাদের প্রশ্নের উত্তর একপ্রকার ধমকের স্বরে বললেন শ্রী অরবিন্দ আশ্রম বলুন। আমরা লজ্জিত হলাম। ওই ভদ্রলোক আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন কারণ তিনি ওই আশ্রমেরই আবাসিক। এসে উপস্থিত হলাম আমাদের অভিষ্ঠ তীর্থস্থান শ্রী অরবিন্দ আশ্রম বা মায়ের বাড়ির সামনে। সমাধিস্থলটি ফুল দিয়ে অপূর্ব ভাবে সাজানো, সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ চারিদিক। অগুনতি মানুষ সমাধিবেদীর চারিদিকে বসে ধ্যানে নিমগ্ন। এ এক স্বর্গীয় অনুভূতি। বিশাল একটি রাধাচূড়া গাছের নীচে সমাধিবেদী। জানলাম ঐ রাধাচূড়া গাছটি ঋষি অরবিন্দের সময় থেকে একইভাবে আছে, ঝড় জলেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমার গৃহিনির সেই ভক্তিমতি বান্ধবীটি বলেছিলেন, ওই রাধাচূড়া গাছটার পেছনে থাকে এক দম্পতি, আমরা অনেক চেষ্টা করেও তাদের দেখা পাইনি। আমাদের পথপ্রদর্শক ওই সাইকেল আরোহী একজন এমডি ডক্টর, ওনাকে দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই এত সাধারণ। ওনার সাথে আমরা বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করলাম, কারণ সর্ব সাধারনের জন্য প্রতিটা স্থান প্রবেশের অগম্য ছিল। উনি আমাদের জানালেন, সমাধিবেদী কোন প্রকার কংক্রিটের উপর নেই শুধুমাত্র বালি দিয়ে ঢাকা। আমরা যতবারই স্পর্শ করেছি, হাতে বালিশ স্পর্শ অনুভব করেছি। প্রতিটা মুহূর্তে এক অভিনব শিহরণ, ডঃ দত্ত আমাদের নানাভাবে সাহায্য করেছেন। ওই আশ্রমের সারাদিনের জন্য কুপন কাটার ব্যবস্থা আছে মাত্র ৫০ টাকায় প্রাতরাশ মধ্যাহ্ন ভোজ এবং রাতের খাওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। আশ্রমের খাওয়া অত্যন্ত সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যসম্মত। প্রতিটি আশ্রমিক অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে সবাইকে সুবিশাল থালা ও বাটিতে খাবার সরবরাহ করছেন। তারা সদাই উৎফুল্ল, এক অদ্ভুত প্রশান্তি সকলের মুখে আর এক চমকপ্রদ নিঃশব্দতা। আমার শরীর ও মন দিনে দিনে যেন আরও সুস্থ হয়ে উঠল। মনে হতে লাগলো, ওই সাইকেল আরোহী যেন শ্রী অরবিন্দ প্রেরিত এক দূত চলে এসেছেন আমাদের সাহায্যের জন্য।
কলকাতায় বসে ভেবেছিলাম দু-একদিনের জন্য রামেশ্বরম দর্শন করতে যাব। প্রথমে পুদুচেরি রেলস্টেশন গিয়ে খোঁজ নিলাম কিন্তু জানতে পারলাম, ওখান থেকে সরাসরি কোন ট্রেন রামেশ্বরম যায় না। পুদুচেরির বাস টার্মিনালে গেলাম, ওখানেও কোন বাস সরাসরি রামেশ্বরম যায় না। একটি ভলভো বাস রাত বারোটায় আসে তাদের নির্ধারিত সময়সূচী মেনে এবং নিকটবর্তী ইন্দিরা গান্ধী মূর্তিটার সামনে থেকে যাত্রী পরিষেবা দেয়। মনের অদম্য ইচ্ছা থাকলেও আমরা বরিষ্ঠ নাগরিক এত ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে না ভেবে থেমে গেলাম।
একদিন অটো নিয়ে চলে গেলাম স্থানীয় দ্রষ্টব্যের জায়গাগুলো পরিদর্শন করতে। সকাল আটটায় প্রাতঃরাশ সেরে, স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম। মাত্র এক হাজার টাকায় ৬ থেকে ৭ ঘন্টা যাত্রাপথ এবং দর্শন। প্রথমে গেলাম বিখ্যাত শিব মন্দির, পূজারী পরম যত্ন করে অনেক সময় ধরে পূজা করলেন। আমরা খুশি মত দক্ষিণা দিলাম, তিনি অতি নির্লিপ্ত। মন্দিরের গায়ে অসম্ভব সুন্দর কারুকার্য, এই ধরনের স্থাপত্য শিল্প সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। এরপর প্রায় এক ঘন্টা অটো যাত্রার পর এসে পৌঁছলাম আরোভিলায়। জায়গাটা যেন এক শান্তি নিকেতন, চারিদিকে গহীন জঙ্গল এবং অসংখ্য পাখির কলতান শুনতে পেলাম। প্রায় দেড় মাইল হাঁটার পর প্রধান কার্যালয়ে এসে উপস্থিত হলাম। জানতে পারলাম নির্ধারিত সংখ্যক প্রবেশপত্র সকাল ন'টার মধ্যে দেওয়া হয়ে গেছে, অতএব মূল মাতৃ মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করা যাবে না, তবে বাইরে থেকে দর্শন হবে। আমরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম নিস্তব্ধতার এক অপূর্ব সংগীত মূর্ছনা মনের মধ্যে উপলব্ধি করলাম। পথের মধ্যে এক বিরল দৃশ্য অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখলাম। মাদার বা মা মীরা প্রতিটি ফুলকে পর্যবেক্ষণ করে তাদের গুন অনুযায়ী এক একটি বিশ্লেষণ দিয়ে চিহ্নিত করেছিলেন। সেই ফুল গুলির ছবি এবং তাদের বিবরণ বিভিন্ন বোর্ডে সযত্নে লিপিবদ্ধ। মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্টের সাথে সবগুলি মিলে যায়। প্রায় দু কিলোমিটার হাটার পর এসে উপস্থিত হলাম মাতৃ মন্দিরের সামনে। মনে হয় টনটন সোনা দিয়ে মন্দির নির্মাণ হয়েছে, অনুভব করলাম অন্দরমহলে বহুবিধ মানুষ গভীর ধ্যানমগ্ন। এ এক স্বর্গীয় অনুভূতি! আমরা বেশি সময় দিতে পারিনি, কারণ সময়ের সাথে হাত মিলিয়ে চলতে হবে। একদিকে অটোচালক, অন্যদিকে পরবর্তীকালীন ভোজন এর চিন্তা। অতএব ফেরার পালা।আমি খুব দ্রুত চলি এবং গৃহিণী অনুসরণ করেন এটাই নিয়ম। অনেক অনুযোগ, অভিযোগ শুনেছি, কিন্তু আমি নির্বিকার । তবে ধীরে চলার উপযোগিতা যে আছে সেটা বুঝলাম, যখন আরোভিলার ছোট বাসটি করে (বরিষ্ঠ নাগরিকের জন্য) আমার গৃহিণী প্রবল গতিবেগে বেরিয়ে চলে গেল। আমার মনে রামচন্দ্রের সীতা হারানোর অনুভূতি প্রবল হলো। অনেক পরে প্রধান ফটকের সামনে এসে সীতা উদ্ধার হল। পরে জেনেছিলাম, আরোভিলা দর্শনের জন্য বিনামূল্যে বাসের পরিষেবা দেওয়া হয় বরিষ্ঠ নাগরিকদের জন্য। আরোভিলা দেখার পর্ব সাঙ্গ করে আমরা গেলাম একটি নির্জন সমুদ্র সৈকতে। অনেকগুলি জেলে ডিঙ্গি দেখা গেল, তবে পুরীর মত ডিঙ্গি নৌকো বাসে করে আনা হয় না। একটা যন্ত্রের সাহায্যে জল থেকে তোলা হয়। হঠাৎ করে ভেসে আসলো মাছের তাজা গন্ধ, চুম্বকটান অনুভব করলাম। সমুদ্রের টাটকা মাছ আমাদের নির্দেশ মতো কারি পাতা ছাড়া রান্না করে দিল। ফেরার সময় বড়বাজার বলে একটি জায়গায় গেলাম। অটো চালককে আমাদের মুড়ি এবং চিঁড়ের চাহিদা সম্বন্ধে জানালাম। বড় মুদির দোকান এলাম, সেখানে নেই দেখে গেলাম একটি চালের আড়তে, কারণ চাল থেকেই তো মুড়ি এবং চিঁড়া পাওয়া যায়। দোকানদার উল্টো দিকের দোকানে যেতে নির্দেশ করলেন। গিয়ে দেখলাম যেটা, সেটা লোহার যন্ত্রপাতির দোকান। এই বিরহ নিয়ে পৌঁছে গেলাম পুদুচেরী মিউজিয়াম। এক বাঙালী ভদ্রমহিলা আমাদের চিঁড়া বিরহ সম্বন্ধে জানতে পেরে অ্যামাজনে অর্ডার করতে বললেন। এরপর গেলাম বোটানিক্যাল গার্ডেন। প্রকৃতির কোলে থাকতে সব সময় ভালো লাগে। কিছু কচি কাঁচা ওখানে পিকনিক করছে দেখলাম, সম্ভবত কোন স্কুল থেকে এসেছে। সবশেষে এলাম একটা চার্চে, দিনটা ছিল রবিবার প্রার্থনা সবে শেষ হয়েছে, চারিদিক ঝা চকচক।ভক্তরা প্রার্থনা সেরে শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে বেরিয়ে আসছেন। আমরা কিছুসময় বসলাম, ভগবান যীশু ও মাদার মেরী এক অনাবিল শান্তি এনে দিল মনে।
এইভাবে দিনগুলো কাটছিল এক অপার্থিব মানসিক শান্তির ছোঁয়ায় সেটা হয়তো শ্রী অরবিন্দের আশ্রমেই সম্ভব। অবশেষে ৫ই ডিসেম্বর চলে এলো ওই দিন, শ্রী অরবিন্দের প্রয়াণ দিবস। আমাদের সুযোগ হলো ঐদিন শ্রী অরবিন্দ এবং মা মীরার ব্যবহৃত সামগ্রী ও তাদের ঘর পরিদর্শন করার। প্রতিদিন এই ঘর সর্বসাধারণের জন্য খোলা হয় না শুধুমাত্র বিশেষ দিনেই ভক্ত সমাগম হয়। সকাল থেকেই বহু ভক্তদের সাথে আমরাও লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম এবং দর্শন শেষে ফেরার পথে ঘরের ঠিক বাইরে আছে এক বিশাল ছবি। হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম, এ এক বিরল অনুভূতি, প্রণাম করলাম, সারা শরীরে রোমাঞ্চ হল।
আমাদের গেস্ট হাউসের আশে পাশেই আছে ফ্রেঞ্চ কলোনি। কি সুন্দর সেই বাড়ি গুলো ফুল দিয়ে সাজানো, ছোট ছোট জুলিয়েট বারান্দা। হ্যাঁ এরকম স্থাপত্য আমরা প্যারিস এবং সুইজারল্যান্ডেও দেখেছিলাম। এখানে এক সময় ফরাসী উপনিবেশ ছিল, সেই একই রকম আছে সবকিছু। চলাচলের পথে একটা ছোট শপিং মল দেখতে পেলাম, নাম তার অনেস্টি।
কি মনে করে ভিতরে গেলাম, ক্যাশ কাউন্টারে যিনি ছিলেন জিজ্ঞাসা করলাম "চুড়া মিলেগা"? ভদ্রলোক বাংলায় উত্তর দিলেন। আমরা ওখান থেকে ছোটখাটো কিছু সামগ্রী কিনে ফেললাম হাতের কাছেই এত সুন্দর একটা দোকান অথচ কোথায় না কোথায় খুঁজে বেরিয়েছি । ফেরার সময় ট্রেনের চিঁড়ে দই কলা ও পাটালীর যুগলবন্দীর চিত্রটা মনের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
আমাদের বন্ধু ডাক্তার দত্তের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, ভারতের প্রথম ডাকঘর পণ্ডিচেরিতেই হয়েছিল এবং তার স্মারক চিহ্ন গড়ুরের এর পাখা এঁকে দিয়েছিলেন শ্রী অরবিন্দ স্বয়ং। আশ্রমের খুব কাছেই গণপতিজির মন্দির। রোজই আমরা দর্শন করতাম। এই মন্দির শ্রী অরবিন্দ উদ্বোধন করেছিলেন। ওই মন্দিরের সামনে একটি হাতি থাকতো এবং মন্দিরের যে কোনো মাঙ্গলিক কাজে এই হস্তী শাবকটিকে ব্যবহার করা হতো। আমরা যাওয়ার পরদিনে সে মারা যায়, ঐদিন মন্দির বন্ধ ছিল। ভক্তরা পুষ্প মাল্য দিয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিল।
আমাদের যাওয়ার দিন এগিয়ে আসছিল। পূর্ণিমা আগত সারা আকাশ জ্যোৎস্না ভরা, একদিকে উত্তাল সমুদ্র। অতি চমৎকার পরিবেশ। রফি সাহেবের গানের কলি ভেসে এলো মনে। ভাবলাম শ্রোতা যেখানে শুধুই গৃহিণী, গাওয়া তো যেতেই পারে। মন-প্রাণ ঢেলে গাইলাম, "সুহানি চান্দ ধল চুকি, না জানে তুম কব আওগী"। গান থামাতেই একটি ছেলে আমাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করল গানটির বিষয়ে। তার সুরটা খুবই ভালো লেগেছে। বললাম, এটি ৫০ এর দশকের একটি গান, হিন্দি ছবি দুলারী'র, গায়ক মোহাম্মদ রফি। ছেলেটি গানের বিষয়বস্তু জানতে চাইলো। আমার অপটু হিন্দি ভাষায় তাকে চাঁদের আলোর মাহাত্ম্য বোঝালাম। সে তো অভিভূত। বুঝতে পারলাম, এই সুর বা তাল দেশ, কাল, ভাষা কিছুই তো মানে না। হৃদয়ের টানে মিলে গিয়ে সুর ঝংকার তোলে। প্রকৃতির কোলে এই বিশ্ব চরাচরের আঙিনায় সংগীতকে উপলব্ধি করলাম।
বাড়ি ফেরার আগের মুহূর্তে থাকে কিছু কেনাকাটার পালা। গেলাম ওখানকার আশ্রমিকদের হাতে তৈরি কিছু জিনিস দেখতে। ভেষজ সাবান, শ্যাম্পু, সুগন্ধি ধূপ ও নানা সামগ্রীতে ঝুলি ভরে উঠলো। এর আগেই শ্রী অরবিন্দ আশ্রম থেকে কিনেছিলাম কিছু বই ও ছবি। নিজেদের সংগ্রহ দেখে নিজেরাই মুগ্ধ। সবাইকে উপহার দিতে খুবই ভালো লাগে। সকালে ঘুম থেকে উঠে গোছানোর পালা। ডাক্তার দত্ত বললেন, স্টেশন খুবই কাছে আমাদের সাথে তিনি যাবেন এবং সাইকেলে করে আমাদের মালপত্র নিয়ে যাবেন। তার এই অকৃত্রিম ভালোবাসার কাছে আমরা পরাজিত হলাম। না বলতে পারলাম না। যথা সময় তিনি এলেন। বললাম আমাদের একটু দেরি হবে মধ্যাহ্ন ভোজ এখনও বাকি। তিনি একটা প্যাকেট দিয়ে বললেন, "ওই যে শুনলাম মুড়ি খুঁজছেন।" অনেক কষ্টে ওনাকে আশ্বস্ত করলাম, বললাম আমাদের সাথে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বিদায় বেলার স্মৃতি কখনো তো মধুর হয় না। কিছু বিস্কুট ও মিষ্টি দিয়ে ওনাকে বিদায় জানালাম।
সময় মত ট্রেনে উঠলাম আর পরদিন দই, চিঁড়ের ফলাহার ভালো ভাবেই সম্পন্ন হল। নির্ধারিত সময়ের ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগেই হাওড়া স্টেশন পৌঁছে গেলাম, রাত তখন সাড়ে এগারো। রাত বারোটায় বাড়ি এসে গেলাম। শ্রী অরবিন্দ ও মা মীরার আশীর্বাদে, আমরা নির্বিঘ্নে বাড়িতে এসে পৌঁছালাম। আমাদের বহু কাঙ্খিত পন্ডিচেরী ভ্রমণ আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায় চির জাগরূক হয়ে থাকবে।