[১৯২৬ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর এসেছিলেন, এনেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। কবিকে কেন এনেছিলেন তিনি? শুধুই বন্ধু বলে? প্রতিভাবান কবি বলে? মাস ছয়-সাতেক গোলাপট্টিতে থেকে কবি গ্রেস কটেজে আসেন। ঠিক কবে আসেন তিনি? জুলাই, নাকি আগস্ট? কেনই বা এলেন এই বাড়িতে? ভীষণ দারিদ্র্যের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে? অনেক কিছুই আমরা জানি না, জানাও যায় না। এখান-ওখান থেকে জোগাড় করা তথ্য আর তার সাথে খানিক অনুমান মিশিয়ে টুকরো কথার কিছু দৃশ্য সাজিয়ে তোলার চেষ্টা এই কাহিনীতে।]
পর্ব - ২
গোয়াড়ি বাজার লাগোয়া গলির ভিতরে একটা লাল রঙের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো কাসেমের গাড়ি। রাস্তাটা অপ্রশস্ত, কিন্তু বাড়িটা দেখে ভালো লাগলো। একটা আলাদা বাড়ি, নাকি এজমালি টানা তিন-চারটে বাড়ির একটা অংশ বোঝা মুশকিল। গায়ে গা লাগানো লালরঙের বাড়িগুলির মধ্যে পুরনো আভিজাত্যের একটা ছাপ লেগে আছে। রাস্তা থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ির উপর দরজা, বাঁদিকে কাঠের রেলিং দেওয়া একটা বারান্দা। কাসেম আর বিজয়লাল মিলে হৈচৈ করে জিনিসপত্র নামানোর মধ্যেই দরজা খুলে যিনি বেরিয়ে এলেন, তাঁকে দেখে হেমন্ত সরকার বললেন, 'দাদা, কাজীকে এনে দিলাম তোমার জিম্মায়। কাজী, আমার দাদা জ্ঞানচন্দ্র সরকার। গুছিয়ে টুছিয়ে একটু বিশ্রাম নাও, সন্ধ্যাবেলা দেখা হবে।'
'সে তো দেখেই বুঝতে পেরেছি' বলতে বলতে নজরুল প্রণাম করার জন্য এগিয়ে গেলেন।
'আরে না, না! করেন কী?' বলে জ্ঞানচন্দ্র নজরুলকে জড়িয়ে তুলে ধরলেন।
- আপনি দাদার দাদা, আপনি আজ্ঞে করবেন না।
- বেশ, বেশ! তোমার নামী মানুষ, গুণী মানুষ আমার বাড়িতে থাকবে, সেটাই আনন্দের কথা ভাই! মাসিমা আসুন।
ভিতরে চওড়া বারান্দা, প্রশস্ত একটা উঠোন, কলতলা, বারান্দা লাগোয়া রান্নাঘর। বাঁদিকের বারান্দার শেষে উপরে ওঠার একটা সিঁড়ি আছে। দিনের বেলাতেও একটা আবছা অন্ধকার ভাব। 'কিছু অসুবিধে হলে বলবেন, আমরা উপরেই থাকি' বলে জ্ঞানচন্দ্র সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন। কি জানি কেন, ঘরদুয়ার, মানুষজনের ব্যবহার, সব মিলিয়ে গিরিবালা দেবী অনেকটা স্বস্তি বোধ করলেন। হুগলির দিনগুলির কথা মনে করলে বুকটা কেমন শিউরে ওঠে। কী সব দিনই যে গেছে!কূল-কিনারাহীন অনিশ্চিত ভাগ্যের হাতে নিজেদের সঁপে দিয়ে এক খামখেয়ালী কবির জীবনের সঙ্গে মা-মেয়েতে নিজেদের জীবনকে ভাসিয়ে দিয়েছেন। সবকিছু জেনেও পিতৃহারা মেয়েটির মনকে ভেঙে দিতে চাননি। কিন্তু নিকট আত্মীয়-স্বজনরা যে এতোটা পর করে দেবে সেটা ভাবতে পারেননি। নুরুর এতো বন্ধু, কলকাতায় এতোসব গুণগ্রাহী, তারাও কেমন আশ্চর্য রকম মুখ ফিরিয়ে রইল। দীর্ঘশ্বাস পড়ার আগেই বিজয়লালের কথায় ফাঁকা বাড়িটা যেন গমগম করে উঠল।
"মাসিমা, ফ্রেসট্রেস হয়ে একটু বিশ্রাম নিন। আজ রাতে কিন্তু আমাদের বাড়ি সবার নিমন্ত্রণ। আমি সন্ধ্যা বেলায় এসে নিয়ে যাব। বৌদি, রেডি হয়ে থাকবেন।"
- আজকেই তো এসে পৌঁছালাম বাবা। দু'দিন যাক, নিশ্চয় যাব কোনও এক সময়।
- না মাসিমা। মা বারবার বলে দিয়েছেন। অতদুর থেকে জার্নি করে এসে ঘরদোর গুছিয়ে রান্না-বান্না করার অনেক ঝক্কি। তাই মায়ের নির্দেশ
- আপনাদের ধরে নিয়ে আসতে হবে। আমি সন্ধ্যা বেলায় আসছি।
এই বলে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন বিজয়লাল।
- কই? আমার 'আল্লা-ছেলে'টা কই?
সদরের গেট খুলে বিজয়লাল 'মা' বলে ডাকতেই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছেন কিরণময়ী। পিছন পিছন বেরিয়ে এসেছেন মেজ ছেলে মিহিরলাল। দুজনে যেন এই ডাকের অপেক্ষাতেই ছিলেন।
কাসেমের গাড়ি বটতলা পেরিয়ে মোড়ের মাথায় পৌঁছাতেই শহরের চেহারাটা যেন বদলে গেল। হঠাৎ কেমন নিঝুম। গোয়াড়ির মতো কোলাহল নেই। তার উপর কনকনে ঠান্ডায় শহরের এই দিকটা যেন সন্ধ্যে হতে না হতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। দেউড়ি পেরিয়ে বেশ অনেকটা ফাঁকা জায়গা। বাড়ির সন্মুখেই একটা কাঁঠাল গাছ - আলো-আঁধারিতেও ঠিক বোঝা যায়। নিচে সিমেন্টের বাঁধানো বেঞ্চি।
- কই দেখি আমার 'আল্লা-ছেলে'টাকে! বিজয়ের কাছে কত গল্প শুনেছি তোমার। কী সুন্দর আমার বৌ-মণিটা গো! আহা, সারাদিনের ধকলে মুখ-চোখ শুকনো হয়ে গিয়েছে। আসুন দিদি, ভেতরে আসুন। হেলেন, বৌদিমণিকে নিয়ে এসো।
ইতিমধ্যে বিনুনি দুলিয়ে প্রায় লাফাতে লাফাতে হাজির হয়ে গিয়েছে চঞ্চলা কিশোরী হেলেন। দোলনের হাত ধরে কলকল করতে করতে সবার আগেই ঢুকে গেল বাড়ির ভিতর।
- কাজিদা, এই আমার ভাই মিহির।
- 'দে গরুর গা ধুইয়ে!' মিহিরলালের কাঁধে চাপড় মেরে নজরুল চেঁচিয়ে উঠলেন। 'আরে ভাই, তুমিই তো আসল ছাত্রনেতা। পুরো নদীয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছ তুমি!'
বেশ বড়সড় পুরনো আমলের বাড়ি। বৈঠকখানা বললে যা বোঝায় সেই বাহির- বাড়িতেই ছোটো বড়ো তিনখানা ঘর। কথায় কথায় জানা গেল - বিজয়লালের পিতামহ পিয়ারীলাল চট্টোপাধ্যায় সত্তর বছর আগে এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন। বিক্রমপুরের জমিদারপুত্র পিয়ারীলালকে কৃষ্ণনগরে নিয়ে এসেছিলেন বিক্রমপুরের আরেক কৃতী সন্তান মনমোহন ঘোষ। কথায় আছে - কৃষ্ণনগরে যারা আসে তারাই কৃষ্ণনাগরিক হয়ে যায়। তো জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে চাকুরি করতে এসে পিয়ারীলালও হয়ে গেলেন শহরের বিশিষ্ট নাগরিক। বাড়ির সামনের রাস্তাটাই হয়ে গেল পি এল চ্যাটার্জি লেন।
উত্তরাধিকার সূত্রে কিশোরীলালও পেয়েছেন শৌখিন ঠাটবাট আর জমিদারি মেজাজ। দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণ বলশালী চেহারা। যোগাসন, পাখি শিকার, গান-বাজনার আড্ডা, নাটকের মহড়া - কোনো কিছুতেই তাঁর উৎসাহের অভাব নাই। বাইরে কাঁঠাল গাছের নীচে ম্যারাপ বেঁধে 'চন্দ্রগুপ্ত' নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে, কিশোরীলাল নাম ভূমিকায় অভিনয় করছেন। ওদিকে অন্তঃপুরে প্রসব বেদনায় কাতর কিরণময়ী তার চোদ্দতম সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। নাটকের শেষে আঁতুড়ঘরে গিয়ে ফুটফুটে কন্যাকে দেখে উচ্ছ্বসিত কিশোরীলাল বলে উঠলেন - "এই তো, হেলেন চলে এসেছে আমার ঘরে!"
সত্যি সত্যি মেমসাহেবের মতোই চেহারা আর চালচলন হয়েছে হেলেনের। সব সময় কথার খই ফুটছে।
- বহরমপুর জেল থেকে বাড়ি এসে থেকে বড়দার মুখে শুধু কাজীদার গল্প। বাড়ির চেয়ে যেন জেলখানাতেই বেশি সুখে ছিল!
নজরুল হো হো করে হেসে উঠলেন। "তা কথাটা খুব একটা ভুল বলোনি হেলেন। হুগলি জেল আর বহরমপুরে আকাশ-পাতাল তফাৎ। তার উপর বিজয়লাল, পূর্ণ দাস আর নরেন চক্রবর্তীর মতো দিলখোলা ছেলেরা এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। জেল কি আর জেলখানা থাকে!"
বিজয়লাল বলেন - "তা যাই বলো কাজিদা, বসন্ত ভৌমিকের মতো মানুষ জেলের সুপার না থাকলে কিন্তু আমাদের এতো সুখের কিছুই হতো না। তোমাকে তিনি অন্য চোখে দেখতেন, জেলের ভিতরে তিনি নিজে তোমাকে হারমোনিয়াম এনে দিলেন। তোমার গান, আর আমাদের হৈচৈ। আহা, কয়েকটা মাস যেন কয়েক দিনেই ফুরিয়ে গেল!"
অন্তরঙ্গ আতিথেয়তা, আড্ডা আর আলাপচারিতায় অল্পক্ষণের মধ্যেই দুটি পরিবার বেশ কাছাকাছি চলে এলো। গিরিবালা দেবী অনেক স্বস্তি পেলেন। নজরুলের যা উড়নচণ্ডী স্বভাব, সংসারের কোনো কিছুই তো তার খেয়াল থাকেনা। আশেপাশে ভরসা পাবার মতো মানুষজন আছে জানলে বুকে বল পাওয়া যায়।
হৈচৈ গল্প-কথার ভিতরেই মিহিরলাল উঠে পড়লেন, "দাদা, এবারে তো আমাদের যেতে হবে।"
বিজয়লালও উঠে পড়লেন, "মা, আমরা আসছি। কাজিদা, তোমরা থাকো। কাল দেখা হবে।"
নজরুল অবাক হলেন, "আসছি মানে? কোথায় যাবে? আর আমরা ফিরব কার সাথে?"
- সেসব কথা তোমাকে বলা হয়নি কাজিদা। আমরা তো আমাদের স্বরাজ আশ্রমে থাকি। হাই স্ট্রীটে। কাল দেখাবো। আর রাতে তো তোমরা এখানেই থাকছ!"
মাঝখান থেকে হেলেন ফুট কাটার মতো বলে উঠলো, "বাবার কোর্টের আড্ডা থেকে ফিরতে দেরি আছে দাদা!"
বিজয়লাল বিরক্তি দেখিয়ে বললেন, "তাতে কী হলো? বাবা এলে আসবে! তাতে কী? আমাদের কাজ আছে!"
- ইস্! বাবার ভয়েই তো রোজ আগে আগে চলে যাস! জানেন কাজিদা, ছোটোবেলায় দেরি করে ঘরে ফিরে গেট বন্ধ দেখে বড়দা বাবার ভয়ে কাউকে ডাকেনি। পিছনে নাড়ুকাকুদের ছাদে উঠে আমাদের উঠোনে নামতে গিয়েই ধপাস্!
"মাসিমা, এই মেয়েটা সারাক্ষণ উল্টোপাল্টা বকবক করে যাবে, আপনারা মোটেও কান দেবেন না" বলে বোনকে শাঁসানি দিয়ে বিজয়লাল মিহিরকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
একটুখানি স্তব্ধতা। সবাই কিছুটা চুপচাপ। হেলেনও দরজার দিকে তাকিয়েই আছে।
(ক্রমশ)