বিবিধ

আমার দিদি - শাহযাদি



বিমল দেব


১৯৮০ সালে একজন বিদূষী মহিলার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তাঁর নাম, শাহযাদি। আমার চেয়ে বয়সে বেশ বড় ছিলেন। আমি তাঁকে দিদি ডাকতাম। ৫ নম্বর পার্ল রোডের বাড়িতে থাকতেন। এন্টালি, পার্ক সার্কাসের কাছে এই পার্ল রোড।

সপ্তাহে একদিন দিদির কাছে ইতিহাস শিখতে যেতাম, অবশ্যই অবৈতনিক। পড়াতেন গুয়াতেমালার ইতিহাস, ঘানার ইতিহাস, গুয়ান্তানামোর কথা। এইসব আরও অনেক বিষয় দিদি আমাকে পড়াতেন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। তাঁর পড়ানোর পদ্ধতি ছিল অনন্য। যেন গল্প বলছেন, আমি আলোকিত হতাম। তিনি আমার অন্যতম শিক্ষাগুরু।

শাহযাদি দিদি আমাকে সিনেমাও দেখিয়েছেন। 'হাঞ্চব্যাক অফ দ্য নতদ্রম' সিনেমাটি দেখিয়েছিলেন শিশির মঞ্চে। তখন শিশির মঞ্চে সিনেমা দেখানো হতো। সেই সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন চার্লস লটন। এক অসামান্য অভিনয়। ভিক্টর হুগোর গল্পের প্রেরণায় নির্মিত এই সিনেমা। দিদি আমাকে এই সিনেমার প্রেক্ষিত এবং চার্লস লটনের অভিনয় সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন। অনেক তথ্য দিয়ে আমাকে সমৃদ্ধ করেছেন।

তিনি বিশ্বসাহিত্য নিয়ে কথা বলতেন। চার্লস ডিকেন্স, মার্ক টোয়েন, ম্যাক্সিম গোর্কি, মায়াকভস্কি যেমন পড়াতেন, পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণের লেখা নিয়ে আলোচনা করতেন। সেই আলোচনা আজও আমার কাছে স্মরণীয়।

দিদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন কবি অর্ধেন্দু চক্রবর্তী। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ছিলেন। যদিও তিনি দিদির বাড়িতে কম যেতেন, সেখানে আমি বেশি যেতাম। গাছগাছালির ছায়ায় ঢাকা এই পার্ল রোড, পাখি ডাকতো। আমার খুবই ভাল লাগত এই পাড়া। হয়তো এখন সেই পাড়া পাল্টে গেছে। এখন সেই পাড়ায় আর যেতে ইচ্ছে করে না।

শাহযাদি দিদির কাকা ছিলেন আবু সয়ীদ আয়ুব। কাকিমার নাম গৌরী আয়ুব দত্ত। তাঁরা ছিলেন বিদ্বান, আলোকিত মানুষ। দিদির বাবা ছিলেন ডাঃ এ. এম. ও. গনি। তিনি ছিলেন গরীবের চিকিৎসক। আদর্শবান সেই চিকিৎসক ছিলেন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। দলের তরফে তালতলা কেন্দ্রের নির্বাচিত বিধায়ক ছিলেন।

দিদি 'মেইনস্ট্রিম' পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেখানে লিখতেন। এমনকি বিজ্ঞাপনও সংগ্রহ করে দিতেন। আমাদের একটি পত্রিকা ছিল। "আবর্ত" নামের সেই পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলেন আমার দিদি। দীপাঞ্জন দত্তের সম্পাদনায় "আবর্ত" প্রকাশিত হতো নাকতলা অঞ্চল থেকে। শাহযাদি দিদি কখনোই ধর্ম অথবা জাতপাত নিয়ে কথা বলতেন না। তিনি ছিলেন উদার, আধুনিক এবং আন্তর্জাতিক চেতনার মানুষ।

প্রায়-বিস্মৃত মানুষ শাহযাদি দিদি। তবে আমার কাছে তিনি আজও বেঁচে আছেন। স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছেন। পাল্টে যাওয়া কলকাতায়, শপিং মলের কলকাতায়, এই ডিজিটাল শহরে শাহযাদি দিদি হয়তো হারিয়ে গেছেন। কিন্তু আমার কাছে, আমার স্মৃতিতে আজও অম্লান হয়ে আছেন তিনি।

সেই বইয়ের ঘরে - সেই রাস্তায় আজও বেঁচে আছেন আমার দিদি। শাহযাদি দিদির মতো মানুষের মৃত্যু হয়না। মৃত্যু হতে নেই।