বিবিধ

বাঙালী দম্পতির ভারতীয় রেকর্ড



দেবাশিস সেনগুপ্ত


বিশ্বকাপের পরে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া ময়দানের চার অমর স্তম্ভ পি কে ব্যানার্জি, চুণী গোস্বামী, সুভাষ ভৌমিক আর সুরজিত সেনগুপ্তর মত পান্নালাল চট্টোপাধ্যায়ের অভাবও অনুভূত হয়েছিল ২০২২য়ের কাতার বিশ্বকাপে। আর পান্নালাল চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী চৈতালী চট্টোপাধ্যায় ১৯৭৮ সালের পরে এই প্রথম খিদিরপুরের রামকমল স্ট্রিটের বাড়িতে বসে একা একাই দেখেছেন বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলা।

বিশ্বকাপ ফুটবল দেখা যদি ধর্ম হয়, তবে আক্ষরিক অর্থে সহধার্মিক ছিলেন কলকাতার খিদিরপুরের রামকমল স্ট্রিটের বাসিন্দা চট্টোপাধ্যায় দম্পতি।

চট্টোপাধ্যায় দম্পতি বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার শুরুটা করেছিলেন ১৯৮২ সালে স্পেনের বিশ্বকাপ দিয়ে। তারপর একে একে দশটি বিশ্বকাপ মাঠে বসে দেখেছিলেন পান্নালাল চট্টোপাধ্যায় এবং চৈতালী চট্টোপাধ্যায়। জীবনের মত বিশ্বকাপ ফুটবল দর্শনেও যারা ছিলেন সহযোদ্ধা, স্বামী-স্ত্রী। ২০১৮ বিশ্বকাপেও রাশিয়ায় গিয়েছিলেন দু’জনে, খেলা দেখতে। বিশ্ব ফুটবলের প্রতি আসক্তি তাকে সস্ত্রীক নিয়ে গিয়েছিল বিশ্বের ১০টি দেশে।

১৯৮২ সালে স্পেনের বিশ্বকাপে পাওলো রোসির চমকপ্রদ উঠে আসায় ইতালির বিশ্বকাপ জেতা যখন চোখের সামনে দেখেছিলেন, তখন তার বয়েস ছিল ৪৯ বছর আর চৈতালীদেবীর বয়েস ছিল ৪১ বছর।

তারপরে ১৯৮৬তে মেক্সিকো বিশ্বকাপে মাঠে বসে দেখেছিলেন দিয়েগো মারাদোনার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ‘হ্যান্ড অফ গড’ গোল এবং ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জেতা।

১৯৯০র ইতালি বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানিকে পেনাল্টি গোলে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে জিততে দেখেছিলেন তারা স্বচক্ষে।

টাইব্রেকারে ইতালিকে হারিয়ে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জেতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন ১৯৯৪র ইউএসএ বিশ্বকাপে এবং ওই ১৯৯৪ বিশ্বকাপে ফুটবলের কিংবদন্তী পেলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাদের দু’জনের।

দেশের মাটিতে ব্রাজিলকে ৩-০ উড়িয়ে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ে জিনেদিন জিদানের বিরাট ভূমিকা তারা দু’জনে দেখেন ১৯৯৮ সালে।

জাপান-কোরিয়ার ২০০২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের কাপ পুনরুদ্ধারও তারা দেখেছিলেন, ইয়োকোহামা স্টেডিয়ামে জার্মানিকে ২-০ গোলে হারিয়ে, যেখানে স্বপ্নের ফুটবল খেলেছিলেন রোনাল্ডিনহো।

২০০৬য়ের জার্মানি বিশ্বকাপের ফাইনালে তারা দেখেছিলেন জিদানের লাল কার্ড, মাতারাজ্জিকে ঢুঁসো মেরে এবং ফলস্বরূপ টাইব্রেকারে ইতালির বিশ্বকাপ জেতা, ফ্রান্সকে হারিয়ে।

২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে তারা দেখেছিলেন নেদারল্যান্ডসকে ১-০ গোলে হারিয়ে স্পেনের জয় এবং জাভি-ইনিয়েস্তা-ক্যাসিয়াসের অনবদ্য ফুটবল।

২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে তারা দেখেছিলেন লিওনেল মেসির অভূতপূর্ব ফুটবল সত্ত্বেও ফাইনালে জার্মানির কাছে আর্জেন্টিনার ১-০ হার। অন্ধ ব্রাজিল অনুরাগী হওয়া সত্ত্বেও ২০১৪-র বিশ্বকাপে তাদের দেখতে হয়েছিল প্রিয় দলের ভয়ঙ্করতম হার। সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ১-৭ গোলে হেরে গিয়েছিল ব্রাজিল৷ মন ভেঙে গিয়েছিল পান্নালালবাবুর।

তবু ২০১৮ বিশ্বকাপেও রাশিয়ায় গিয়েছিলেন তারা দু’জনে, শেষবারের মত।দেখেছিলেন ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়, ক্রোয়েশিয়াকে ৪-২ গোলে হারিয়ে। তখন পান্নালালবাবু ছিলেন ৮৫ আর চৈতালীদেবী ৭৭।

বহু আত্মত্যাগ আর বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে চার বছর পরপর বিশ্বকাপ ফুটবলের মহাযজ্ঞে যোগদান করার রসদ নিঃশব্দে জমাতেন বৃদ্ধ চট্টোপাধ্যায় দম্পতি৷ এইভাবেই বহু কৃচ্ছসাধনের ফলশ্রুতিতেই একে একে তাদের দেখা হয়ে গিয়েছিল ১০টি বিশ্বকাপ। দীর্ঘদিনের ময়দানী অভিজ্ঞতায় দেখেছেন অনেক ওঠানামা। অনেক দলের উত্থান-পতন।

২০২২য়ের কাতার বিশ্বকাপেও পান্নালালবাবুর সস্ত্রীক যাবার প্রস্তুতি ছিল, মেসি-রোনাল্ডোদের দাপট শেষবারের মতো স্বচক্ষে দেখার জন্য। কিন্তু তার সে স্বপ্ন আর সফল হয়নি। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন তিনি। শরীর ক্রমশ খারাপ হওয়ায় মৃত্যুর কয়েকদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। সেখানেই ১৭ই ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ প্রয়াত হন খিদিরপুরের অশীতিপর বৃদ্ধ।

মোহনবাগানের অন্ধ ভক্ত ছিলেন পান্নালালবাবু, যিনি ফুটবল খেলেছিলেন মেওয়ালাল, রশিদ এবং সলিমদের সঙ্গে। শুধু ফুটবল সমর্থক হিসাবে নয়, পান্নালালবাবুকে মনে রাখতে হবে ফুটবলার হিসাবেও।কলকাতা ময়দানের প্রায় প্রতিটি ক্লাবেই যাতায়াত ছিল তাঁর। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল সেদিন কলকাতার ক্রীড়ামহলে।

কলকাতার যাবতীয় ফুটবল সমর্থককে আর একটু দরিদ্র করে দিয়ে চলে গেছেন পান্নালালবাবু। ১৯৮২ থেকে ২০১৮ - টানা ১০টি বিশ্বকাপ ভারতের হয়ে এই দম্পতি ছাড়া আর কেউ দেখেছেন বলে জানা নেই। এক অস্থির সময়ে ফুটবলে বিশ্বাস ও আস্থা ধরে রাখার জন্য কলকাতা নতজানু থাকবে তাদের দুজনের কাছে। তার জীবন ও ফুটবল দর্শনের সহযোদ্ধা চৈতালীদেবীর জন্য রইল সশ্রদ্ধ সমবেদনা।

এই জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাওয়া শুঁয়োপোকা সময়ে আমাদের স্বপ্নের উড়ানে তুলে দিয়ে পান্নালালবাবু ফুটবলের প্রজাপতি হয়ে উড়ে গেছেন না ফেরার দেশে, ফুটবলের অন্য মাঠে। যে ফুটবলে আমাদের প্রজন্ম শ্বাস নিতে নিতে বড় হয়ে উঠেছিল, তারই পূর্বসূরী ছিলেন পান্নালালবাবু ও চৈতালীদেবী। এই মনুষ্যসৃষ্ট দেশ-বিদেশ দ্বন্দ্বের দিনকালে গোটা বিশ্বকেই নিজেদের দেশ বানিয়েছিলেন চট্টোপাধ্যায় দম্পতি। ক্লাব, দেশ, কাল ছাপিয়ে একটা দুরন্ত ফুটবল সময়ের দুর্দান্ত প্রতিনিধি ছিলেন তারা।

২০২২য়ের কাতার বিশ্বকাপ, গ্যালারিতে মিস করেছে তাদের। ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও প্রণাম, এই ফুটবল প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলের জন্য।

ছবি সৌজন্যঃ সংবাদ প্রতিদিন