বিবিধ

পথিক আর পথ হারাইবে না



অনীশ চট্টোপাধ্যায়


১৮৬৬ সালে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র 'কপালকুণ্ডলা' উপন্যাসের পঞ্চম পরিচ্ছেদে লিখছেন - "জনহীন সমুদ্রতীরে তরুণী কপালকুণ্ডলা নবকুমারের উদ্দেশ্যে অতি মৃদুস্বরে কহিলেন - পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ? এ ধ্বনি নবকুমারের কর্ণে প্রবেশ করিল। কি অর্থ, কি উত্তর করিতে হইবে কিছুই মনে হইল না... রমণী কোন উত্তর না পাইয়া কহিলেন - আইস। ...নবকুমার কলের পুত্তলির ন্যায় সঙ্গে চলিলেন।"

সুধীজনের কাছে ওপরের লাইন ক'টি মোটেই অপরিচিত নয়। এখানে কপালকুণ্ডলা দিগদর্শক। পথ প্রদর্শক। আর নবকুমার ভাগ্যবিড়ম্বিত পথিক। কপালকুণ্ডলার যেখানে গন্তব্য, নবকুমারেরও সেখানেই।

আসলে ১৯৮৩ সালের আগে পর্যন্ত সারা পৃথিবীর সর্বত্র কেউ কোথাও পথ হারালে গন্তব্য খুঁজে বের করার জন্য হয় পুলিশ, নয় কোনো দোকানি বা পথচলতি মানুষ অথবা পথ-মানচিত্রের ওপর নির্ভর করতে হত। তা, যাঁরা হাঁটছেন বা গাড়ি চালাচ্ছেন, তাদের নয় পথ দেখাতে কিছু মানুষ সাহায্য করলেন (যদিও সবাই যে সঠিক পথটি দেখাবেন, বা দেখাতে পারবেন, তা নয়), কিন্তু ভাবুন তো, যিনি প্লেন চালাচ্ছেন, বা সমুদ্রে জাহাজ চালাচ্ছেন, বা খাঁড়ি পথে নৌকো বাইছেন, অথবা কোনো অভিযানে চলেছেন, তিনি যদি গন্তব্যের সঠিক অবস্থানটি বুঝতে না পারেন, তাহলে কি বিপদ! এক্ষেত্রে গন্তব্য সন্ধানের উপায় হল রেডার (রাডার) - সংকেতের ওপর নির্ভর করা। কিন্তু রেডারও সর্বক্ষেত্রে সর্বদা সবার জন্য ব্যবহারযোগ্য নয়। তাহলে উপায়?

নির্ভরযোগ্য উপায় হল ইদানিংকালে কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্য নেওয়া। ন্যূনতম তিনটি কৃত্রিম উপগ্রহ GPS পদ্ধতি অর্থাৎ 'Geographical Positioning System' বা 'বিশ্বজনীন অবস্থান নির্ণায়ক' পদ্ধতির সাহায্যে চলমান বা স্থিতিশীল অবস্থায় আপনার সঠিক অবস্থান, উচ্চতা, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমা দেখাতে পারে। আপনার আধুনিক মোবাইল হ্যান্ডসেটে সেই GPS ব্যবস্থা আছে। বড়ো বড়ো শহরের ক্ষেত্রে GPS ব্যবস্থায় আপনার ধারেকাছে পেট্রল পাম্প, হোটেল, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান ইত্যাদি আছে কিনা বলে দেয়।

১৯৮৩ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জনসাধারনের ব্যবহারের জন্য GPS পদ্ধতিটি খুলে দিয়েছে। ভারতে আমরাও GPS পদ্ধতি ব্যবহারে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। সুইগি, জোম্যাটো এই পদ্ধতির সাহায্যেই আপনাকে খাবার পাঠাচ্ছে। আপনি কোথায় রয়েছেন জানতে পারছে। ওলা, উবার-এর গাড়ি আপনার কাছাকাছি আছে কিনা এই GPS পদ্ধতির কল্যাণেই আপনি বুঝতে পারছেন।

তবে মার্কিন GPS ব্যবস্থাটি সেই দেশের সামরিক প্রয়োজনে তৈরি হয়েছে। তাই আপনি, আমি, সাধারণ মানুষ কোনো চলমান বা স্থিতিশীল বস্তুর একান্ত (accurate) অবস্থানটি এই GPS ব্যবস্থায় কখনই জানতে পারি না। এই তথ্যে সঠিক অবস্থান ও অবস্থান সম্পর্কে আপনি যে তথ্যটি পেয়েছেন, তার মধ্যে প্রায় ১০ থেকে ২০ মিটারের কাছাকাছি ফারাক থাকে। এমনকি মার্কিন GPS তথ্য সামরিক প্রয়োজনে যদি অন্য কোনো দেশ ব্যবহার করে, সেও ঈপ্সিত বস্তুর সঠিক অবস্থান জানতে পারে না। ফলে আমেরিকার GPS তথ্যের ভিত্তিতে মিসাইল ছুঁড়লে অন্য কোনো দেশের লাভ নেই। লক্ষ্যে লাগবে না। শুধু তাই নয়, সামরিক দরকারে আমেরিকা যে সেই তথ্য দেবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, যেমন - ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের সময় ভারত GPS তথ্য চেয়েও পায়নি।

তাই ভারত নিজ উদ্যোগে, নিজের কারিগরি দক্ষতায় মার্কিন GPS-এর প্রায় সমতুল ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। ভারতের GPS পদ্ধতির নাম নাবিক (NavIC বা Navigation in Indian Constellation)। ভারতের মধ্যে ও আশপাশের প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার অঞ্চলে সামরিক বাহিনী পাচ্ছে 'নাবিক' থেকে একদম সঠিক অবস্থানের তথ্য। আর আপনার আমার জন্য অবস্থানের তথ্যে সামান্য জল মেশান থাকছে। নিরাপত্তার খাতিরে।

তাতে খুব কিছু অসুবিধে নেই। আর যাই হোক পথে নেমে পথ হারানোর কোনো ভয় নেই। অন্যান্য তথ্যও সবই পাওয়া যাবে 'নাবিক' থেকে। তবে দুঃখ একটাই। নবকুমারের মতো কাষ্ঠ আহরণ করা এখনো যেতেই পারে। কিন্তু দিগভ্রষ্ট পথিকের জন্য কপালকুণ্ডলার দিন গিয়াছে।