গল্প ও অণুগল্প

বন্দিনী (অণুগল্প)



ভারতী বন্দ্যোপাধ্যায়


বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়ে চলেছে, শব্দে কান পাতা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি আর বাজ পড়ার আওয়াজে ঋতু প্রচন্ড ভয়ে কানে আঙুল দিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে আছে। প্রীতম এখনও অফিস থেকে ফেরেনি। কতদিন বলেছে ঝড়-বৃষ্টির দিনে একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে, একা ঘরে বড্ডো ভয় পায় ঋতু, কে কার কথা শোনে। জানলা দরজা বন্ধ করে ঘরে বসবারও কি জো আছে, এসেই তো হম্বিতম্বি শুরু করে দেবে, এমনি ভাব, ঘরে থেকেই ঋতু অনেক অন্যায় করে ফেলেছে, যেন দরজা খুলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে ভালো হয়। ঘরে বসে ঋতুর সারাদিন কোনো কাজ নেই, অথচ বাড়ির সমস্ত কাজ সামলিয়েও প্রীতমের হাজার প্রয়োজন তাকে মেটাতে হয়। বলতে গেলে হাজারও যুক্তি তর্ক দিয়ে ঋতুকে মানতে বাধ্য করবে যে এটাই তার উচিত, না মানার কোন কারণ থাকতেই পারে না, স্ত্রীকে সে যেভাবে রেখেছে ত্রিভুবনে আর একজনও নেই, এমনি কিছু। হাজার কাজে তুমি ব্যস্ত থাকোনা কেন প্রীতম বাইরে গেলে ঋতুকে দরজা খোলার জন্য সময় দেখে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। নিজে হাতে জামা প্যান্ট পড়া ছাড়া বোধহয় আর কিছু করতে হয় বলে মনে হয়না, তবুও তার আপত্তি অভিযোগের শেষ নেই। তা ছাড়া নিজের মতো করে বাইরে যাওয়া, মেলামেশা নিয়ে ওজর আপত্তি তো আছেই। আজই সকালে একটা কাজ করা নিয়ে চরম অশান্তি করলো, বক্তব্য একটাই চাকরি করার প্রয়োজন আসছে কেন? চাকরি করা মেয়ের কি আমার অভাব হয়েছিল? এমনি সব বাঁকা বাঁকা কথা, অথচ প্রীতম রাজি থাকলে ঋতুর একটু ভালো লাগতো।

বাজ পড়ার শব্দ কমেছে, মনটা সাত পাঁচ ভাবনায় ভারী হয়ে আছে, উঠতে ইচ্ছে করছেনা, বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে আছে। ঘরের সিলিংয়ের দিকে চেয়ে আছে এক মনে, কোনায় একটা মাকড়সার জাল। একটা পোকা আটকে আছে, চেষ্টা করছে বেরোবার, বেরোতে পারলে বোধহয় বেঁচে যেত, আপ্রাণ সেই চেষ্টাই করছে, মাকড়সাটা জাল বোনা বন্ধ করে একটু একটু করে এগোচ্ছে। কিন্তু ওখানে তো খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক, কিন্তু আমি তো খাদ্য নই। প্রীতম কি এইভাবেই একটু একটু করে তিলে তিলে ঋতুকে শেষ করবে, ভালোবেসে তো এতোদিন সংসার করেছে, সেই ভালোবাসা তো এখন বাধ্য হয়ে উঠেছে, প্রীতমের প্রয়োজনগুলো কি এইভাবেই নাগপাশে জড়িয়ে দমবন্ধ করার দিকে এগিয়ে চলেছে, চাওয়া পাওয়া প্রয়োজনের তুলাদণ্ডে জীবনকে বাজি ধরতে হবে। পোকাটা জাল থেকে ঝুলছে, মাকড়সার নাগালের বাইরে। প্রীতমের ফেরার সময় হয়ে এসেছে, এক ঝটকায় ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো ঋতু, আগেপিছে আর ভাববার সময় নেই, পোকাটাকে ধরে জানলা দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে বেড়িয়ে পড়লো।