সকালবেলা। সদ্য ঘুম থেকে উঠে কলতলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করছি, এমন সময় ফুল-ঠাকমা এসে হাজির। হাতে সাজি, পরনে সাদা থান, দুধ সাদা চুলের মাঝে লাল সিঁদুরের ঢেউ। ফোকলা মুখে হাসির ঝলক তুলে বলে উঠলেন - "কিরে খেপি, উঠে পড়লি?"
বলেই মুখে মুখে ছড়া কাটলেন - "সকাল-সকাল বিছান ছাড়/ গা গতরে ঘটবে বাড়।"
ফুল-ঠাকুমা আমায় 'খেপি' বলে। যদিও আমার ভালো নাম 'দ্যুতি'।
বলে উঠলাম - "আমায় 'খেপি' বলো আর যাই বলো, যেন আমাদের জবাগাছের সব ফুলগুলো তুলে নিয়ে যেও না। আমাদের জন্যও রেখো।"
উত্তর এলো - "তুলবো না রে, তুলবো না।" তারপর, আবার ছড়া - "আমার ঘরে কালীর পা, চারটে জবায় সাজাই তা।"
না, ফুল ঠাকমা কোন দিনও চারটির বেশি জবা নিতো না।
এই ফুল-ঠাকমা আমাদের প্রতিবেশী। একই পাড়ায় বাড়ি। ঠাকমা রোজই ফুল তুলে নিয়ে যায় আমার ঘুম ভাঙার আগেই। এইজন্য মনে মনে একটু রাগ হত বৈকি ফুল-ঠাকমার উপর।
সেদিন বৃহস্পতিবার। বাড়িতে নারায়ণ পূজো। বাড়ির জন্য তো একটু বেশি ফুল লাগবেই। কি ভেবে, সেদিন তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে, ফুল-ঠাকমা আসার আগেই বেশির ভাগ জবা ফুল তুলে নিলাম। গোটা ৪/৫ অবশ্য রেখে দিলাম ফুল-ঠাকমার জন্য। জানি, ঠাকমা তো আসবেই।
এদিকে বেলা তো অনেক হয়ে গেল। অথচ ফুল-ঠাকমা তো এলো না। এত দেরি তো কোনদিন হয় না। এমন সময়, বাবা এলেন বাজার থেকে। জানালেন এক অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ। ফুল-ঠাকমা নাকি মারা গেছেন কাল রাতে।
চমকে উঠলাম। দু'চোখ জলে ভরে গেল। পা দুটো পাথর হয়ে গেল। জবা গাছে তখন ফুল-ঠাকমার জন্য রাখা ফুলগুলো যেন হাউ-মাউ করে কাঁদছে। আমাদের বাড়ির পুজো তখনও হয়নি। কি মনে হল, আমি ঘরে-রাখা সাজি-ভরা ফুলগুলো হাতে নিয়ে ছুটলাম ফুল-ঠাকমার বাড়ির দিকে, কাউকে কিছু না বলে, ঊর্ধ্বশ্বাসে।
দেখি, ঠাকমা শুয়ে আছে বাড়ির উঠোনে। সাদা কাপড়ে ঢাকা। ফুল-ঠাকমার দু'চোখ বন্ধ। দু'পায়ে আলতা মাখানো। লাল সিঁদুরে থৈ থৈ করছে সিঁথি। আমি ভীড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে তার পায়ে সব ফুলগুলো উজাড় করে দিয়ে মনে মনে ক্ষমা চাইলাম ফুল-ঠাকমার কাছে। বললাম - "ঠাকমা, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।" চোখের জলে তখন আর ফুল-ঠাকমাকে দেখতে পাচ্ছি না। কেবল দেখতে পাচ্ছি এক ঝাঁক লাল জবার বন্যা। ফুলগুলো যেন হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে।