ভিজবে বলে শ্রীময়ী বুক চিতিয়ে শুয়ে পড়ে জিগা গাছের নীচে। পিঠের তলায় মরে যাওয়া নদীর জমিন। নদী এখন মাটি হয়েছে। গাঁয়ের মরদগুলো যে যার মতো পেশী খাটিয়ে ভাগ করে নিয়েছে মাটি। মরে গিয়ে সে এখন উর্বরা। শ্রীময়ী বোঝে বেঁচে থাকলে জল আর মরলে মাটি হওয়া যায়। এই জল আর মাটির মধ্যে শুধুমাত্র ফারাক বাতাসের। কে জানে উড়ে উড়ে কোন চুলায় ওর খবর বয়ে নিয়ে যায়। হাওয়ায় বুকের আঁচল খসে পড়লে ভাবে, 'বাঁইচ্যা আছি'। নচেৎ নিজেকে মৃত মনে হয়। তখন আবহাওয়া গুমোট। জিগার ডালে ঝটপট করতে থাকে দোয়েলগুলো। মাঝেমধ্যে দু'একটা ছোট্ট পালকও খসে এসে পড়ে ওর গায়ে। ও দেখে দিব্যি ওর হাত-পা নড়ছে। অথচ, নিজেকে মৃত বলে মনে হয়! ধীরে ধীরে বদ্ধ কুঠুরির মতো আড়ষ্ঠ হয়ে আসে ওর রক্তজালিকাগুলো। অসাড় পা দুটোর দিকে তাকিয়ে বোবা কান্নারা ভীড় করে। "আমারে বাঁইচ্যা থাইকতেই হইব্য! এট্টু জল দাও। আমারে এট্টু জল দাও গো... পলান মাঝি আইবো। আমার লিগ্যা নূপুর লইয়া আইবো... জল দাও..." বলতে বলতে শ্রীময়ী শুয়ে পড়ে মাটিতে।
এ গাঁয়ের কেউই পলান মাঝিকে চেনে না। আটচালায় বসে বাড়ুজ্জ্যে খুড়ো বলেন, তাঁর যৌবনে কোনও একদিন হঠাৎ নদীর ধার ধরে শ্রীময়ীকে এ গাঁয়ে আসতে দেখেছিল গাঁয়ের মেয়ে-বউরা। তারপর সবাই ওর দেশ, নাম, পরিবার সব জিজ্ঞেস করেছিল। বোকার মতো তাকিয়ে ছিল শ্রীময়ী। বাড়ুজ্জ্যে খুড়োকে একদিন ও ফিসফিস করে শুধু বলেছিল, "শ্রীময়ী পলানরে খুঁজতাছে"। ব্যাস, আর কখনও কথা বলেনি ও। বাড়ুজ্জ্যে খুড়োকে এ গাঁয়ের সবাই খুব মান্য করে। শ্রীময়ীকে কেউ তাড়িয়ে দেয়নি। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ও ওই জিগা গাছের নিচেই বসে থাকে।
বুধুয়া বলেছিল, রাতে শ্রীময়ীর চোখ দুটো ভাটার মতো জ্বলে। কেউ ওর কাছে ঘেঁষতে ভয় পায়। বাগদি পাড়ার দু'চারটে ছোকরা একবার জোর করেই কাছে গিয়েছিল। তারপর থেকে তাদের মণিগুলোও স্থির হয়ে যায়। তারা শুধুই জল চাইতো। গাঁয়ের বদ্যিও কিছু করতে পারেননি। তে-রাত পেরোয়নি আর।
রাতে শ্রীময়ীর স্থান হয়েছে এখন আটচালায়। কেউ না কেউ পালা করে একবাটি ভাত ওকে দিয়ে আসে ঠিকই। বাড়ুজ্জ্যে খুড়ো বলেন, "মরা নদীতে যেদিন বাণ আইবো, সেই জলে নাও লইয়া পলানও আইবো। সবুর কর।" শ্রীময়ী অপেক্ষা করে আর নির্বাক তাকিয়ে থাকে বাড়ুজ্জ্যের দিকে। "এই নদীতে যেদিন জল আইবো, সেদিন বাড়ুজ্জ্যে পলান হইয়া যাইবো। আমারে অপেক্ষা করতে হইব্য। অপেক্ষা। জলের অপেক্ষা।" শ্রীময়ীর এসব উচ্চারণ কেউ কোনওদিন শোনেনি।
এখন আটচালা থেকে নদীর চড় অব্দি হেঁটে যেতে বড় কষ্ট হয় শ্রীময়ীর। শরীরটা ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। শীর্ণকায়। পাটের মতো চুল ওড়ে বাতাসে। জিগার নীচে বসে থাকতে থাকতে কখন যেন ঝিমুনি এসে গিয়েছিল ওর। বাতাসই এসে খবর দিলো বাড়ুজ্জ্যে মাটি হবে। ঘ্রাণে ভাসছে পলান মাঝি আর জলের সুবাস। এত বছর পরে শ্রীময়ী কথা বললো, "বাণ আইবো..." বাতাস শুনতে পেলো। বাড়ুজ্জ্যের দেহ কাঁধে করে নিয়ে যেতে যেতে সবাই দেখতে পেল জিগার নীচে নিষ্পলক পড়ে আছে শ্রীময়ী। সে দল থেকে দু'একজন বেরিয়ে এগিয়ে এলো শ্রীময়ীর দিকে। বাঁধের ঢালু বরাবর নেমে জমিতে পা রাখতেই, পা যেন গেঁথে যাচ্ছে কোনও জলাভূমিতে। চোরাবালির টান। কোনোক্রমে চিৎকার করতে করতে গাঁয়ের লোকেরা টেনে হিঁচড়ে তুললো ওদের। ওপাশে ধীরে ধীরে ডুবে যেতে লাগলো শ্রীময়ীর নিথর দেহ, মাটির ভাগ, আল, সবুজ জমিন। জিগার গা ঘেঁষে ফুটে উঠলো আস্ত একটা নদীর শরীর।
শ্রীময়ীর মনে হলো, "এতদিনে বাঁইচ্যা উঠলাম। কত জল! পলান মাঝি আইবো। নূপুর পইরা জল ছপছপ কইরা খেলুম।" শ্রীময়ী হেসে ওঠে খিলখিল করে। বাতাস বয়ে যায় জলের ওপর দিয়ে। তিরতির করে জলে দাগ কাটে হাওয়া। নদীর পাড়ে বাড়ুজ্জ্যের দেহ দাউদাউ করে জ্বলে ছাই হয়ে যায়। ছাই ভেসে যায় জলে। জলের নীচে জেগে ওঠে পলান মাঝির নৌকো। পাটাতনের বিছানো নূপুর। শ্রীময়ীর জন্য...