সুদীপ্ত রাত্রে বিছানায় শুয়ে পলকহীন দৃষ্টিতে বেড়ার ফাঁক দিয়ে চাঁদের দিকে চেয়ে থাকে। 'গোল চাঁদের দিন' আলোয় ভরা আকাশ তার চোখের ঘুম কেড়ে নেয়। বেড়ার ফাঁক গলে আসা জ্যোৎস্নায় ঘর আলো হয়ে থাকে। এই আলো মুছে গিয়ে যেদিন অন্ধকারে ঢেকে থাকে রাতের আকাশ, চোখ বন্ধ করে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে বিছানায়। ল্যাম্পের আলোয় ঘরের ভেতরটা আলো-আঁধারি পরিবেশ, কেমন যেন ভয় ভয় করে। জ্যোৎস্না রাতে চাঁদের ভাঙা-গড়ার কারিগরকে দেখার জন্য তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ অবসন্ন হয়ে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে সুদীপ্ত। চাঁদকে ভাঙেই বা কে? আর গড়েই বা কে? উত্তরটা তাকে জানতে হবে। লাজুক প্রকৃতির ছেলে হলেও চম্পা দিদিমণির কাছে কোনো সংকোচ নেই। স্কুলে গিয়ে একপাশে বইয়ের পাতায় চাঁদের উপর হাত দিয়ে বসে ছিল সেদিন। দিদিমণি কাছে যেতেই জিজ্ঞাসা করে বসল, "ও দিদিমণি, চাঁদকে কে গো ভাঙে-গড়ে"?
দিদিমণি পড়ে গেল মহা ফ্যাসাদে। একটু ভেবে বলল, "চাঁদকে ভাঙাগড়ার কারিগর কে তা জানতে হলে মন দিয়ে লেখাপড়া করতে হবে বাবা। তবেই জানতে পারবে।"
"মন দিয়ে লেখাপড়া করলে সব কিছু জানা যায়?"
"হ্যাঁ, জানা যায়।"
"তাহলে আজ থেকে আমি খুব মন দিয়ে লেখাপড়া করব দিদিমণি।"
"করবে বৈকি। পড়াশোনা করে মস্তবড়ো মানুষ হতে হবে সুদীপ্ত।"
জানার অপার কৌতূহল নিরসনের জন্য পাঠ্যবই ছাড়াও যেখানে যে বই পেয়েছে গোগ্রাসে পড়েছে এই ভেবে, তাকে জানতে হবে। তার চারিদিকে কেন এবং কীভাবে এত কিছু ঘটে চলে!
খিচুড়ি স্কুলের দিদিমণি শৈশব থেকেই তার জানার অসীম কৌতূহলকে খুঁচিয়ে দেয়। ডাগর চোখ দু'টি যেন কল্পনার আধার। জানার আর বোঝার নিরন্তর প্রচেষ্টা চলতে থাকে। হঠাৎই কেমন যেন একটা অশুভ ছায়া তাকে গ্রাস করে বসল। বালক সুদীপ্তর কঠিন লড়াই শুরু হল।
লড়াইটা শুরু হয়েছিল গ্রামের স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে শহরের স্বপ্নের স্কুলে ভর্তি হবার দুই বছর পর। গোড়ালির নীচে ক্ষয়ে যাওয়া চপ্পল পরে ফটাস্ ফটাস্ আওয়াজ তুলে হাঁটাকে 'অভদ্রতা বলে' পঞ্চম শ্রেণিতে এসে প্রথম শুনল শ্রেণিশিক্ষক ও কিছু সহপাঠিদের কাছে। শিক্ষক/ শিক্ষয়িত্রীদের 'তুমি' নয় 'আপনি' বলতে হয়। 'তুমি' বললে, অসম্মান করা হয়। বলে ফেলার জন্য তিরস্কার বা বিদ্রুপ জুটেছে যথেষ্টই। গ্রামের স্কুলে শহর থেকে আসা প্রিয় মাস্টারমশাই তাকে কখনও বলেননি এ-সব কথা। টেবিলটাকে দু'হাতে চেপে ধরে মাস্টারমশাইয়ের দিকে ঝুঁকে কথা বললেও নিষেধ করেননি। অনায়াসে মাস্টারমশাই দিদিমণিকে তুমি বলেছে। নিজেকে একটু একটু করে শহরের স্কুলে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। চপ্পলের ফিতে শহুরে সহপাঠীর বুটের মাথা দিয়ে চেপে ধরায় বেরিয়ে এলে, পা থেকে চপ্পল হাতে তুলে, ঠেসে ঠেসে ফিতে পরিয়ে পায়ে গলিয়ে নিয়েছে। তাদের তাচ্ছিল্যের চাহনির সঙ্গে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ কোনো কিছুই পরোয়া করত না সুদীপ্ত। মনে মনে বলত, "দেখে নেবো রেজাল্টের সময় আর খেলার মাঠে। দেখবি, তোদের পিছনে ফেলে পৌঁছে যাব আগে"।
তরতর করে এগিয়ে যাবে স্কুলজীবনের শেষ ধাপে। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়। তারপর একটা চাকরি। অভাব থাকবে না সংসারে। কোথা দিয়ে কী যেন হয়ে গেল! গ্রীষ্মের দুপুরে সিঁদুর রাঙা লিচু দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনি সেদিন। তরতর করে গাছে উঠেছে। কোমরে বাঁধা গামছায় লিচু ছিড়ে রাখছে। খবর পেয়ে মালিককে লাঠি নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে, তরতরিয়ে নামতে গিয়ে ঘটে গেল অঘটন।
সেই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে কঠিন লড়াই শুরু হল। এই লড়াইয়ে মা-বাবা পাশে থেকেছে। কখনও বিরক্তি প্রকাশ করেনি। খোঁড়া, পঙ্গু বলে কতজন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। পরোয়া করেনি তাদের কথার। বরং কড়াভাবে শুনিয়ে দিয়েছে, "পঙ্গু হয়েও আমি যা পারি, তোরা তা পারিস?"
একবগ্গা সুদীপ্তর জেদ, "কিছুতেই হারবো না।" জীবনের দৌড়ে ওকে জিততেই হবে। জিতবেই! কোমর থেকে অসার ছেলেটি কৃতিত্বের সঙ্গে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজের গণ্ডি অতিক্রম করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-প্রশিক্ষণ নিয়ে মানুষ তৈরির কারিগর হবার স্বপ্নে দেখে। প্রেম এল জীবনে। স্বপ্নের জাল বোনে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেই প্রিয় স্যার সবসময় সাহস ও উৎসাহ যুগিয়েছেন। "ভয় কী? আমরা অনেকে আছি তোর পাশে। তোকে জয়ী হতেই হবে।" লড়াইয়ের রসদের অপ্রতুলতা ছিল না। মানুষের দেওয়া বল-ভরসা, বিধাতা বোধহয় আড়ালে দাঁড়িয়ে হেসেছিলেন।
জ্বর! প্রচণ্ড জ্বর! জেলা শহরের নার্সিংহোম থেকে হাসপাতাল, হাসপাতাল থেকে নার্সিংহোম। ভাল্লুকে জ্বরের কোন হদিস পাচ্ছেন না ডাক্তারগণ। রেফার মহানগরীর হাসপাতালে। সিট খালি নেই। হাসপাতালের দোরে দোরে একসপ্তাহ ঘুরেও কোথাও জায়গা হল না। রাজনৈতিক নেতার সুপারিশেও না। আসলে সিট নেই, দেবে কোথা থেকে।
পরিবারের লোকেরা লড়ে যাচ্ছে কিছু মহানুভব মানুষের সহযোগিতায়। মনোবল, অর্থবল তলানিতে ঠেকেছে। আশা ছাড়েনি সুদীপ্তের বাবা-মা। ছেলেকে সুস্থ করে তুলতেই হবে, না হলে এতদিনের লড়াই বৃথা! বাবা আইসিইউতে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছে, "মনের জোর হারাসনি সুদীপ্ত। তুই হেরে যাওয়া মানে আমাদের সবার হেরে যাওয়া"।
সুদীপ্ত বাবার হাত চেপে ধরে, চোখের কোন দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। জ্বরের কিনারা হয়নি। শরীরের বেশিরভাগ অংশই ব্যাণ্ডেজে মোড়া।
জগৎ-সংসারের লড়াইয়ে নির্মেদ কৃষ্ণবর্ণের বালকের ঝোঁক ছিল শুধু আগে পৌঁছতে হবে। পৌঁছে ও গেছে। ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার, ২০০ মিটার, ৪০০ মিটার - ফাস্ট প্রাইজ ওর জন্য বাঁধা। সুদীপ্ত যখন দৌড়তো পায়ের পাতা মাটি ছোঁয়া যেন মুহূর্তের জন্য। স্ত্রস্ত হরিণীর মতো দৌড়। ভোকাট্টা ঘুড়ি ধরার জন্য রেললাইন ধরে ছুটতে থাকা বালক সুদীপ্তের সঙ্গীরা কিছুতেই তার নাগাল পেত না।
আজ থেকে সাদা কাপড়ে ঢাকা সুদীপ্তকে ইহজগতের কেউ ছুঁতে পারবে না। কখনই নয়।