“যে জীবনগুলো আমরা পাইনি তার জন্য শোক করা সহজ। সহজেই আমরা ভাবি যদি আমাদের অন্য কোনো প্রতিভা থাকতো, যদি কিছু সিদ্ধান্ত অন্যভাবে নিতে পারতাম। সহজেই আশা করি, আমরা আরও কঠোর পরিশ্রম করতে পারতাম, আরও ভালোবাসতে পারতাম, টাকা-পয়সা খরচ করতাম আরও হিসাব করে, রাজি হতাম কফি ডেটে কিংবা ইয়োগাটা আরও বেশি করে করতাম।"
জীবন নিয়ে এই আফসোসগুলো হয়তো আমাদের সবারই আছে। জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এসে এসবের মধ্যে ডুবে যাই আমরা।
এমনি আফসোসে ভুগছিল ‘দ্য মিডনাইট লাইব্রেরি’র মূল চরিত্র নোরা সিড। যে তার জীবন নিয়ে প্রচণ্ড হতাশ ছিল। জীবনে নেওয়া প্রত্যেকটি সিদ্ধান্তই তার কাছে ভুল মনে হতো। যেমন ভালোবাসার মানুষটাকে কেন শেষ পর্যন্ত বিয়ে করলো না। গানটা কেন ছেড়ে দিলো। সাঁতারটা কেন ধরে রাখলো না। এরকম আরও বিভিন্ন বিষয়।
এসব আফসোস আর অনুশোচনায় ভুগতে ভুগতে সে একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে মুক্তি চায় এই জীবন থেকে। কিন্তু চাইলেই কি মুক্তি পাওয়া সম্ভব?
ওষুধগুলো খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সে নিজেকে একটি আলাদা জায়গায় আবিষ্কার করে। আর সেখানে দেখা মেলে তার স্কুলের লাইব্রেরিয়ান মিসেস এলমের সাথে। নোরা যখন তাকে জিজ্ঞাসা করে, সে কোথায়?
মিসেস এলম তাকে বলেন, "সে এখন আছে জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি একটা লাইব্রেরিতে।" মিসেস এলম তাকে আরও জানান, "এখানকার প্রত্যেকটা বই তুমি চাইলে বাঁচতে পারতে এমন জীবন উপভোগ করার সুযোগ দেয়। কিছু সিদ্ধান্ত অন্যরকম হলে তোমার জীবনে সেটার ফলাফল কেমন হতো তা তুমি দেখতে পারবে। তোমার অনুশোচনাগুলো পরিবর্তনের সুযোগ পেলে তুমি কি সেগুলো শুধরে নিতে চাও?"
কেই বা না শোধরাতে চাইবে? যথারীতি নোরাও হ্যাঁ বলে। এরপর মিসেস এলম নোরার দিকে একটি বই এগিয়ে দেন। যেখানে নোরার জীবনের সকল আফসোসগুলো লেখা আছে। নোরা এর মধ্য থেকে একটি একটি করে জীবন বাছাই করে সেই জীবনে যেতে চায়।
ও হ্যাঁ, এর মধ্যে আবার শর্ত আছে। নোরা একটা জীবনে ততক্ষণই থাকতে পারবে যতক্ষণ না তার সেই জীবন আবার আগের মতো হয়ে উঠছে। ততক্ষণ সে সেটা উপভোগ করতে পারবে যতক্ষণ না এটা অসহনীয় হবে।
নোরা একের পর এক জীবন বাছতে শুরু করে। প্রথম প্রথম নোরার এই নতুন জীবন ভালো লাগে। তবে কিছুদিন না যেতেই সেই জীবন তার কাছে আবার দুঃসহ মনে হয়। দেখা যায় প্রায় প্রতিটি জীবনের অনুভূতিগুলো একইরকম। একই রকম যন্ত্রণা সে পাচ্ছে। কখনো কখনো দমবন্ধ হয়ে আসছে, মরে যেতে ইচ্ছে করছে। শেষমেশ দেখা যায় সেই একইরকম দূর্বিষহ হয়ে ওঠে। কীভাবে?
জীবনগুলো কি তবে একই রকমের হয়?
দেখা যায় যে, কোনো একটা সিদ্ধান্ত অনেকগুলো সিদ্ধান্তের পরিপন্থী। যেমন দেখা যায় যে, যদি ও জীবনে সফল হতো, তবে ওর ভাই মারা যেত। কোনোটাতে ওর মা মারা যেত। তাহলে কী লাভ হলো? এসব ঘটলে তো ও আর ভালো থাকতে পারতো না।
দেখা যায় যে, কোনো জীবনে সে বিখ্যাত সাঁতারু, কোনো জীবনে গৃহহীনদের স্বেচ্ছাসেবক। কোনো জীবনে মন্ট্রিয়লে মিউজিক শেখায়। কোনোটাতে কলেজের ফিলোসফির টিচার। লাইফে খ্যাতি, প্রতিপত্তি সবই আছে।
তারপরেও সেখানে কোনো না কোনো দুঃখ আছে। সেখানেও এমন দুঃসহ কষ্ট হচ্ছে।
এই জীবনে সে একটা ছেলেকে মিউজিক শেখায়। নিজের বিভিন্ন দুঃখ-কষ্টের জন্য একসময় সেটা বন্ধ করে দেয়।
অন্য জীবনে গিয়ে দেখা যায় যে, সেই ছেলেটা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে চুরি করে। তখন তার মিসেস এলমের একটা কথা মনে হয়, "প্রতিটি জীবনে আমাদের লক্ষ লক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেই সিদ্ধান্তের ফলাফলগুলো আমাদের নিজেদের জীবনে যেমন ভিন্ন হয়, অন্যদের জীবনেও সেসবের ফলাফল ভিন্ন হয়!
তখন তার মনে হয়, ছেলেটা যদি মিউজিক শিখতো, তার কোনো প্যাশন নিয়ে থাকতো। তবে হয়তো এমন হতো না। নোরা সুইসাইড করার আগে যে বিষয়টাতে সে খুব বেশি কষ্ট পেয়েছিল, সেটা হচ্ছে তার পোষা বিড়ালটা মারা যাওয়াতে। কোনো এক জীবনে গিয়ে সে এটারও একটা ব্যাখা পেয়ে যায়।
এভাবে ধীরে ধীরে তার জীবন থেকে আফসোসগুলো মুছে যেতে থাকে। সে বুঝতে পারে, সবকিছুরই কোনো না কোনো কারণ থাকে। 'নিখুঁত জীবন' বলে আসলে কিছু হয় না।
আমাদের জীবনটা আসলে এরকমই। যা আমরা পাইনি তার জন্য আফসোস করি। কিন্তু শেষমেশ সব জীবন ওই একইরকম। একই রকম দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রনায় ভরপুর। সব জীবনেই কষ্ট আছে। তা সেই জীবন যতই সফল হোক না কেন, সেখানে যাই থাকুক না কেন।
আমাদের স্বপ্নের অন্য জীবনগুলো ভালো হতো না খারাপ, তা আমরা বলতে পারবো না। সেটা যেমন সত্য, নিজের জীবনটাও তেমন সত্য। আর মনোযোগটা সবসময় নিজের এই জীবনের উপরই রাখতে হয়।
একজন মানুষ সব জায়গায় যেতে পারে না, সবার সাথে দেখা করতে পারে না, সব ধরণের কাজ করতে পারে না। অথচ যে-কোনো জীবনে আমরা অনুভূতিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি। অনুভবের মাধ্যমে সবকিছুই পাওয়া সম্ভব।
আলবেয়ার কাম্যুর একটা কথা আছে, "বাঁচো। এটাই একমাত্র সূত্র"।
এখনও পর্যন্ত আমিও জীবনে এই একটা কথাই বুঝেছি, "বেঁচে থাকাই জীবন, এই জীবনটাকে টিকিয়ে রাখাকেই জীবন বলে"।
দ্য মিডনাইট লাইব্রেরি
লেখকঃ ম্যাট হেইগ
মৌসুমী মৌ