বিবিধ

আত্মবোধ



চিরঞ্জীব হালদার


গত ১ জুলাই, '২৩ থেকে আজ পর্যন্ত শুধুমাত্র চারটি লেখা কপালে জুটেছে। সাধারনত ১৪-১৫টি কবিতা বিগত ১০ বছর এই চোদ্দ দিনে গড়পরতা লিখেছি।

'রাইটার্স ব্লক' বলে যে শুষ্ক রীতির সম্মুখীন হন দৈনিক লিখন কর্মে যুক্ত লেখকরা, আমারটা তেমন নয়।

আমার কাছে লেখা এক পদ্ধতিগত অভ্যাস।

নিত্যকর্মের মধ্যে লিখন কর্ম একটি অবশ্য কর্ম।

বিগত ১৫ দিন কবিতা সংগ্ৰহের দ্বিতীয় খসড়ার সংশোধনে সময় ব্যয় হয়েছে।

যান্ত্রিকভাবে লিখন ইচ্ছাকে না-ইচ্ছার নিগড়ে আটকে রেখেছিলাম।

এই অবসরে আমার লেখায় রিপিটেসন বা একঘেয়েমিতার দোষ ও কিছুটা হলেও ঝরে যাবে বা তার সম্ভাবনা ধণাত্বকভাবেই থাকে। যদিও অনেকের একই ভাবনা, অনিচ্ছাকৃত সব লেখায় বারবার এসে যায়, যা এক মহৎ লেখার শত্রু। এই ব্যাপারে সচেতন থাকতে হয়। ছিলামও।

বিভিন্ন সাংসারিক প্রতিকূলতাও লেখার অন্তরায়। যদিও আমি আমাকে প্রস্তুত করেছি এমনভাবে, যে কোনো পরিস্থিতিতে 'লেখক মোডে ' চলে যেতে পারি।

এটা এক যান্ত্রিক অবস্থান থেকে রপ্ত করা। এক 'না কবিতার অবস্থান' আর দুই 'লিখন অবস্থান'।

প্রথম অবস্থানে চোর, ছ্যাঁচোর, লুম্পেন, ভালো সাংসারিক বা অফিস আধিকারিক ইত্যাদি প্রত্যেকের এমন দশায় দিন গুজরান হয়। সুযোগ পেলেই তুর্কি সেনার মত আমি দ্বিতীয় অবস্থানে প্রাপ্ত হলেই কবিতা ঢুকে যায় মগজে। সে ভীড় বাসে বা রেলে বা ধর্মবিয়োজন যে অবস্থানেই হোক না কেন।

এমন কি ৩৫ বছর আগে বাবাকে আগুনে সঁপে দেওয়ার পরও কবিতা লিখন ভাবনায় পৃক্ত থেকেছি।

তবে তুমি সুখী অবস্থানে তোমার লেখা লিখবে না চরম দূর্ভোগ পোহানোর মধ্যে দিয়ে সেই পরম লেখাটি অধিগত করবে, এটা সবটাই তোমার উপর। মহৎ লেখা হতেই পারে আবার ভুরি ভুরি নাও হতে পারে।

চুরির অবস্থানে, চরম অবৈধ অবস্থানে বা দস্তয়ভস্কির সেই অমর উপন্যাসের কথা ভাবুন, যা লেখকের যাত্রাপথ। যা লেখার সময় বন্ধ দরজার বাইরে দাদন দেওয়া প্রকাশকের লোকজন কড়া নজর রেখেছিল উপন্যাস না লিখে তিনি যেন ফাঁকি দিয়ে পালাতে না পারেন।

কোন লেখা মহৎ লেখা হবে, কালোত্তীর্ণ বা চিরকালীন হবে, সেটা কোনো লেখকের পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। লেখার ভেতর দিয়ে লেখকের স্তর নির্ণীত হয়ে যায়। যেমন পরীক্ষার আগেই শিক্ষকেরা বা বিদ্যালয় জানতে পারে, কারা ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ, তৃতীয় বিভাগে যাবে, এইভাবে তাদের স্তর আগে থেকেই নির্ণীত হয়ে যায়। তেমনই লেখকদের মধ্যে কারা প্রথম সারির, কারাই বা দ্বিতীয় সারির, পাঠকেরা চিহ্নিত করে নেয়। অন্যদিকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে কে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় অথবা কারা প্রথম দশ জন বা একশো জনে থাকবে, তা যেমন আগাম বলা যায় না, তেমনি কোন লেখা কালজয়ী বা চিরকালীন হবে, তাৎক্ষণিকভাবে তা বলা যায় না, সময়ের ওপর সে ভার ছেড়ে দিতে হয়।

এবার একটা ঘটনার কথা বলি, আমার লেখা পড়ে এক পাঠক বলেছিলেন, "আমার কাছে, আপনি অন্য এক জীবনানন্দ।" আমি লজ্জিত হয়ে বলেছিলাম, আমার একটা বই বইমেলায় পুরস্কৃত হয়েছে। উনি বললেন, "আপনি পুরস্কৃত হলেন বা না হলেন সেটা অপ্রয়োজনীয়, আপনার কলম, আপনার জাত চেনাবে।" আমি আরও লজ্জিত হলাম। তিনি আরও বললেন, "লেখনীর অভিমুখ যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হয়, তা হয়ত দু'চারজনকে খুশি করবে, অন্তিমে তা চূড়ান্ত ব্যর্থ হতে বাধ্য। লড়াইটা শুধুমাত্র নিজের সঙ্গে, নিজের মধ্যে সমাহিত হয়ে, নিজের অন্তঃস্থলে অন্তস্থ হয়ে লিখে যাও, লেখার আনন্দে, সৃষ্টি কর নব নব উল্লাসে। কবির পরিচয় তার প্রাসাদে নয়, বিত্তে নয়, বিজ্ঞাপনে নয়, স্তাবকে নয়, পুরস্কারে নয়, একমাত্র পরিচয় তাঁর কলমে, তাঁর লেখনীতে। বাঁদিকে হাঁটলে বাংলার বিবেক হওয়া যায়, ডান দিকে হাঁটলে রাজ্যসভার সাংসদ হওয়া যায়। আপনি কি একটু সরতে চান? তাহলে কলম ফেলে দিয়ে, মুদির দোকান খুলুন, হিসেবটা অন্তত ভালো জানা হয়ে যাবে।"