বিবিধ

পথ হল অবসান



শিখা কুমার


বাইশে শ্রাবণ ১৩৪৮, বৃহস্পতিবার, রাখি পূর্নিমার শেষ লগ্নে জোড়াসাঁকো।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সারারাত কেটেছে ঘুমহীন। ভোর চারটে বাজতে না বাজতে সেই বাড়িতে গাড়ি, আত্মীয়-স্বজনদের আনাগোনা বেড়েছে। চারিদিকে কেমন একটা অস্বস্তিকর অস্থিরতা। শুরু হয়েছে ব্রহ্মসংগীত, তার আগে থেকে চলছে ঈশ্বর উপাসনা।

সকাল সাতটায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় খাটের পাশে বসে উপাসনা করলেন। পন্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী এসে পায়ের দিকে মাটিতে বসে ঔপনিষদিক মন্ত্র উচ্চারণ করলেন, "ওঁ পিতা নোহসি, পিতা নোবোধি, নমস্তে হস্ত মা মা হিংসী"। খানিক পরে এলেন বিমলানন্দ তর্কতীর্থ। তিনি কাতর গলায় বললেন, আমি কিছু করার সুযোগ পেলাম না, শেষ ওষুধটা দিতে অব্দি পারলাম না। ডাঃ জ্যোতিষ চন্দ্র রায় তখন কবিগুরুর নাড়ি ধরে বসে আছেন। কিছুক্ষন পরে ডাঃ অমিয় সেন এসে নাড়ি ধরলেন, কিন্তু কব্জিতে না পেয়ে কনুইতে খুব কষ্ট করে পেলেন, গতি অত্যন্ত ক্ষীন।

বেলা ন'টায় অক্সিজেন দেওয়া শুরু হলো। নিঃশ্বাস ক্ষীন থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে, পায়ের তলার উষ্ণতা কমে আসছে। ভিতরে বাইরে একটানা উপাসনা চলছে। কবির কানের কাছে মুখ এনে শোনানো হচ্ছে, "শান্তম শিবম্ অদ্বিতীয়ম্"। সকাল সাড়ে দশটায় কোরামিন ইনজেকশন দেওয়া হল। পা দু'টো ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে আসছে। হৃদস্পন্দনও স্তিমিত হয়ে আসছে। কবির কষ্ট হচ্ছে দেখে বেলা বারোটা নাগাদ অক্সিজেন খুলে দেওয়া হল। ঠিক শেষ মুহুর্তে কবির ডানহাতটা কাঁপতে কাঁপতে কপালে ঠেকাতেই পড়ে গেল, ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় বারোটা বেজে দশ। হৃদস্পন্দন থেমে গেলো চিরতরে।

এরপর সাজানোর পালা। বাঙালির শেষ মহারাজার বিদায় রাজকীয় হওয়া চাই। সকাল থেকে নন্দলাল বসু কাঠমিস্ত্রীদের নিয়ে কাঠের পালঙ্ক তৈরি করছেন। তিনি শান্তিনিকেতন থেকে ছুটে এসেছেন গুরুদেবের শেষ শয্যা তৈরী করতে।

স্নান পর্ব শেষ, নাতনি নন্দিনীদেবী কবিকে পরিয়ে দিলেন দুধসাদা বেনারসী জোড় ও গরদের পাঞ্জাবি। আজানুলম্বিত হল শুভ্র উত্তরীয়। ললাটদেশ চর্চিত শ্বেত চন্দনে। বুকের ওপর থাকা ডানহাতে রানী চন্দ ধরিয়ে দিলেন পদ্মফুল। শান্ত সমাহিত মুখে কষ্টের চিহ্নমাত্র নেই। ভালো করে সাজানোর আগেই ঘরে হুড়োহুড়ি করে ঢুকে পড়ল ভক্তরা। বেলা তিনটেয় কবির দেহ নীচে নামিয়ে সুসজ্জিত পালঙ্কে শুইয়ে দেওয়া হল। তারপর জনসমুদ্রের ওপর দিয়ে যেন একটা ফুলের নৌকা ভেসে চলল। চলল এই মহামানবের দেহ নিমতলা মহাশ্মশানের পথে। শ্রাবণী আকাশ বাতাস মুখরিত স্লোগানে -
জয় বিশ্বকবির জয়, জয় কবিগুরুর জয়, জয় রবীন্দ্রনাথের জয়...।

(সংগৃহীত)