গল্প ও অণুগল্প

স্বপ্নশয্যা



অচিন্ত্য সাহা


গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে সুরমা ও অমিতের বিয়ে হয়। সুরমা এ বিয়েতে প্রথমে রাজি ছিলো না। ওদের বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে আদিবাসী পল্লী, লোকে বলে - 'ডোম পাড়া'। ওরা দারিদ্র্যসীমার অনেক নীচে বাস করে। সুরমা টিউশানির ফাঁকে ডোম পাড়ায় যায়। ছোটো ছোটো অসহায় মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে ওর মন কাঁদে। এদের না আছে কোনো জীবিকার সংস্থান না আছে লেখাপড়ার সুযোগ। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েগুলো কখনো কাগজ কুড়িয়ে, কখনো কাগজের ঠোঙা বানিয়ে সেগুলো বাজারে বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে। মায়েরা বাড়ি বাড়ি বাসন মাজার কাজ করে, বাবা কোনো দোকানে বা গোডাউনে কাজ করে। সুরমার ইচ্ছে এদেরকে লেখাপড়া শেখাবে। বিয়ে করলে ওর স্বাধীন সত্তা নষ্ট হয়ে যাবে। তখন কেবল সংসার, সন্তান পালন আর বাকিদের সেবাযত্ন নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে। ওর স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। সংসারের ঘেরাটোপ থেকে কী ও বেরোতে পারবে? অমিত কী ওর স্বাধীন চিন্তা-চেতনার সমব্যথী হবে? ওর সাথে কথা বলা দরকার।

অমিতের সঙ্গে দু'দিন একান্তে কথা বলে বুঝেছিল আর যাইহোক মানুষ হিসেবে অমিত খুব একটা খারাপ নয়। নিজের বলতে দূর সম্পর্কের এক দিদি ছাড়া আর কেউ নেই। কোন ছোটোবেলায় তার মা-বাবা মারা গেছেন। তারপর থেকে এই দিদির আশ্রয়েই বড়ো হয়েছে। তবে একথাও সত্যি যে একজন মানুষ কে ভালোভাবে চেনা ও জানার ক্ষেত্রে মাত্র দুটো দিন যথেষ্ট নয়। সুরমা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। গণিত বিষয়ে সাম্মানিক নিয়ে মহাবিদ্যালয়ের পাঠ সম্পন্ন করার পর স্নাতকোত্তর পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হয়নি। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তির জন্য যে নম্বর পাওয়া দরকার সুরমার প্রাপ্ত নম্বর সেই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। পড়াশোনার জন্য বাড়ি থেকে তেমন জোরাজোরিও করেনি, তাই ওখানেই সুরমার পড়াশোনায় ইতি টেনে দেওয়া হয়েছে। বি এড করার ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করলেও সেটা তার মনের গোপন কুঠুরিতে চাপা পড়ে গেছে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবেদন পত্র সংগ্রহও করেছিলো কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে সেটা জমা দেওয়া হয়নি। নিজের হাতখরচ চালানোর জন্য দুই-একটা টিউশানি করে। ছোটো ছোটো বাচ্চাদের পড়াতে ওর ভালোই লাগে। ওদের সাথে কথা বলে, হাসি-আনন্দে বেশ সময় কেটে যায়।

ছেলে হিসেবে অমিত বেশ ভালো। অত্যন্ত নম্র ভদ্র উচ্চশিক্ষিত এবং আচার আচরণে ভীষণ বিনয়ী। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে চাকরি একটা করে বটে তবে ওর মাইনের বেশির ভাগ টাকা খরচ করে দরিদ্র অসহায় মানুষের জন্য। কারও চোখের জল দেখে ও সহ্য করতে পারে না নিজেই হাউ হাউ করে খানিক কেঁদে নেয়। ঈশ্বরের অস্তিত্বে ওর বিশ্বাস আছে কী না তা বোঝা যায় না। ওর মতে মানুষই প্রকৃত ঈশ্বর। তাঁকে ডাকার জন্য কোনো মন্দির, মসজিদ বা গির্জার দরকার নেই। গ্রামে-গঞ্জে, পথে-ঘাটে, বাড়ির আশেপাশে সর্বত্রই ঈশ্বর বিরাজমান আছেন, কেবল তাঁকে খুঁজে নিতে হয়। অমিত সেই খোঁজার কাজটাই করে । পথে বেরিয়ে যখন দেখতে পায় ক্ষুধার্ত অসহায় মুখ একটু খাবারের জন্য কারও সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে আর সেই মানুষটি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষটাকে উদ্দেশ্য করে কটূক্তি করছে তখন অমিতের চোখ দুটি অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। সময় থাকলে নিজে সঙ্গে করে হোটেলে নিয়ে যায়, পেট পুরে খাইয়ে দেয়, হাতে দু-দশ টাকা গুঁজে দিয়ে নিজের কাজে চলে যায়। সময় না থাকলে কাছে ডেকে ক্ষুধার্ত মানুষটির খাবারের ব্যবস্থা করে দেয়। অমিত জানে - এভাবে দু-চারজন মানুষকে সাহায্য করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। মানুষের এই অবস্থার জন্য যাঁরা দায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সর্বস্তরের সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিক, কৃষক তথা মেহনতি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সমাজের বিষাক্ত কীট গুলোকে ঝাড়ে-বংশে নিপাত করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা। দূর করতে হবে অর্থনৈতিক বৈষম্যের পরিকল্পিত মায়াজাল। অমিত বুঝতে পারে - বর্তমানে যে সমাজ ব্যবস্থা চালু আছে তা সমাজের বিত্তবান, বিত্তশালী মানুষের জন্য। গালভরা নাম অবশ্য আছে - "গণতন্ত্র"। গণতন্ত্রের আড়ালে লুকিয়ে আছে গভীর ষড়যন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এবং স্বেচ্ছাচারিতা। আসলে গোটা সমাজ জুড়ে পাতা রয়েছে "মায়াজাল"। গভীর ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতে নেশার মতো মানুষকে সেই ফাঁদে ফেলে মূল সমস্যাকে আড়াল করার সুবিন্যস্ত প্রচেষ্টা। তদুপরি আছে ধর্মীয় বিভাজন। ধর্মের আফিম খাইয়ে মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে সেই ফাঁকে দেশের সম্পদ যত পারো লুটে নাও। এসব কথা বলার বিপদও অনেক, একবার গুপ্তচরের নজরে পড়ে গেলে শেষরক্ষা হবে না। নগররক্ষী এসে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাবে, তারপর যে কোনো একটা কেসে ফাঁসিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হবে। ব্যস জীবনের বাকিটা সময় কারাগারের অন্তরালে একাকীত্বকে সঙ্গী করে মরার মতো বাঁচতে হবে।

বিয়ের অনুষ্ঠান তেমন একটা আড়ম্বর বা জাঁকজমকপূর্ণ হয়নি। যেগুলো না করলে নয় কেবল সেগুলোই করা হয়েছে - রেজিষ্ট্রেশন, কন্যাদান, সিঁদুর দান, মালাবদল অতিথি আপ্যায়ন এবং আশীর্বাদপর্বে সীমায়িত রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে অবশ্য দুপক্ষ সহমত পোষণ করেই কাজটি সম্পন্ন করেছেন। অমিতের ইচ্ছে ছিল তার বিয়েটা একটি ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান হিসেবে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক। প্রথমদিকে বিষয়টা অনেকে মেনে না নিলেও পরে এটা সবাই মেনে নিয়েছেন। অমিতের শিশুসুলভ মনোভাব, সবাইকে আপন করে নেবার সহজাত ক্ষমতা এবং তার ভালোবাসা দিয়ে সবাইকে জয় করে নিয়েছিল।

বিয়ের পরদিন সুরমার কাছে অমিত জানতে চেয়েছিল - যেভাবে আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হলো তাতে তোমার মন সাড়া দিয়েছিল তো, না কী মা-বাবার কথা রাখতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়েছিলে?

সুরমা বলে - না, অনুষ্ঠান নিয়ে আমার কোনোদিনই কোনো আপত্তি ছিলো না। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সত্যি কী এইসব আচার-অনুষ্ঠানের প্রয়োজন আছে?

- আমার মতে, নেই।

- আমার মতও তাই, কিন্তু কেন তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়।

- আসলে মনুবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সাধারণ ছাপোষা মানুষ যে কত অসহায় তা বিভিন্ন ধর্মীয় নিদান ও আচার-অনুষ্ঠানের দান-দক্ষিনা দেখে সহজেই অনুমান করা যায়। অমিত সবাইকে বোঝাতে পেরেছিল যে এইসব আচরণ অনুষ্ঠানের কোন গুরুত্বই নেই মানুষের জীবনে। এটা ব্রাহ্মণ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ ব্যতীত আর কিছুই নয়। মনুবাদ, পুরোহিত তন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ্যবাদ সমাজে এমন এক মায়াজাল বিস্তার করেছে যে সাধারণ মানুষ তার কাছে অসহায়। কিন্তু প্রকৃত মানব ধর্ম অন্য কথা বলে, সে কখনো সমাজে বিভেদের বীজ মন্ত্র ছড়ায় না বরং মানুষে মানুষে মিলেমিশে থাকার কথাই বলে থাকে। একশ্রেণীর মানুষ আছেন যাঁরা ব্রাহ্মণ্যবাদ, মনুবাদ, জ্যোতিষ তন্ত্র এবং মানুষে মানুষে ভেদাভেদকে ঘৃণা করেন। তাঁরা জানেন যে কারা কেন কীভাবে সমাজে এই মায়াজাল বিস্তার করে রেখেছেন। সমাজে বিভেদের বীজ মন্ত্র যত বেশি বেশি করে ছড়াতে পারবে কু-চক্রীরা তত বেশি ফায়দা লাভ করতে পারবে।

অমিতের মুখ থেকে কথাগুলো শুনতে শুনতে সুরমা অবাক হয়ে যায়। ও যা ভেবেছিলো তার থেকে একটু বেশিই পেয়েছে বলে মনে হয়। ওর মনের গভীরে যে ইচ্ছে কুসুম বাসা বেঁধে আছে তা অমিতের কাছে প্রকাশ করে। সুরমার অন্তরের সুপ্ত বাসনা যাতে সফল হয় তার জন্য অমিত ওকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয় এবং এর জন্য যতটুকু সাহায্যের প্রয়োজন তা করার প্রতিশ্রুতিও দেয়। দুজনেই উপলব্ধি করে যে, চারপাশে কুচক্রীরা যে মায়াজাল বিছিয়ে রেখেছে তাকে অকেজো করে দেওয়ার জন্য দুই একজন যথেষ্ট নয়। আজ এক থেকে দুই হলো, আগামীতে দুই থেকে চার, চার থেকে ষোলো এবং ষোলো থেকে চৌষট্টি... এভাবেই গাণিতিক নিয়মে একদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ দুর্বৃত্তদের এই মায়াজাল ছিন্ন করতে পথে নামবে। সেদিনের আর বেশি দেরি নেই।

সুরমা একদৃষ্টে অমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর মনের ভেতর একটা আলোড়ন চলতে থাকে। অমিত যা বলছে তাকে পূর্ণতা দিতে গেলে অনেক প্রতিবন্ধকতা, বাঁধা-বন্ধন এবং প্রতিকূলতাকে জয় করতে হবে। সেটা কী ওদের পক্ষে করা সম্ভব হবে? পরক্ষণেই মনটাকে শক্ত করে বেঁধে নেয়... পারতেই হবে। এ ব্যাপারে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। যাঁরা নতুন সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তাঁরা কী কী ভুল করেছেন সেগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে তবেই পথে নামতে হবে। সময়ের কাছে হেরে গেলে চলবে না। কাকু জ্যেঠুদের কাছে শুনেছে ষাট সত্তর দশকের রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা। বিরাট সম্ভাবনাময় একটা আন্দোলনকে কীভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল সেকথাও সে শুনেছে। আজকের এই বন্ধ্যা অবস্থার জন্য যাঁরা দায়ী তাঁদেরকেও চিনে নেওয়াটা জরুরি। যাঁরা ক্ষমতার লোভে নিজেদের চরিত্র বদলে ফেলেছিলেন। সমাজের বুকে মায়াজাল বিছানোর বিদ্যাটা রপ্ত করে নিয়েছিলেন... এরাই আজকের সমাজের সবচেয়ে বড়ো শত্রু এবং বিশ্বাসঘাতক। সর্বাগ্রে এদেরকে নিধন করা দরকার। সুরমার চোখ দুটি রক্তবর্ণ ধারণ করে, চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। সুরমার এই অবস্থা দেখে অমিত ওকে কাছে টেনে নেয় - দেখ সু, তোমার চোখের ভাষা আমি পড়তে পারছি। তোমার মনের মধ্যে যে আলোড়ন চলছে তা ছাত্রজীবনে আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গেছি। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকের কূটবুদ্ধির কাছে আমি পরাজিত হয়েছি। তাই একা একা পথ চলতে চেয়েছি। কিন্তু একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকিনি। সময় পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছি। আমি জানি - আমার স্বপ্নেরা একদিন ডানা মেলে উড়বে উদার আকাশে, বাতাসে ভেসে উঠবে তার সুগন্ধ। চলো আমরা ছাদে উঠে একটু সময় কাটাই। রাতের আকাশ কী বলতে চায় তা বোঝা দরকার -

ওরা দুজনে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে যায়। নির্মল আকাশে তারাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ওদের মনোলোকে সোহাগ স্পর্শ বুলিয়ে দেয়।

অমিত বলে - দেখ, ঝলমলে নক্ষত্রখচিত রাতের আকাশ কত সুন্দর! সেখানে কোন সুদূরে বিছানো রয়েছে কোটি কোটি নক্ষত্রপুঞ্জ। যেন নতুন পৃথিবীর শান্ত স্নিগ্ধ মায়াবী রূপ ধারণ করে আছে। রচনা করেছে নতুন পৃথিবীর নতুন ফুলশয্যা - কেবল আমাদের জন্য। আমার বিশ্বাস, আমরা সবাই একদিন ওইরকম ফুলশয্যায় শয়ন করবো। সেদিন তুমি কিন্তু আমার হাত ধরে থেকো।

সুরমা আরও কাছে চলে আসে। অমিতের হাতে হাত রাখে। অমিত ওকে বুকে টেনে নেয়।