গল্প ও অণুগল্প

তিল



হুমায়ুন কবীর (বাংলাদেশ)


মুখের একটা কালো তিলের জন্য রাজিব মেয়েটাকে পছন্দ করে ফেললো। মেয়েটার নাম শুভ্রা। বিবাহযোগ্যা পাত্রী মহলে শুভ্রা সুন্দরী বলে খ্যাত না... ইতোমধ্যে বেশ কিছু পাত্র তাকে না - পছন্দ করে ফিরে গেছে। তার মুখে একটা কালো তিল; তিলটা কেহ সমাদর করেনি, রাজীব করেছে। কেন করেছে এমন প্রশ্নের উত্তরে রাজিবকে বলতে শোনা যায়... পারস্যের কবি হাফিজ প্রিয়ার কালো তিলের বিনিময়ে সমরখন্দ আর বুখারা লিখে দিতে চেয়েছিলেন; আর আমি একটা মেয়েকে জীবন সঙ্গী করতে পারবো না?

হ্যাঁ, রাজীব শুভ্রাকে জীবন সঙ্গী করেছে।শুভ্রার মুখে যে তিলটা জন্মাবধি শোভা পেয়ে আসছে তা একজন বিমানচালকের চিত্ত আকর্ষণ করতে পারে সে স্বপ্নেও ভাবেনি। সে আজ ধন্যি মেয়ে। রাজীব আকাশযানে মেঘেদের দেশে যায়... কত কত দেশে ল্যান্ড করে। যেখানে যা সুন্দর দেখে তার ভিডিও চিত্র সেন্ড করে শুভ্রাকে। শুভ্রাকে সুন্দর সুন্দর ভালোবাসার বাণী ম্যাসেজ করে।সেই ম্যাসেজে শুভ্রার মুখের তিলের স্তুতিও স্থান পায়। একটা ম্যাসেজ এমন...

- তোমার গালের তিলের জন্য দিতে পারি দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ প্রান্তর। শুভ্রা ভাবে দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তরের 'পর রাজীবের কি কোন মালিকানা স্বত্ব আছে? মেঘেদের দেশে রাজীবের বিচরণ। উড়ে চলা মেঘের ছবি পাঠিয়ে দেয় শুভ্রাকে; সেটা নাহয় মানা যায়। কিন্তু আকাশের তারা কে কাকে দিতে পারে? - রাজীব বলে এক আকাশ তারা তোমার জন্য।

এগুলো নাকি ভালোবাসার ভাষা - এমনই রাজীবের অভিমত। শুভ্রার বয়স অল্প। সে এখনো ভালোবাসার ভাষা আয়ত্ত করতে পারেনি। সে সরলা বালিকার মতো বলে - দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর তোমাকে দিতে হবে না। তুমি বরং একটা চিঠি দিও - হলুদ খামে ভরা একখানা চিঠি। অনেক দিনের ইচ্ছে একটা চিঠি দিয়ে যাক ডাক পিয়ন।

যে তিলটার জন্য রাজীব তাকে এতটা পছন্দ করে সেই তিলটা আর পাঁচজনের মতো শুভ্রার নিজের কাছেও ততটা প্রিয় না।

সে রাজীবকে বলে, দেখ, আমার এই তিলটা একটা ছোট্ট কালো স্পট বৈ কিছুই না। রাজীব তা মনে করে না। সে ভাবে তার নববিবাহিতা স্ত্রী আজও আপন সৌন্দর্যকে চিনতে পারেনি। এটা তার নন্দনতত্ত্ব বিষয়ের অজ্ঞতা - শুভ্রাকে নন্দনতত্ত্বের পাঠ দিতে চায় রাজীব।

একসময় তিল বিষয়ক কিছু বই পড়েছে রাজীব। তিল মুখাবয়বের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে ভিন্ন ভিন্ন সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলে। এইসব তিল তত্ত্বের কিছুই জানে না শুভ্রা। রাজীব তিল-মাহাত্ম্য স্ত্রী শুভ্রাকে জানাতে চায়। একটা তিল শাস্ত্র কিনে দেয় শুভ্রাকে।

শুভ্রা মন দিয়ে তিল শাস্ত্র পড়া শুরু করে। তার গালে একটা তিল - যেটাকে রাজীব অনন্য সুন্দর বলে জানে। তিল বিশারদগণ বলছে, যে মেয়ের গালে তিল সে মেয়ে প্রেমিকা হিসেবে অসাধারণ। তিল শাস্ত্রের এই ব্যাখ্যা শুভা মানতে পারে না। রাজীবের সাথে প্রেমালাপে তার রোমান্টিক মনের পরিচয় মেলে না। তার মন্তব্য শুস্ক আর প্রেমহীন।

সেদিন রাতে সাদা ফকফকা জ্যোৎস্না ছিল। বাসার ছাদ-বাগানে রাজীব আর শুভ্রা পায়চারি করছে। রাজীব শুভ্রার মুখের তিল ছুঁয়ে গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে - এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর।পুণ্য হল অঙ্গ মম, ধন্য হল অন্তর...

শুভ্রা বললো, আচ্ছা প্রিয়, ওই চাঁদের কালো স্পট সত্ত্বেও চাঁদ সুন্দর; আমার মুখের তিল কি তেমন - যেমন চাঁদের গায়ে কালো দাগ?

- না, তেমন ঠিক না। চাঁদের গায়ে কালো দাগ তার কলঙ্ক,তোমার গালে তিল তোমার আশীর্বাদ - যে মেয়েদের গালে তিল থাকে তারা ভালোবাসা পেয়ে থাকে। এই যেমনটি তুমি পাচ্ছো - বলতে বলতে রাজীব শুভ্রার তিলে একটা চুম্বন এঁকে দিল।

একজন বিমানচালক হিসেবে রাজীব শুভ্রাকে বিদেশ-বিভূঁইয়ে নিয়ে যায়। বাঙালী মেয়েদের পতি-প্রেম যৌথ পরিবারে উন্মুক্ত না। এক সফরে শুভ্রা স্বামীকে একান্ত করে পায়। তার মনের দিগন্ত প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। সে স্বামীকে বলে, আমি তোমার ভালোবাসার যোগ্য না। শুধুই মনে হয়, আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলে তোমাকে পেয়েছি।

- দেখ, সমানে-সমানে দ্বন্দ্ব; ভালোবাসার জন্য অসমতা আবশ্যক।

শুভ্রা হেঁয়ালী করে বলে হ্যাঁ, অসমতায় তো - তুমি আকাশ দিয়ে উড়ে যাও। আমি মাটির 'পর হেঁটে চলি - কত ফারাক তোমাতে-আমাতে।

- কী যে বল না?

- যা বলি সত্যি বলি। আমার কাছে তুমি মানেই ছুঁতে না পারা অসীম আকাশ। আমার কাছে তুমি মানেই চোখ-নির্ঘুম আষাঢ়ের মাস।

রাজীব মনে মনে ভাবে,কোথায় যেন একটা গ্যাপ থেকে যাচ্ছে। রাজীবের থেকে বউয়ের বয়সের বেশ ফারাক। হয় সে শুভ্রাকে বুঝতে পারেনি, নাহয় শুভ্রা তাকে বুঝতে পারেনি। বউকে পুরো বুঝতে না পারলেও ভালোবাসায় তার ঘাটতি নেই - আকাশ যান চালিয়ে যখন সে বাসায় ফেরে বউয়ের তিল - মুখের দিকে চেয়ে তার খুব ভালোলাগে। রাজীব তিল-মুখো শুভ্রাকে বড়ই ভালোবাসে।

এই দুই অসম জুটির মধ্যে মাঝেমধ্যে নিত্যনতুন সংলাপ চলে। তিল-প্রেমিক রাজীব যখন তিল নিয়ে বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে - শুভ্রা সহসা সংলাপ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। যে তিল তার স্বামী বড়ই পছন্দ করে সেই তিলটা নিয়ে ইদানিং তার দুর্ভাবনা বেড়েছে। বিয়ের সময় শুভ্রার মুখের তিলটা চর্মে লেপ্টে থাকতো। বিয়ের এই ক'বছরে তা একটু উঁচু হয়েছে। ইদানিং রাজীব আগের মতো তিলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় না।তার মুগ্ধতায় দিনে দিনে ভাটা পড়ছে। এটা একটা নারীর জন্য আনন্দের কথা না। শুভ্রার আনন্দ কমতে চলেছে। তিলের এই ক্রমবর্ধমান আকার শুভ্রা রোধ করতে চায়। সে শুনেছে, হোমিওপ্যাথিতে তিলের বাড়ন্ত গতি থামাতে পারে। স্বামীর বিদেশ যাওয়ার ফাঁকে সে স্থানীয় নামকরা এক হোমিও চিকিৎসকের কাছে যায়। তিলটা দেখায় ডাক্তার সাহেবকে। ডাক্তার সাহেব রোগী বিবরণী প্রস্তুত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে -

- আপনার টক পছন্দ না, মিষ্টি?

- টক।

- কোন কাতে শুতে পছন্দ - ডানে, না বামে?

- ডানে।

শীত কাতর, না গরম কাতর?

- গরম কাতর।

- একা থাকতে পছন্দ, না সঙ্গ ভালোবাসেন?

- একা থাকতে ভালোবাসি।

ডাক্তার সাহেব এক শিশি ওষুধ দিলেন। বললেন, প্রত্যেক সকালে তিনটি করে বড়ি ঈষদুষ্ণ জলে মিশিয়ে খালি পেটে খাবেন। ইনশা আল্লাহ তিলের আকারটা কমে যাবে।দিন পনের পর আবার আসবেন।

- খাদ্য- খাবারে কিছু বারণ আছে কি,ডাক্তার সাহেব?

- না, তেমন বারণ নেই; তবে কাঁচা পেয়াজটা বর্জন করে চলবেন।

শুভ্রা নিয়মিত ওষুধ খেতে থাকে। স্বামী রাজীবকে সে বিষয়টা জানায় না। কেন জানায় না, তা সে নিজেও জানে না।

ওষুধ ফুরিয়ে এল। পনের দিনও ফুরিয়ে এলো - তিলের বাড়ন্ত গতি কমেনি। শুভ্রা দিনে কয়েকবার ড্রেসিং টেবিলের সামনে যায় আর হতাশ হয় - নাহ্, কমার কোন লক্ষ্মণ নেই - বোধহয় কিঞ্চিৎ বেড়েছে।

ডাক্তার সাহেব দ্বিতীয় দফা ওষুধের শক্তি বৃদ্ধি করলেন। বললেন, দেখুন হতাশ হবেন না। রোগটা একদিনে হয়নি। একদিনে যাবেও না, কিছুদিন সময় লাগবে। ওষুধ খেতে থাকুন।

ওষুধ চলছে। তিলের আকৃতি কমছে না। হালকা ব্যথা করছে। নতুন সমস্যা যুক্ত হয়েছে। ক্ষুধামান্দ্য দেখা দিয়েছে, দীর্ঘদিনের মলত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। শরীরের ত্বকের কিছু পরিবর্তনও মনে হচ্ছে। এসব পরিবর্তন শুভ্রাকে চিন্তিত করে তোলে। রাতে সে রাজীবের সাথে সমস্যাগুলো শেয়ার করে।

রাজীবের বন্ধু একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ফোনে স্ত্রীর সমস্যাগুলো তাকে জানায়। ডাক্তার বন্ধু পরদিন হাসপাতালে যেতে বলে। শুভ্রার মাথায় চিন্তা, তার স্বামীও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন - একটা খারাপ কিছু কি অপেক্ষা করছে?

শুভ্রার মুখের তিলটার ব্যাপারে ডাক্তার সাহেব একটা আশঙ্কা করছেন। রোগলক্ষ্মণগুলো খারাপ ইংগিত দিচ্ছে। অবশ্য সঠিক ডায়াগনোসিস করার পরেই চূড়ান্ত কথাটি বলা যাবে। ডাক্তার সাহেব কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেয়। এক সপ্তাহ পরে রিপোর্ট পাওয়া যাবে।

এক সপ্তাহ আর সাত দিন মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে দীর্ঘ মাস। সাত দিন গেলে রাজীবের বন্ধু ফোন করলো।

- বন্ধু,একটা দুঃসংবাদ দিতে হচ্ছে।

- বল, বন্ধু।

- রিপোর্ট এসেছে... ভাবির মুখের তিলে ক্যান্সারের জীবাণু রয়েছে। সম্ভবত প্রাইমারি স্টেজে আছে... এখনো চারদিকে ছড়ায়নি। তুমি সিঙ্গাপুরে নিয়ে যেতে পার।

রাজীব দেরি করেনি। মাসের শেষের ফ্লাইটে বউকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যায়। ডাক্তার বলে, দেরি না - ইমিডিয়েটলি সার্জারী করতে হবে।

সেটাই ভালো। দুজনে তিলটা অপসারণের ব্যাপারে একমত হয়।

রাজীব তিল-প্রিয় মানুষ। এখনও তিলটা বউয়ের মুখে শোভা পাচ্ছে। আগামীকাল তিলটা সরিয়ে ফেলা হবে। এক অপার মুগ্ধতায় শুভ্রার তিল-মুখে চেয়ে আছে রাজীব।