প্রবন্ধ

খাল-বিলের আখ্যান



মমতা বিশ্বাস


ভূমিকা

পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ একটি জেলা হল নদিয়া ('নদীয়া')। অতীতে নবদ্বীপের অপর নাম ছিল 'নদীয়া'; তবে প্রথমে কোন নামটি ছিল সে বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। নাম দুইটির অর্থ একাধিক। বিখ্যাত বৈষ্ণব গ্রন্থকার নরহরি দাস নবদ্বীপকে "নয়টি দ্বীপের সমষ্টি" বলেছেন তাঁর গ্রন্থ" নবদ্বীপ পরিক্রমা পদ্ধতিতে"।

"নবদ্বীপ পৃথক গ্রাম নয়।

নবদ্বীপে নব-দ্বীপ বেষ্টিত যে হয়।"

যারা নবদ্বীপের নতুন দ্বীপ অর্থ করেন তাঁদের মতে অতীতে গঙ্গা মধ্যবর্তী চরভূমিকে চারিদিক বেষ্টণ করে গঙ্গা জলাঙ্গী প্রবাহিত হত। কালে, নদীর গতি পরিবর্তিত হওয়ায় ঐ চরভূমি বিস্তৃত হয়ে পড়ে এবং মানুষের বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। দ্বীপের উপর নতুন গ্রাম গড়ে ওঠায় নব-দ্বীপ নামে খ্যাত হয়।

'নদীয়া' নামের উৎপত্তির অপর মতটি হল পূর্বে প্রদীপকে দীয়া বলা হত। গঙ্গা মধ্যস্থিত সুবিস্তীর্ণ চরে একজন সাধু বাস করতেন। প্রতি রাত্রে নয়টি দ্বীপ জ্বেলে তান্ত্রিক সাধনায় রত হতেন। দূর থেকে লোকে দেখে; ঐ চরকে ন-দিয়ার চর অর্থাৎ নদীয়ার চর বলে অবিহিত করেছিল। পরবর্তীকালে ঐশ্বর্যশালিনী বঙ্গের রাজধানীতে পরিণত হয় নবদ্বীপ।

ভূতত্ববিদগণ বহুগবেষণায় স্থির করেছেন যে সমগ্র নদিয়া পুণ্যসলিলা ভাগীরথীর বহুপুরানো সুবিস্তীর্ণ ও সমুন্নত চরভূমি এবং প্রাচীন কাল হতেই অধ্যুষিত। কালের নিয়মে গঙ্গা, জলঙ্গী এবং তাদের শাখা-প্রশাখা, ধারা-উপধারা গতিপথ পরিবর্তন করেছে। নদী, খাল, বিলের বিলোপ যেমন ঘটেছে; তেমনি নতুনের উদ্ভবও ঘটেছে। পূর্বের ছেড়ে যাওয়া নিম্নভূমিই খাল-বিল, ছোটো- বড়ো জলাশয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। খাল-বিল-জলাশয় বাহিত জলেই পুষ্ট হয় নদী। মানুষের তৈরি বাঁধ, সেতু, বাঁধাল বাঁধনে এবং কালের নিয়মে পলি পড়ে নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। গতি রোধের ফলে গতিবেগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক ভাবে জলধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। বহু খাল, বিল আবাদ যোগ্য হয়ে উঠেছে। সরকারি বা ব্যক্তিগত হাজার হাজার একর জমিতে বর্ষাকাল ছাড়া প্রচুর শীতকালীন, ও চৈতালী ফসল উৎপাদন হয়। পলি সমৃদ্ধ হওয়ায় চাষের খরচ অনেক কম। সার, ঔষধ, এবং জলের খরচ খুবই কম। অথচ ফলে, সোনার ফসল।

বৃষ্টির জল নদী-নালা-খাল-বিলে গিয়ে পড়ে। প্রধান নদ-নদী সেই জল বহন করে নিয়ে যায় সাগরে। খাল-বিল-নদী-নালা, সমুদ্রের জল বাষ্প হয়ে আকাশে উঠে মেঘ সৃষ্টি করে। মেঘ, বৃষ্টি হয়ে ঝ'রে পড়ে ধরাতলে। এইভাবে আবর্তিত হয় জলচক্র। বঙ্গদেশ নদী-নালার দেশ। জালের মতো বিস্তার করে আছে। তারা পরস্পর হাত ধরাধরি করেই চলছিল। আধুনিকতা ও মানুষের আগ্রাসী লোভের ফাঁসে প্রধান নদী সহ তার শাখা-প্রশাখা ধুঁকতে শুরু করেছে। স্লথ গতির জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে পরস্পরের থেকে। বড়ো ধরণের চুরিকে পুকুর চুরি বলে। এখন মানুষ রাতারাতি নদী-নালা, খাল-বিল, জলাশয় চুরি করছে। শুধু রাতারাতি নয় দিনের আলোতেও বুজে যাচ্ছে খানা-খন্দ, পুকুর, খাল-বিল, নদী-নালা।

প্রকৃতির উপর মানুষের নির্মম অত্যাচারের ফল ফলতে শুরু করেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এবছরে ফলটা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। করোনা অতিমারির কোপে অর্থনীতি, শিক্ষা, ও স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়েছে। কৃষিক্ষেত্রেও ভালো মতো প্রভাব পড়েছে। ২০২১-এর মার্চ মাস থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পশ্চিমী ঝঞ্ঝার প্রভাবে প্রত্যেক মাসেই নিম্ন চাপের বৃষ্টি হচ্ছে। নদিয়ার হাজার হাজার একর জমি; বিলের জল খাল দিয়ে যথা সময়ে নেমে যেতে না পারায় শীতকালীন বা চৈতালি ফসল মার খেল। চাষীদের মাথায় হাত। একটু উঁচু জমির ফসলও একাধিক বার বপন করলেও নিম্নচাপের বৃষ্টির ফলে বারবার নষ্ট হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে মনুষ্য সৃষ্ট ভেড়ি ও বঁআধাল চাষীর সংকটকে আরো সংকটজনক করে তুলেছে।

প্রায় দুই বছর ধরে নদিয়ার জেলার কিছু অঞ্চল ঘুরে গ্রাম-বাঙলার প্রাণ;খাল-বিল, নদী-নালার গুরুত্ব কতটা - সে অভিজ্ঞতার কথায় বলার চেষ্টা করব। আমার শিকড়ও গ্রাম; তার কথা তো বলবই। কোনো কোনো স্থানে একাধিক বার গেছি। কোনো স্থানের সঙ্গে আজন্ম সম্পর্ক।


পর্বঃ ১ - দামোদরের বিল

মেঘলা আকাশ। কুয়াশায় ঢাকা চারিধার। টুপটুপ করে সারারাত হিম পড়েছে। টিনের চাল চুঁইয়ে পড়ছে মাটিতে। মাটি মোমোর মতো ফুলে উঠেছে। সপ্তাহ খানেক ঠাণ্ডাও পড়েছে জাকিয়ে। নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে; আবারও বৃষ্টি হবে। কাজ ফেলে রাখলে চলে না চাষার। পাখির ডাকে ঘুম ভেঙে যায় মণিকুমারের। বৌকে ঠেলে উঠিয়ে দেয়। মাটির হাঁড়িতে সের খানেক চাল, আলু, বেগুন, সিম, কুমড়ো সিদ্ধ ভাত ফুটিয়ে একথালা গরম ভাত মণিকুমারের সামনে ধরে দেয়; এক খাবলা নুন, তেল, গোটা চারেক কাঁচা লঙ্কা দিয়ে। ভাতের উনুনে জ্বাল দিতে দিতে মণিকুমার হাত পা গরম করে নিয়েছে। বৌ সকালের বাসি কাজ সেরে এসে ভাত বেড়ে দিয়েছে। হাত ধুয়ে কাঁসার বগি থালা বাঁ-হাতে ধরে; আলু, বেগুন, কুমড়ো, সিম হাতের তালু দিয়ে ঠেসে ঠেসে নুনের উপর লঙ্কা মুড়িয়ে মুড়িয়ে ভেঙে সব ভাত এক সঙ্গে মেখে বড়ো বড়ো দলা পাকিয়ে মুখের মধ্যে ছুড়তে লাগল। ফুলটুসি উনুনের উপর দাঁড়িয়ে ঘসির আঁচে হাত-পা, সর্ব শরীর ছেঁকে নেয়। শরীর মন চনমনে হয়ে ওঠে। আলপথের শিশির বিন্দু; কাদা পা ধুয়িয়ে দিলেও ঠাণ্ডায় কাবু করতে পারে না।

ভোরে ভাতের হাঁড়ি উনুনে বসিয়ে মণিকুমারকে জ্বাল দিতে ব'লে; ঘর-উঠোন ঝেঁটিয়ে, থালা-বাসন ধুয়ে গোয়াল পরিষ্কার করে বিলের জলে কাপড়-চোপড় ধুয়ে উপরে উঠতে ঠাণ্ডায় হাত-পায়ে টাস ধরে যায়। এর মধ্যে ভাত হয়ে গেছিল। মণিকুমারকে আগেই ভাত বেড়ে দিয়েছে। নিজেও একথালা বেড়ে নিল। বাঁকী ভাতটুকু সিলভারের বড়ো কেটলিতে ভরে নেয়।

গত রাতে লাঠামাছের ঘেচুর (শালুক বা শাপলার স্কন্দ) বাসি তরকারি কালাকে দিয়ে এল। না, না তাই বলে সে বধির নয়। গায়ের রং কালো তাই সবাই কালা বলে ডাকে। গায়ে অসুরের শক্তি। দেড় কুইণ্টাল জিনিস মাথায় করে এক মাইল রাস্তা অনায়াসে যেতে পারে। বলা ভালো যেতে হয় তাকে। বাংলাদেশের পাঁচ খানা কাঁথা একবার নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিতে পারলে পনেরো দিন নিশ্চিত। এক, একটি কাঁথার মূল্য কুড়ি হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার। গেট থেকে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিতে পারলেই মোটা টাকা পেয়ে যাবে। ও, হাজার হাজার টাকাতেই খুশি। নেশার জিনিস পাচারে লাখটাকা আয়ের স্বপ্ন দেখতে চাই না; কারণ জীবণ হানির ঝুঁকি থাকে প্রতিমুহূর্তে। না হলে জেলের ঘানি! ভোর রাতের ঘণ্টা তিনেকের কাজ; তারপর সারাটা দিন দামোদরের বিলে মাছ ধরে কাটে। ডোঙায় করে বিলের এমাথা, ও মাথা ঘুরে বেড়ায়। গলা ছেড়ে গান ধরে ভাটিয়ালী। আঠারো ছোঁয়া ছেলেটির উপর গোটা পরিবার নির্ভরশীল। ঠাকুরমা, মা, অবিবাহিত দুই দিদি, পঙ্গু দাদা। ব্লাকের কারবার করতে গিয়েই পঙ্গু হয়েছে। ১২ বছর পর্যন্ত রাখালি করেছে কালা। তারপর আস্তে আস্তে চোরা কারবারে হাতে খড়ি। এখন পাকা হয়ে উঠেছে। লকডাউনের সময়ে ভোর আড়াটের সময় গেট খুলে দিলে ওপারের জিনিস এপারে নিয়ে আসে; এ পারের জিনিস ওপারে নিয়ে যায়। খুব দ্রুত কাজ সারতে হয়।

ফুলটুসি ও মণিকুমার সন্তানের মতো স্নেহ করে কালাকে। বিলে ধান রোঁয়ার কাদা করার সময় সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত সঙ্গে থাকে। অসুখ-বিসুখের সময় কালাই হাতের লাঠি হয়ে ওঠে।

দুই লিটারের জলের বোতলটা মণিকুমার জল ভরে; ব্যাগে ভাতের কেটলির পাশে বসিয়ে নিল। কেটলি, কাঁচি, নিড়ানি সমেত ব্যাগ এক হাতে; অন্যহাতে খুটো সমেত গাই গরু দুটোর দড়ি ধরে একটু আগেই বাড়ি থেকে বেরোল; পাকা রাস্তার পাশের বাচড়ায় গোচড় দেওয়ার জন্য। ফুলটুসি ছাগলের পাল তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে রাস্তার ওপারে ছেড়ে দেবে। কাঁটাতারের ফাঁক-ফোঁকড় দিয়ে বাংলাদেশে গিয়ে পেট ঢাক করে ঘাস খেয়ে; মালকিন বিল থেকে ফিরে আসার আগেই হাজির হবে পাকা রাস্তায়। আজ বিলের ওপারেই কাজ। পাঁচকাঠা সর্ষের জমি নিড়াবে। দোপের (নীচে) জমিতে এক হাঁটু জল। কমলি, হেলঞ্চ শাক লকলক করছে। জলে নেমে শাকের ডগা মটমট করে ভেঙে ব্যাগের মধ্যে চালান করে দেবে মণিকুমার। সকালে পেতে রাখা রাবানি, দোয়ড়ি, আটল জল থেকে তুলে ঝাঁকিয়ে কেটলির মধ্যে জিয়ল, ল্যাঠা, পুঁটি মাছ ঢেলে নেবে। রাতে টাটকা মাছের ঝোল দিয়ে আধ সের চালের ভাত সাবাড় করে দেয়। নুন-ঝাল চড়া করে ফুলটুসি রাঁধে ভালো। কাজের তাড়া না থাকায় উনুনের ধারে বসে ধীরে ধীরে চেটেপুটে খাবে। জমি নিড়ানো শেষ হলে আলের ঘাস কেটে বস্তা বোঝায় করে নিয়েছে। বিচুলি কেনার খরচ বেঁচে যায়। স্বামী-স্ত্রী গুটি গুটি পায়ে কেউ সাতের দশকে হাঁটছে; কেউ ছয়ের দশকে। কঠোর পরিশ্রমী দুজনে। সারাদিন মাঠে-ঘাটে পড়ে থাকে। জন-মুনিষের জন্য একটা পয়সাও খরচ হয় না। রূপসী মেয়েরা আঠারো বছর বয়সের অনেক আগেই নিজেদের পছন্দে পর ঘরি হয়েছে। দামোদরের বিলের পাড়েই বটগাছের নীচে টিন, পাটকাঠির বেড়ার ঘর। গোটা বিশেক হাঁস। বাঁশের চটা আর টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরের কাঠের দরজা খুলে দিলেই প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে বিলে নেমে যায়। উঠোন থেকে নীচে নামতে নামতে ফ্যাচ, ফুচ করে ছড়াতে ছড়াতে যাবে। লাঠি দিয়ে তাড়িয়ে নামাতে নামাতে কাজ সেরে ফেলে দেয় প্রায় প্রত্যেক দিন। পিচকিরিতে ছড়া দেওয়ার মতো আর কী! জল ঢেলে ঝাঁটা দিয়ে ঝাঁট দেওয়ার কাজটা বেড়ে যায় ফুলটুসির। হাঁসের দল সন্ধ্যে পর্যন্ত বিলের জলে ভেসে বেড়াবে। কচুরিপানা বা জলের মধ্যে মাথা চুবিয়ে ঠোট গুজে দিয়ে গুগলি, শামুখ, ঝিনুক খাবে। কখনো পট কচুরির বড়ো ঝাঁকের উপর পালকের মধ্যে ঠোঁট গুজে ঘুমিয়ে নেবে। ইয়া বড়ো বড়ো ডিম ৩৬৫ দিন কী আর এমনিতে পাড়ে? গুগলি ঝিনুক, শামুক খাওয়া হাঁসের ডিম কিনা! একটা সাত টাকা! বাজারে দশ টাকা পিচ। ডাঙালি দেশের ফুলটুসি ১২ বছর বয়সে এই গ্রামের বৌ হয়ে আসে। বৌ হয়ে আসার পর শাশুড়ি পাঁচখান হাঁসের ছা দিয়ে বলেছিল, "বৌ - ধনদৈলত, সুনা-দানা আমার কিচ্চু নাই। আছে শুদু একপাল হাঁস-মুরগী, দুডে ছাগল। তুমার শ্বশুরির এক ছটাক জমি নেই মাটে! বিলির মাচ, শাক, সাপলা, কচু ঘেচু পেটের আদ্দেক খুরাকির যোগায়। দেশেরতে আসার পরতে ঐ পারের শিব মুন্দির বাড়ির বারোমেসে মুনিসির কাজ করে গিয়েচে। তার মুকি ঐ গিরামের কত গল্প যে শুনিচি; তার ঠিক নেই। এই যে বিলডা দ্যাকচো বসষার সুময় সুমুদ্দুর হয়ে যায়। ঐ যে বিরিজ দেখচো ও তো এই সেদিন হোলো। উসার (চওড়া ) ছিল ডপল। ঘোনো দলক নামলি দাড়গাচা বিলির জলের এই এত উঁচো ঢেউ আঁচড়িয়ে আঁচড়িয়ে পড়ত। গজরাইত কী? বুক কাইপে উটতো। চারিদিক জলে জলাকার। জাহাজ চইলত নাকি আগে। সাহেবরা নীল বুজাই করে নিজিগের দেশে নিয়ে যাইত। বড়ো বড়ো পালতুলা নৌকা যাতি দেকিচি। এখন ছোটো ছোটো নৌকা চলে। বাংলাদেশের একশ পাঁচটা বিল-খালের জল নাইমে আইসে এই বিলি পড়ে। শীতকালেও জলে ছোত থাইকত। মিশমিশে কালো জল। খাওয়া, রান্দা, থালপাতর ধুয়া, জামা-কাপুড়, মানুষ-গরুর ছ্যান করা, খাওয়া সবই বিলির জলে। উই যে দ্যাকচো উঁচো উঁচো ইটির মতো; ও হচ্চে সাহেবগের পাকা বান্দাল। একেনতে ভালো দেকা যাচ্চে না। মণিকুমারের সাতে একদিন যায়ে দেকে আইসো।

"পাকা বান্দাল; সে আবার কী?"

"আগে নীলচাষ হোতো না? সেই নীলগাচ, পাট গাচের মতো জাগ দিতো ঐ বান্দালে। ইট দিয়ে বানানো; তাই পাকা বান্দাল। ঐ খালও নীল চাষের সুবিদের জন্ন্যি সাহেবগের কাটা।"

"পাকা রাস্তা ছাড়া চারিদিক জলে জলাকার। সাহেবগের নীল বুজায় জাহাজ খাল, বিল, নদী দিয়ে সুমুদ্দুরি পইড়ত। আমার মাসি বাড়ি চৌগাছায়। ফেডি সাহেবের ঘাট দেকিচি। সেই সাহেবের নাকি বিশে ডাকাতির দল বলি দিতি যাচ্চিল। ফেডি সাহেব হাত জোড় করে পরাণ ভিক্কে চাওয়ায় বিশে ডাকাত ছাইড়ে দিতি বোলে। খুব ভালো মানুষ ছিল। ডাকাতি কোইরতো দীন-দুখিগের জন্ন্যি। এসব গল্প ফুরোয় না। কেরমে কেরমে জানতি পারবা। ও যা কচ্চিলাম, কিই বা দিই? হাঁস তায়ায় (ডিমে তা দেওয়া) বয়েচে; ছা ফুটলি দিবানে পাঁচটে। ঠিক মতো পালতি পাল্লি বিশ-পঁচিশটে হোতি সুমায় নাগবে না। বিয়ানে খাঁচা-বাক্সোর মুক খুলে দিলি পিলপিল করে বিলি চলে যাবে। সন্দেবেলায় আয়, আয় টি-টি-টি করে ডাক দিলি উটে আসপেনে। কিচ্চু খাতি দিয়া নাগে না। অ্যাট অ্যাট্টা ডিমির দাম আট আনা। গুগলি খায়ে ডিম পাড়ে হাতের থাবা ভরা। নিজির শক-আহ্লাদের জিনিস, সুংসারের ইডা-সিডা কিনার খরচ হয়ে যায়।"

ফুলটুসি হাঁসের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়া এই বাড়িতে এসে প্রথম দেখল। আদর করে ওর বর ওকে টুসি বলেই ডাকে। ছাগলের ঘরের এক কোনায় ছিকেয় একটা ডালা ঝোলান। নতুন বৌ টুসি সকালে ছাগল বের করতে গিয়ে কৌতূহলবশত উঁকি দিয়েছে। হাঁস ফোঁস করে উঠে নতুন বৌয়ের নাকে কামড়। সে কী বিপদ! কদিন আর ওমুখো হল না টুসি। শাশুড়ি বলেছিল,

"তায়ায় বসা হাঁস খেপে থাকে। কেউ কাচে গেলি ভাবে ডিম নিয়ে যাবে তাই কামড়িয়ে দেয়।"

ডালায় মোটা করে চুষ ((ধানের খোসা) বিছিয়ে কুড়িটা ডিম সাজানো আছে। একমাস তা দেওয়ার পর ডিম ফুটে বাচ্ছা বেরিয়ে আসবে। গরমকালের সময় তখন। তা দেওয়া হাঁসটি রোজ দুপুরে ঝাঁপ দিয়ে নেমে বিলের জলে স্নান করে। রোদে গা শুকিয়ে ডাঙায় উঠে পাখনা ছড়িয়ে ডিমে তা দেয়। ২৮ দিন হয়ে গেলে ডালা নীচে নামিয়ে রাখল ফাতোবুড়ি। হাঁস স্নান করতে গেলে ফুলটুসির শাশুড়ি এক একটা ডিম হাতে তুলে কানের কাছে ধরে। টিকটিক করলে বোঝে বাচ্ছা ঠোঁট দিয়ে গুতিয়ে শক্ত খোলা ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এবার কপাল ভালো, একটা ডিম ও নষ্ট হয়নি।

"একজুড়া ছা বেচলি পাঁচটে টাকা।"

সন্ধ্যে হতেই একটা বাচ্ছার আর্ধেকটা বেরিয়ে এল শক্ত খোলা ভেদ করে। সাবধানে ছার গলা ধরে টেনে বের করে নিয়ে এল ফাতোবুড়ি। হলুদগুড়ো, সর্ষের তেল হাঁসের ছার নাভিতে টিপে টিপে দিয়ে রাখলো পলোর নীচে। একটা মালাইতে আটা গুলে দিল; অন্যটায় খুদ ভিজিয়ে। সকাল হতেই ছটা ছা বেরিয়ে এলো ডিম থেকে। ডিম ফেটে ঠোঁটটা বের করতে পারলেই হল, অদ্ভুদ কায়দায় শরীর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুড়ুৎ করে বেরিয়ে আসে খোলা থেকে। সারাদিনে বাঁকী গুলোও। ফুটফুটে হলুদ, সাদা, কালো ছোপ দেওয়া ছা (বাচ্ছা)। পালক শুকিয়ে যাবার পর ভারি সুন্দর দেখা যায়। ঘুরঘুর করে পলোর মধ্যে (মাছ ধরার বাঁশের শলার তৈরি যন্ত্র বিশেষ) হেঁটে বেড়াচ্ছে। মা-হাঁস ডালা ছেড়ে পলোর চারপাশে ঘুরছে। মানুষ দেখলেই তেড়ে যাচ্ছে কামড়াতে। বাচ্চাদের টুসির শাশুড়ি সন্ধ্যেবেলায় মা হাঁসের ডানা ধরে জোর করে ঢুকিয়ে দিল বড়ো হাঁসদের ঘরে। সপ্তাহ খানেক পরে পলো উঁচু করে বাচ্চাদের ছেড়ে দেয় কেঁচো খাওয়ানোর জন্য। কেঁচো খেলে বাচ্চা বাড়ে তাড়াতাড়ি। মা আগে; বাচ্চারা পিছনে।

টি-টি ডাক শুনে এগিয়ে যায়। কোদাল বা নিড়ানির কোপে কিলবিল করে বেরিয়ে আসে কেঁচো। ঠোক মেরে ছোটো হলে একবারে কপাৎ; বড়ো হলে একটু একটু করে গিলে শরীর দুলিয়ে পেটের মধ্যে চালান করে দেয়।

‌শাশুড়িবুড়ি নেই, কিন্তু যাওয়ার আগে সংসারের আয় উন্নতির আট-ঘাট শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে ফুলটুসিকে। ঘসির আঁচের ওমটুকু বুড়ি শাশুড়ির কপালে জোটেনি। পাতাপুতি, নাড়ার জ্বালের আগুন সরায় তুলে পাশে রাখা বা উনুনের উপর দাঁড়াতে দাঁড়াতে আঁচ মিইয়ে যেত। জাড়কালে এক সরা ঘসির আগুনের ওমের জন্য কত হা- পিত্যেশ করত ফলটুসির 'বুড়ি শাউড়ি'।

‌"এট্টা গাইও যদি থাইকত, তাহলি ঘসি-মশালের আগুনির তাপে সারা শরীল ছেঁকে নিতি পাত্তাম। ব্যতা-বিষ এত থাইকত না। খদ্দরের চাদরে শীত যায় না; হাত-পা টাল হয়ে থাকে। পাতলা নেপের নীচে হাত-পা গরম হোতি চাই না। ঘোম আসতি আসতি রাইত একপার হয়ে যায়।"

‌‌ভাগ্যিস খরানির কালে (অনাবৃষ্টির কালে) ফুলটুসির বাবা একটা বকনা বাছুর দিয়েছিল। বছর বিয়ানি। বছর পাঁচের মধ্যে ফুলটুসির ছোট্ট গোয়াল ঘর ভরে উঠল।

ফাতোবুড়ি খুব ভালো কাঁথা সেলাই করতে পারত। কুটি কুটি ফোড়। গাদানো সুতো। যে কাঁথায় জল ছেঁকে তোলা যায়। কাখালিতে কাঁথার ধামা নিয়ে ছাগল চরাতে গিয়ে গাছের নীচে বসে কাঁথায় ফুল, পাতা, পাখি, গাছ, ফুল ফুটে আছে এমন লতানো গাছের নক্সা আঁকত লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, কমলা পাড়ের সুতো দিয়ে। সেই সঙ্গে গুনগুন করে 'ভিটে কুমারী'র গান। সন্ধ্যে হলেই ফাল্গুনের পয়লা থেকে সংক্রান্তি পর্যন্ত নাতনির দলের সঙ্গে গান গাইতে হবে। তালিম না দিলে কী হয়? সুর করে গাইতে না পারলে নাতনিদের কাছে মান থাকে? সুর তুলে গায়। শোনে - পথচারী, গাছ, পাখি, আকাশ, বাতাস।

"ভিটে কুমোরীর মা লো; তোর ভিটে বাইন্দে দে, ভিটে বাইন্দে দে।
তোর ছাওয়ালের বিয়ে হবে সাঝনা আইনে দে,সাঝনা আনে দে।
বুড়ি গেলোরে সাজনা আনতি, পথে পোলো কাদা; পতে পোলো কাদা।
সেও কাদা ধুয়ে নিল চৈতনপুরির দেয়ায়, চৈতনপুরির দেয়ায়।
বরেরা বরেরা কী কী আইনোচো?; কী কী আইনোচো?
আর কিচ্চুই আনিনি, মেয়ের নাকের নত আনিচি, নত আনিচি।
ও নত ভালো না; টান দিয়ে ফেলিচি, টান দিয়ে ফেলিচি।
সেই নত, কল্লা শাউড়ি বেচে খায়েচে, বেচে খায়েচে।

ভিটে কুমোরীর মা লো; তোর ভিটে বাইন্দে দে, ভিটে বান্দে দে।
হ্যাচড়ার মা লো; তোর ফ্যাচড়া ফ্যাচড়া চুল,ফ্যাচড়া ফ্যাচড়া চুল।
তাই দিয়ে বানবো আমরা রাই সষর ফুল, রাই সষর ফুল।
আগে যদি জানতাম ডোল, ডালি ভরে থুতাম ফুল সারি সারি; ফুল সারি সারি।
ও-মালোনি কুড়োস্ নি ফুল;হাতেও তোর ফুলির সাজি, কাকে ও তোর জলের কলসি।
কেমন করে কুড়োবি ফুল, চাপা সারি সারি, চাপা সারি সারি।
"

স্কুলে যাওয়ার আগে নাতনিরা ঝুড়ি বোঝায় করে তুলে আনবে পুজোর ফুল। পাকড়াফুল, পালসে মান্দা, পিওফুল, ভাঁটিফুল, কেলেখোড়া, হ্যাঁচড়া ইত্যাদি অকুলীন ফুল। এ সকল গরিমাহীন ফুল বসন্ত প্রকৃতির রূপ বর্ধন করে যথেষ্ট পরিমাণে; যদিও লোক সমাজে মর্যাদা পায় না।। প্রত্যেকটা ফুলের আলাদা আলাদা গান আছে।

তাতেও একটু সুর তোলে,

"ভাঁটি ফুলি মারলাম বাড়ি
সে ফুল পোলো থলি থলি,
ও মালোনি ভালো না,
ফুলগুলো তো তোলে না।
"

গান শেষে নমষ্কার করে ঠাকুরের উদ্দেশ্য ফুল দেবে। প্রত্যেকটা ফুলই গান করে এইভাবে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে নিবেদন করবে।

প্রসাদ হবে আতপচাল, পাকাকলা, খেজুরের গুড়/পাটালি আর দুধ। প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় দল বেঁধে খেজুরের পাটিতে বসে পরস্পর পরস্পরের গলা ধরে দুলে দুলে গান করবে। প্রতিটি গানের শেষে উলুধ্বনি।

ভিটেকুমারী ঠাকুর ঘা-পাঁচড়ার লৌকিক দেবতা। মাটির তিনটি স্তরের উপর একটি শিবলিঙ্গের মত দণ্ড বসানো। দণ্ডের মাথায় কাঁটা সমেত কুলের ডাল। সর্ষের তেলে গোলা কালি, সিঁদুরের টিপ পরাতে হয় সপ্তাহে একদিন। বিসর্জনের দিন স্নান করে পরমান্ন রান্না করে কাঁটা বেগুনের পাতায় ঠাকুরকে নিবেদন করে ঠাকুর বিদায়ের গান ধরবে,

"এবার ঠাকুর যাও তুমি ঘা-পাঁচড়া নিয়ে, ঘা-পাঁচড়া নিয়ে।
সামনের বছর আইসো ঠাকুর শঙ্খ-শাড়ি প'রে; শঙ্খ শাড়ি প'রে।
"

জমানো এক মাসের ফুল, ঠাকুর তুলে বিলের জলে ভাসিয়ে দিয়ে স্নান করে উঠে আসবে মেয়েরা। কলাপাতায় গরম খিচুড়ি আর পরমান্ন তৃপ্তি করে খাবে। ফাতোবুড়ি নতুন করে তার ছোটোবেলাকে খুঁজে পায় এদের মধ্যে। এই এক মাসের সন্ধ্যেবেলাটা খুব আনন্দে কাটে। ফাতোবুড়ি নেই, নাতনিরা বরের ঘর করছে। এখন গ্রামের কোনো বালিকারা একমাসের ভিটে কুমোরী পুজো করে না। সময়ের বড্ডো অভাব যে! সকালে বিকালে প্রাইভেট পড়া। সন্ধ্যেবেলায় দূরদর্শনের অনুষ্ঠান। গ্রামও ঘরের মধ্যে বোকা বাক্সে বন্দী জীবনযাপনে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে।

(ক্রমশ)