"সুন্দরবনে সুন্দরী গাছ
সবচেয়ে সেরা সেই যে গাছ
গাছটি সুন্দরবনে
চারদিকে রোদ্দুর যেন ঝিলমিল ঝিলমিল কাঁচ,
কচি সবুজ পাতার নাচ।"
ছোটোদের জন্য লেখা এই ছড়ার গানটি আমার মেয়ে বারবার শুনতে চায়। আমারও খুব প্রিয় এই গান। এবার সুন্দরবনে গিয়ে সুন্দরী গাছের রূপ ঠিক এভাবেই ধরা পড়লো। প্রায় ২২ বছর আগে হোস্টেলের বন্ধুরা একসঙ্গে গিয়েছিলাম সুন্দরবনে। এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা ছিল। তখনকার সুন্দরবন আর এইসময় দেখে আসা সুন্দরবনের মধ্যে পার্থক্য হয়তো অনেকেটাই চোখে পড়বে। রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তন বেশ কিছুটা হলেও, সুন্দরবনের সৌন্দর্য একই রকম রয়ে গেছে। বাইন, গরাণ, গেওয়া, গোলপাতা, কেওড়ার জঙ্গলে ঘেরা দ্বীপগুলি আজও নীরবে আমাদের কাছে রহস্য উপন্যাসের মতো। মাতলা, গোমতী, বিদ্যাধরী, হেরোভাঙা, গাজিখালি নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কবিতার মতোই। বনবিবি কিংবা দক্ষিণরায় বাঁচিয়ে রাখে বাংলার লোকজ সাহিত্য-সংস্কৃতিকে। ঝড় আসে,উথাল-পাতাল হয় নদী। অরণ্য বাঁচিয়ে রাখে নদী-অরণ্য-পাড়ের মানুষের জীবন। বিশাল ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের মানুষের কাছে দেবী। প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝায় সমস্ত শরীর দিয়ে সে আঁকড়ে ধরে তার সন্তানদের। ধনা, তপন, দীপক চেনে এই জঙ্গল, ভাষা জানে সেই জঙ্গলের, নদীর কথা শুনতে পায় এরা। বাতাসের চলাচল ঠাওড় করতে পারে।নোঙর ফেলে, পাটাতন নামায়, রান্না করে। গান করে, গল্প শোনায়। কোনো একটি গ্রামের নাম হয়ে যায় বিধবা গ্রাম-বলতে বলতে চোখে জল আসে ধনার। মধু কাঠ মাছ কাঁকড়া সংগ্রহ করতে যায় যারা, তাদের অনেকেই আর ফেরে না তাদের প্রিয়জনদের কাছে। সুন্দরবনের বাঘের আক্রমণে বিপন্ন হয় তাদের জীবন। কিন্তু নোনা জলের স্বাদ, ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সবুজ মায়া, পাখির কলকাকলি তাদের সঙ্গী হয়ে ওঠে। খাঁড়ি এলাকায় প্রচুর কাঁকড়া, মাছ পাওয়া যায়। জীবিকা নির্বাহের জন্য তাদের তো ছুটে যেতে হবেই সেখানে।
অরণ্য বারবার কাছে ডাকে। 'জলে কুমির ডাঙায় বাঘ' এই প্রবাদকে ভালোবেসেই ছুটে যাওয়া সুন্দরবনে। সকাল সকাল ঝড়খালি পৌঁছে গেলাম আমরা, মানে 'গোত্রহীন', বন্ধুত্বের উষ্ণতা নিয়ে যারা পৌঁছে যায় মানুষের কাছে। ঝড়খালির অনিমেষ আমাদের পরিচিত বন্ধু। সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছিল অনিমেষ। বোট তৈরি। উঠে পড়লাম দলবল। কিছুদিন আগেই ঝড়খালিতে একটি নৌকাডুবির ঘটনা পর্যটনশিল্পকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। ফলে প্রশাসনিক কড়াকড়ি একটু বেশি। বোটের দায়িত্বে-থাকা তপনআমাদের কোন্ জায়গাগুলি দেখাবে সেগুলো জানিয়ে দিল।আমাদের গন্তব্য পাখিরালয়। হেরোভাঙা নদী আমাদের স্বাগত জানালো। নদীর ঢেউয়ের তালে তালে মেতে উঠল মন। নদী নিয়ে যত গান ছিল আমাদের এক এক করে গুনগুন করে উঠল সবাই। সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য শুধুই দুচোখ ভরে দেখতে হয়। জলেজঙ্গলে থাকা গল্প শুনতে শুনতে এগিয়ে যাওয়া। নদীতে নোঙর করে মধ্যাহ্নভোজ সেরে নেওয়া। অসামান্য রান্না। সূর্য তখন রাঙিয়ে তুলেছে নদীর জল।
সন্ধ্যার আগেই পৌঁছালাম পাখিরালয়। পাখিরালয়ের মূল আকর্ষণ গোসাবায় অবস্থিত হ্যামিল্টন সাহেবের বাংলো। দেখবার ইচ্ছে ছিল খুব। পাখিরালয় থেকে অটো করে কুড়ি মিনিটের দূরত্বে চলে গেলাম গোসাবা। সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে।গোসাবা থেকে গদখালি পৌঁছনোর জেটিঘাটে পৌঁছে মন ভরে গেল।
তারপর দেখতে গেলাম হ্যামিল্টন সাহেবের বাংলো।
"স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন, ভারতবর্ষে সমবায়ের অন্যতম পথিকৃৎ। এক অসাধারণ মানব-কল্যাণে নিবেদিত অদ্ভুত কর্মযোগী - অদ্ভুত এই কারণে যে মানুষের জন্য স্থায়ী কিছু করার জন্য সেই ১৯০২ সালে বেছে নিয়েছিলেন জল-জঙ্গলে ভরা সুন্দরবনের গোসাবা অঞ্চলকে। স্কটল্যান্ডে জন্ম বড়ো কোম্পানির কর্মকর্তা হয়ে ভারতে এসে শুধু ভালোবেসে চাকরি ছেড়ে দিয়ে গোসাবা নিয়ে কাটিয়ে দিলেন সারা জীবন।
১৯৩২ সালে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন গোসাবাতে। দুইদিন ছিলেন। অতিথিশালা বেকন বাংলোতে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লিখেছিলেন - "সমস্ত ভারতবর্ষের আদর্শ হউক গোসাবা"। বিডিও অফিসের পাশেই কাঠের সেই বেকন বাংলো আজও আছে, তবে দুই মহান সমবায়ীর এই ঐতিহাসিক মিলনতীর্থ অবহেলায় অনেকটাই জরাজীর্ণ। হ্যামিল্টন সাহেবের তৈরি করা ট্রাষ্ট এখনো চলছে গোসাবায়। স্কুল চলছে। কিছু জমি জায়গা আছে। সেই কালে বানানো তার কাঠের বাংলোটি কিন্তু হেরিটেজ ভবন হিসেবে বেশ সুন্দর ভাবেই সাজানো আছে। "আমরাও আবেগ বিহ্বল হয়ে পড়লাম, বিস্মিতও হলাম। একজন মানুষ অনেক মানুষকে ভালোবেসে থেকে গেলেন এই প্রত্যন্ত গ্রামে!
অনেক রাত পর্যন্ত আমরা ভেসে থাকি জলে। সমস্ত বোটাগুলোতে আলো জ্বলে ওঠে, আবার নিভেও যায়। একেবারেই অন্যরকম অনুভূতি।
পরেরদিন সকালে আমরা পাখিরালয় থেকে রওনা দিলাম সুধন্যখালির দিকে। গাজিখালি নদীর উপর দিয়ে আমাদের অনেকটা পথ যাওয়া। মাঝে গোমতীর নদীয়া। এই গাজিখালি টাইগার ফরেস্ট খুবই উল্লেখযোগ্য একটি এরিয়া।গাইড দীপকদা আমাদের সঙ্গে থাকলেন। বহু দিনের অভিজ্ঞতা তাঁর। ২০ বছর ধরে গাইডের কাজ করছেন।থাকেন পাখিরালয়েই।সুন্দরবনকে মন-প্রাণ দিয়ে অনুভব করেছেন। বাঘ-সুমারির কাজেও যুক্ত থেকেছেন। দুই ভাই ফরেস্ট ডিপার্টমেণ্টে কাজ করেন।তাঁর মুখ থেকে অনেক জানা-অজানা কাহিনি শুনলাম। সুন্দরবনের ১০২টি ব-দ্বীপের মধ্যে ৫৪টিতে মানুষের জনবসতি। বাকি ৪৮টি ম্যানগ্রোভ অরণ্য। আমাদের বোট গোমতী নদীর উপর দিয়ে যেতে যেতে সুধন্যখালির খালের ভিতরে প্রবেশ করলো। সেই পরিচিত পীরখালির জঙ্গল শুরু হলো।এই পিরখালী জঙ্গলের খাঁড়িগুলিতেই প্রচুর মাছ কাঁকড়া পাওয়া যায়। বাঘের আক্রমণে আক্রান্ত হয় জেলেরা। আমাদের গাইড শোনাচ্ছিলেন বাঘ কীভাবে মানুষের উপর আক্রমণ করে। তার কথা শুনে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল।
সুধন্যখালি ওয়াচ টাওয়ারে পৌঁছালাম আমরা। এখানে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ। গাছের গায়ে নাম অঙ্কন করা আছে, বাইরে গাছগুলির পরিচয় দেওয়া রয়েছে। গরাণ-গেওয়া-গর্জন-কেওড়া প্রভৃতি গাছকে প্রত্যক্ষ করলাম। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বিভিন্ন গাছের বৈশিষ্ট্য বুঝতে সাহায্য করল পরিচয়লিপি।ওয়াচ টাওয়ারে উঠে চোখে পড়ল সুন্দরবনের বিস্তৃত অরণ্যভূমি। এখানে রয়েছে বনবিবির মন্দির। ছোটো মন্দিরের পাশের বোর্ডে লেখা রয়েছে -
"সুন্দরবনের বাঘ-দেবতা দক্ষিণরায়ের পূজার সাথে সাথে বাঘের আক্রমণে রক্ষাকর্তী হিসেবে আর এক দেবী 'বনবিবি'র পূজা বিশেষ প্রচলিত। বাউলে, মোউলে, জেলে জঙ্গলে ঢোকার আগে বিশেষ ভক্তি সহকারে 'বনবিবি'র পূজা দেয়।"
আমাদের লঞ্চ ছেড়ে দিল। সুধন্যখালি সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্যের ডালি আমাদের হাতে তুলে দিল।
আমরা আবার অনেকটা খাঁড়ি পথ অতিক্রম করে পৌঁছাব দোবাঁকি। বিদ্যা নদীর পাড়ের এই জায়গা বনভূমিকে খুব কাছ দেখার জন্য আদর্শ। জালে-ঘেরা পথে অনেকটা গভীর অরণ্যে প্রবেশ করবেন, মনের ভিতরে শিহরণ জাগবে।বিভিন্ন রকমের গাছের সঙ্গে কথা কইতে পারবেন। এখান থেকে আমরা ফিরবো ঝড়খালি। পেরোতে হবে পঞ্চমুখানী। পাঁচটি নদী বঙ্গোপসাগরের দিকে চলেছে। এবার মন বলে উঠল 'কী দেখিলাম জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না!'। আবহাওয়া অনুকূল। পঞ্চমুখানী নিরাপদেই পেরোলাম। বোটচালকদের কথা অনুযায়ী এই জায়গাটি সত্যিই উত্তাল হয়ে ওঠে খুব জোড়ে বাতাস বইলে। তাছাড়া এখানকার আবহাওয়া হঠাৎ করেই পাল্টে যায়, উত্তাল স্রোতে প্রবল দুলতে থাকে বোট, ঘাবড়ে যায় আরোহীরা।যাইহোক নানা গল্প-গানে মেতে থেকে অনেকটা পথ চলে এলাম। আমাদের লঞ্চ এসে ঠেকলো ঝড়খালি ফেরিঘাটে। যাত্রা শুরুর দিনে আমরা ঝড়খালি বাঘ রেসকিউ সেণ্টারটি দেখিনি। সেটি ঘুরে দেখার পালা এবার। শান্ত নির্জন বনভূমির ভিতর দু-তিনটি স্তরে নেট দেওয়া রয়েছে। আহত অসুস্থ বাঘদের সেখানে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। চিকিৎসা চলে তাদের। অরণ্যের গন্ধ, নোনা জলের স্বাদ, হাজার পাখির কলকাকলি, বাঘের গল্প মনের ভিতরে মিশিয়ে নিয়ে রওনা দিলাম বাড়ির দিকে।
কীভাবে যাবেনঃ সরাসরি ছোটো গাড়িতে ঝড়খালি চলে যেতে পারেন। নাহলে ক্যানিং পর্যন্ত ট্রেনে গিয়ে তারপর ছোটো গাড়ি নিতে পারেন।
কোথায় থাকবেনঃ বোটে রাত কাটাতে পারেন। পাখিরালয়ে অনেক হোটেল আছে।
কখন যাবেনঃ শীতের সময়টাই বেশি উপভোগ্য।