(১৯২৬ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর এসেছিলেন, এনেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। কবিকে কেন এনেছিলেন তিনি? শুধুই বন্ধু বলো। প্রতিভাবান কবি বলে? মাস ছয় সাতেক গোলাপটিতে থেকে কবি গ্রেস কটেজে আসেনা ঠিক করে আসেন তিনি? জুলাই, নাকি আগস্ট? কেনই বা এলেন এই বাড়িতে? ভীষণ দারিদ্র্যের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে? অনেক কিছুই আমরা জানি না, জানাও যায় না। এখান ওখান থেকে জোগাড় করা তথ্য আর তার সাথে খানিক অনুমান মিশিয়ে টুকরো কথার কিছু দৃশ্য সাজিয়ে তোলার চেষ্টা এই কাহিনীতে।)
পর্ব - ৪
বিস্ময়ে অবাক হচ্ছিলেন নজরুল। এতো কথা তো জেলে থাকার সময় বলেনি বিজয়। - তারপর আর কি বাবা। হাই স্ট্রীটের সেই স্কুলের ঘরেই থাকে ওরা। এতোদিন পার হয়ে গেল, প্রায় রোজই একবার করে আসে, গল্প করে, হৈচৈ করে - কিন্তু এক গ্লাস জল পর্যন্ত খায় না। একবার ভাবেন তো দিদি, আমি বাড়িতে রোজ রান্না করি। আমার ছেলেরা চোখের সামনে কিছু মুখে না দিয়ে চলে যায়, সে ভাত মুখে তুলতে আমার কেমন লাগে?
কিরণময়ী মাথা নিচু করলেন। পরিবেশটা কেমন বিষণ্ন হয়ে গেল। কারো মুখেই কথা নেই। এ কথার উপরে কী আর মন্তব্য করা যায়। কিরণময়ীই কথা বলে বাতাসটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন -
"আমিও বলেছি - হয় তুমি তোমার চাকরি ছাড়ো, না হয় আমিও এই গৃহত্যাগ করে চলে যাবো। তোমার ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া যে অন্ত আমার ছেলেরা মুখে দিতে পারে না, সে অন্ন আমিই বা মুখে দিই কী করে? তোমার বাবা তো কম সম্পত্তি রেখে যাননি? বুঝতে পারি, তোমার মেসোমশায় ছেলেদের জন্য ভিতর ভিতর কষ্ট পায়। আমার কাছে খবর নেয়, কিন্তু নিজে থেকে কিছু বলবে না। কী বলব দিদি - কথায় আছে না, ঢাকার বাঙাল, তাদের গোঁ তো কম যায় না!"।
বলতে বলতেই বাইরে পায়ের আওয়াজ, হেলেন লাফিয়ে উঠল - বাবা চলে এসেছে। বৈঠকখানা ঘরে প্রবেশ করেই নজরুলের দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করলেন কিশোরীলাল
"শুনলাম আমার ঘরে বাংলার বিখ্যাত বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম এসেছেন। আমার কী সোভাগ্য!" সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী পরিহিত গৌরবর্ণ দীর্ঘদেহ সৌম্যকান্তি সুপুরুষ। গায়ে একখানি কাশ্মীরী শাল জড়ানো, এতো শীতেও অন্য কোনো শীতবস্ত্র নাই। চেহারায় একটা জমিদার সুলভ ব্যক্তিত্ব। কিশোরীলাল ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াতেই নজরুল সোফা ছেড়ে উঠে তাঁকে প্রণাম করলেন। কিশোরীলাল একটু হতচকিত বিরত স্বরে বলে উঠলেন, "সেকি! আপনি কত উঁচু মাপের গুণী মানুষ। ব্রিটিশ রাজ আপনার ভয়ে কম্পমান,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপনাকে নাটক উৎসর্গ করেন। আপনি আমাকে প্রণাম করলে বড়ো অস্বস্তি হবে।" - মেসোমশায়, আপনার সম্পর্কে শুনেছি, আপনিও যথেষ্ট গুণী মানুষ। আর আমি তো বিজয়ের সমবয়সী। আমাকে আপনি বললে সেটা ভারি
অন্যায় হবে। হেলেন সঙ্গে সঙ্গে কলকল করে উঠলো - "না বাবা, বড়দার চেয়ে কাজিদা তিন মাসের বড়ো। আমি শুনেছি!"
ওর কথা এবং তা বলার ধরনে ঘরে একটা হাসির ঢেউ ছড়িয়ে গেলা কিশোরীলাল হাসতে হাসতে বললেন, "ঠিক আছে বাবা, বোসো।"
- তুমি তো অনেক খবর রাখো দেখছি! নজরুল হেলেনের দিকে তাকিয়ে বললেন।
কিশোরীলাল উত্তর দিলেন - "হেলেন তো খবরের গেজেট। পাঁচ রকম খবর জোগাড় করা ছাড়া তো ওর কোনো কাজ নেই। শুধু বকবক করা আর দাদাদের পিছন পিছন বিপ্লব করে বেড়ানো। তা সে বিপ্লবীরা কই?
হেলেনের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর - তুমি আসার আগেই ওরা চলে গেছে বাবা।
নজরুলের দিকে তাকিয়ে কিছুটা অনুযোগের সুরই ঝরে পড়ল কিশোরীলালের কন্ঠে - আমার অন্ন গ্রহণে না হয় আপত্তি বুঝলাম, কিন্তু কথা বলতেও আপত্তি?
"তোমরা এবার কথা বলো। দিদি চলুন, আমরা ভিতরে যাই। আশা এসে চা দিয়ে যাচ্ছে।" কিরণময়ী উঠলেন। আশাও দোলনের হাত ধরে ভিতরে চলে গেল।
"তুমি আমাদের বাড়ি আসছ শুনে থেকে আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে আছি। তোমার সাথে কথা বলা, তোমার নিজের কন্ঠে গান শোনার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের।" বললেন কিশোরীলাল।
- কেউ আমার গান শুনতে চাইলে আমি সর্বাপেক্ষা বেশি আনন্দ পাই।
- হ্যাঁ, তার সঙ্গে যদি চা এবং পান থাকে।
এক হাতে চায়ের ট্রে আর আরেক হাতে গরম ডালের বড়া নিয়ে আশার প্রবেশ। পিছনে হেলেনের হাতে চিনেমাটির প্লেটে সাজানো পানের খিলি।
আশার কথায় নজরুল ঘর কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন।
"গান, পান আর চা - এই তিন হচ্ছে আমার নেশার বস্তু।
কিশোরীলাল বললেন - এক সময় আমার এই ঘরেই কত গানের আসর বসেছে। নাটকের রিহার্সালও করেছি। বাইরে কাঁঠাল তলায় মঞ্চ সাজিয়ে ঘরোয়া পালাও হতো।
- এখন আর হয়না?
- দেখতেই তো পাচ্ছ বাবা, দিনকাল কেমন বদলে গিয়েছে। স্বদেশী আন্দোলন তো সারা দেশেই হচ্ছে, কিন্তু কৃষ্ণনগরে যেন সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন তো ব্রিটিশ সরকারকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। তুমিও তো এতো আবেগ দিয়ে চরকার গান লিখেছ, মানুষের মনকে নাড়িয়ে দেয়। কিন্তু কৃষ্ণনগরের ছেলে ছোকরাদের তাতে মন ভরে না। অহিংসা দিয়ে নাকি কিছু হবেনা! তুমি বিপ্লবী মনের মানুষ, দেশ ও দশ নিয়ে অনেক জ্ঞান, অনেক অভিজ্ঞতা। তোমার লেখা পড়ে যুবকেরা উদ্দীপিত হয়। তোমাকেই আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় -
দু'চারটে গুলি-বোমা বন্দুক দিয়ে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়? তোমারও কি তাই মনে হয়? নজরুল মন দিয়েই শুনছিলেন কিশোরীলালের কথা। একটুখানি চুপ থেকে বললেন -
"মেসোমশায়, এক কথায় এর কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। গান্ধীজির অহিংসা-মন্ত্রের কী জাদুশক্তি তা আমি নিজেও অন্তর দিয়ে অনুভব করেছি। তাঁর ডাকের সততা, জাতি-ধর্ম-অস্পৃশ্য নির্বিশেষে মানুষকে মর্যাদা প্রদান - সত্যি সারা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তাঁর আবেদনের শক্তি দেখে কেঁপে উঠেছে ব্রিটিশ শাসক। কিন্তু ইদানীং আমার মনে হয়েছে, কেঁপে উঠলেও গান্ধীজিকে ব্রিটিশ শক্তি আর ভয় পায়না।
- গান্ধীকে ভয় পায়না ব্রিটিশ? বলো কি? হ্যাঁ মেসোমশায়, তারা বুঝে ফেলেছে যে কংগ্রেস দলের নেতারা গান্ধীর চরকার শক্তিটাকে ব্যবহার করছে শুধু নিজেদের রাজনীতি আর দেশের ধনিক-বর্ণিক জমিদার এবং ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর স্বার্থে। গতবছর ভোটের সময় বসিরহাটের গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি কুতবউদ্দিনের হয়ে প্রচারের জন্য। দেখেছি কৃষক-শ্রমিক কামার-কুমোরের মতো সাধারণ গরিব মানুষের মধ্যে ভোট বা রাজনীতি নিয়ে কোনো হেলদোল নাই, উৎসাহ নাই।
তাদের তো ভোট নাই, সুতরাং তাদের নিয়ে দেশের রাজনীতি কিছু ভাবে না, ওরাও দেশের রাজনীতি নিয়ে কিছু ভাবে না। কংগ্রেসের এই আপোষ আর দরাদরির প্রতি যুবসমাজের ক্ষোভ জন্মানো তো স্বাভাবিক। - কিন্তু তাই বলে বোমা-বন্দুক নিয়ে ডাকাতি করা আর দু'একজন সাহেবকে মেরে কি সেই উন্নতি হবে? এই যে অনন্তহরির মতো কত গুণী, কতো দেশসেবী ছেলে - এরা জেলের বাইরে থাকলে কি দেশের বেশি উপকার হতো না?
নজরুল কিছু বলার আগেই স্বমহিমায় হেলেনের প্রবেশ - "আর আলোচনা চলবে না! সব স্থগিত! ভিতরে ডাক পড়েছে!"
(ক্রমশঃ)