১৬টি নামের এই তালিকাটি দেখুন -
কার্তিক মাইতি, উত্তম চাউলে, সমীর দাস, অলোক দাস, সনৎ বসু, নবীন নস্কর, কল্যাণ সামন্ত, অসীম চ্যাটার্জী, রবীন আদক, কার্তিক মাঝি, ধনঞ্জয় দাস, শ্যামল বিশ্বাস, মদনমোহন বাগলি, প্রশান্ত দত্ত, হিমাংশু শেখর দাস এবং বিশ্বজিত কর। (বিশ্বজিত করের নামটা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে, কেউ কেউ জোরের সঙ্গে বলেন, সেদিন তিনি জীবিত ছিলেন)।
এই ১৬টি নাম কারো শোনা? অথবা এদের কাউকে আপনারা কেউ চেনেন? মনে পড়ছে না ঠিকঠাক? না কি আবছা আবছা মনে আসছে কিছু দৃশ্য, কিছু দুঃসহ আর বীভৎস স্মৃতি? না, আর বোঝা চাপাবেন না স্মৃতির উপর।বরং কলকাতা ময়দানের এক বিশেষ দিনের একটা কাহিনী নয়, “গল্প হলেও সত্যি” শুনে যান, আজ।
১৬ আগস্ট ১৯৮০। যে দিনটির কথা গত ৪৩ বছর ধরে তাড়া করে বেড়াচ্ছে আমাদের। আর একইসঙ্গে কলকাতা ময়দানের মেঠো হানাহানির রক্তাক্ত সময়কে ঘিরে ফেলে এক নিদারুণ লজ্জার ইতিহাস। ৪৩ বছর পিছিয়ে আজ আবার একবার ফিরে দেখে নেওয়া যাক সেই লজ্জার ইতিহাস। এবং সেই গ্লানিবোধে আর একবার প্রায়শ্চিত্ত করি সেই পঙ্কিল পাপের দিনটির মাথা নীচু করে দেওয়া পিচ্ছিল কর্মকান্ডের।
কম্পটন দত্তর নেতৃত্বে মোহনবাগান টিম সেবারে দারুণ ব্যালান্সড ছিল। গোলে শিবাজী ব্যানার্জী, ডিফেন্সে ক্রম্পটন দত্ত-সুব্রত ভট্টাচার্য-প্রদীপ চৌধুরী-শ্যামল ব্যানার্জী, হাফব্যাকে গৌতম সরকার-প্রসূন ব্যানার্জী আর ফরোয়ার্ডে মানস ভট্টাচার্য-মিহির বসু-জেভিয়ার পায়াস-বিদেশ বসুরা সেবার মোহনবাগানের হয়ে দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলছিলেন শুরু থেকেই।। তবুও ফেডারেশন কাপে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে যুগ্মবিজয়ী হতে হয় মোহনবাগানকে। আর তাই মোহনবাগান মুখিয়ে ছিল কলকাতা লীগ এককভাবে জিততে।
অন্যদিকে দলবদলের বাজারে মহমেডান স্পোর্টিংয়ের কাছে তছনছ হয়ে যাওয়া ইস্টবেঙ্গলকে সেবার প্রায় একা টানছিলেন ইরানের প্রাক্তন বিশ্বকাপার মজিদ বাসকার। সাথে "বুড়ো ঘোড়া" মহম্মদ হাবিব আর সুধীর কর্মকার এবং টগবগে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। কলকাতায় ফেডারেশন কাপে মজিদের খেলা দেখে ইস্টবেঙ্গল জনতা বুঝে যায় যে, ছেড়ে যাওয়া ফুটবলারদের জন্য তাঁদের খুব বেশি আফশোস করতে হবে না। তাদের ত্রাণকর্তা এসে গেছেন। ইস্টবেঙ্গল জনতা লুফে নিয়েছিলেন মজিদকে। ফেডারেশন কাপে মোহনবাগানের সঙ্গে যুগ্মবিজয়ী ইস্টবেঙ্গল কলকাতা লীগেও মোহনবাগানকে সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছিল।
২টি গ্রুপে ভাগ করে খেলা হচ্ছিল সেবার কলকাতা লীগে। একই গ্রুপে ছিল ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান। অন্য গ্রুপে ছিল সেবারের অমিত শক্তিধর মহমেডান স্পোর্টিং টিম। ১৬ আগস্ট ১৯৮০ তারিখে গ্রুপের ম্যাচে ইডেনে মুখোমুখি হয় মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হলে লীগের প্লে অফ সেমিফাইনালে মহমেডান স্পোর্টিংকে এড়িয়ে যাওয়া যেত, তাই মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল দুই পক্ষই মরিয়া ছিল ঐ ম্যাচটি জিততে।
সেই লজ্জা-দিনের খেলোয়াড়, কোচ ও রেফারির নাম ছিল এইরকম -
মোহনবাগানঃ শিবাজী ব্যানার্জী, কম্পটন দত্ত (অধিনায়ক), সুব্রত ভট্টাচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, শ্যামল ব্যানার্জী, গৌতম সরকার, প্রসূন ব্যানার্জী, মানস ভট্টাচার্য, মিহির বসু, জেভিয়ার পায়াস (উলগানাথন) ও বিদেশ বসু।
অতিরিক্তঃ জগদীশ ঘোষ, প্রতাপ ঘোষ, ফ্রান্সিস ডি’সুজা, শ্যাম থাপা, রঞ্জিত মুখার্জী, কৃষ্ণ মিত্র, মুনীশ মান্না, সঞ্জীব চৌধুরী ও অশোক চক্রবর্তী।
কোচঃ অরুণ ঘোষ।
ইস্টবেঙ্গলঃ দিলীপ পাল, দিলীপ পালিত, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সমর ভট্টাচার্য, সত্যজিত মিত্র (অধিনায়ক), মহম্মদ হাবিব (হরজিন্দার সিং), সুধীর কর্মকার, মহম্মদ খাবাজী (কাজল চ্যাটার্জী), তপন দাস, জামশিদ নাসিরি ও মজিদ বাসকার।
অতিরিক্তঃ নাসির আহমেদ, মহম্মদ নাজীব, সুভাষ রায়, অমিত গুহ, সোমনাথ ব্যানার্জী, সৈয়দ লতিফুদ্দিন, সুমিত বাগচী, টমাস ম্যাথুজ ও বিভাস সরকার।
কোচঃ পি. কে. ব্যানার্জী।
রেফারীঃ সুধীন চ্যাটার্জী।
এই পটভূমিকায় খেলা শুরু হতেই চোরাগোপ্তা এবং সরাসরি বিসদৃশ ফাউলের বন্যা বইতে থাকে প্রথমার্ধে। মরিয়া ফাউলের স্ট্র্যাটেজিতে দু’পক্ষই প্রতিপক্ষের খেলা নষ্ট করার মারণখেলায় মেতে ওঠে। তিলধারণের জায়গা না থাকা গ্যালারীতে দু’দলেরই সমর্থকরা ফুঁসে ফুঁসে উঠছিলেন মাঝে মাঝেই। মাঝে মাঝেই ইট ছোঁড়াছুঁড়ির সমান্তরাল খেলা চলছিল রণজি স্টেডিয়াম (যেখানে এমনিতে টিকিট দেওয়া হতো না, সেদিন হয়েছিল) আর আকাশবাণীর সামনের গ্যালারির দর্শকদের মধ্যে। এইভাবে চলতে চলতেই প্রথমার্ধ শেষ হয়ে যায় গোলশূন্য অবস্থায়। তখনো কেউ জানতেন না কি ঘটতে চলেছে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই কয়েক মিনিটের মধ্যেই।
প্রথমার্ধে বিদেশ বসুর তীব্র গতি সামলাতে না পেরে কোচের নির্দেশে অনভ্যস্ত রাইট ব্যাকে খেলা টাফ ডিফেন্ডার দিলীপ পালিত বেশ কয়েকবার বাজে ফাউল করে ফেলেছিলেন বিদেশ বসুকে। তখন থেকেই ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটছিল বিদেশ বসুর। দ্বিতীয়ার্ধের খেলার বয়েস বারো মিনিট তখন। আবার একটি বিশ্রী ফাউল করেছিলেন দিলীপ পালিত, বিদেশ বসুর বিরুদ্ধে। এবার বিদেশ বসু বলছাড়া পাল্টা লাথি মেরে বসেন দিলীপ পালিতকে। তখনই রেফারী সুধীন চ্যাটার্জী দু’জনকেই লালকার্ড দেখান।
আগুনের ফুলকি হয়ে থাকা গ্যালারীতে ঘৃতাহুতি হয় সেই মুহূর্তে। রণজি স্টেডিয়ামের স্ট্যান্ডেই দু’পক্ষের সমর্থকদের মুখোমুখি সংঘর্ষ, কয়েকজনের পড়ে যাওয়া আর প্রাণভয়ে ভীত সমর্থকদের নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সৃষ্ট হুড়োহুড়িতে পড়ে যাওয়া সমর্থকদের মাড়িয়ে চলে যাওয়া - সব মিলিয়ে নরক হয়ে যায় ইডেন সেদিন। মারা যান অন্তত ১৬ জন (মতান্তরে ১৫ জন) সমর্থক। আহত আর মৃত দেহগুলি হাতে হাতে ঝুলিয়ে আপার টায়ার থেকে নামানো হতে থাকে নীচের টায়ারে। এসময় প্রায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকা পুলিস কিছু পরে লাঠিচার্জ শুরু করে অন্য গ্যালারীতে নিরীহ দর্শকদের উপর। বহু লোক তাতে আহত হন।
কলকাতার হাসপাতালগুলি বীভৎস চেহারা নেয় সেই সন্ধ্যেয়। খেলা শেষ হয়েছিল ঐ গোলশূন্য অবস্থায়। লীগও আর শুরু করা যায়নি সেবার। সেদিনের সেই মাঠের লজ্জা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় আপামর ফুটবলপ্রেমীদের আর সেদিনের খেলোয়াড়দের। মনে করতেও ভয় পান তারা সেই দিনটাকে। আইএফএ ১৯৮১ থেকে প্রতিবছর এই দিনটা ফুটবলপ্রেমী-দিবস হিসেবে পালন করে ইডেনের ক্লাবহাউসে রক্তদান অনুষ্ঠান সংগঠন করে, যেখানে প্রশংসাপত্র সই করেন পুরনো দিনের কোন বিখ্যাত ফুটবল তারকা। পরে মান্না দে তার বিখ্যাত গান “খেলা ফুটবল খেলা” গেয়েছিলেন এই দিনের স্মরণে। সেদিনের সে লজ্জা কিন্তু এসবে ঢাকেনি। ফিরে আসেনি হারিয়ে যাওয়া জীবনগুলোও।
বুকের মধ্যে যতদিন অনুভূতি বেঁচে থাকবে, ততদিন মনে পড়বেই ১৯৮০র সেই নিকষ কালো দিন ১৬ আগস্টের কথা। সে আপনি সবুজমেরুন বা লালহলুদ বা অন্য যে রঙেরই সমর্থক হোন না কেন!
আবেগ, উন্মাদনা, উত্তেজনা, সব থাকুক। কিন্তু আর নয় ১৬ই আগষ্ট ১৯৮০। সেই ১৬ জনকে (মতান্তরে ১৫ জনকে) আমার কান্নাভরা প্রণাম।বেঁচে থাক কলকাতার ফুটবল, অন্তত তাঁদের প্রাণের বিনিময়ে।