আমার ভবঘুরে জীবনে অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এই দেখা হওয়া পরিকল্পিত ছিল না। ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যাওয়া। এরকমই ভাসতে ভাসতে একসময়ে দেখা হয়েছিল ভি. বালসারার সঙ্গে। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে - হিন্দ সিনেমা হলের উল্টোদিকের গলিতে তিনি থাকতেন। বৌবাজার অঞ্চলে। একদিন এক প্রেসের মালিকের সঙ্গে ভি. বালসারার বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। যতদূর মনে পড়ে, তখন তাঁর আত্মজীবনী 'রাগরাগিনীর দিনগুলি' প্রকাশের আয়োজন চলছে। সেই বইটির বিষয়ে কথাবার্তা বলেছিলেন প্রেসের মালিক। আমি খানিকটা ফাইফরমাস খেটেছিলাম। আনন্দের সঙ্গে সেই কাজ করতাম। কিন্তু ঘটনা হলো, তারপরেও আমি একাই বালসারা সাহেবের বাড়িতে গিয়েছি। রিহার্সাল দেখেছি। কীভাবে তিনি কন্ডাক্ট করছেন আমি দেখতাম। সে এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। হেমন্ত, সন্ধ্যার গানের সুর। 'হাটারি', 'কাম সেপ্টেম্বর' সিনেমায় ব্যবহৃত সুর তিনি বাজাতেন। যতদূর মনে পড়ে, তাঁর দলের নাম ছিল - 'সাজ ও আওয়াজ'। সেখানে মাঝে মাঝে যেতাম। সে এক মধুর দিনযাপনের অভিজ্ঞতা। ভি. বালসারা সাহেব আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। এর কারণ আমি জানিনা। আমাকে একদিন বলেছিলেন, "মারোয়া আর পুরিয়ার মাঝখানে বাজাতে পারো"? আমি তো অবাক! আমি কিছুই বাজাতে পারিনা। তিনি বললেন, "জীবনের সর্বক্ষেত্রেই মারোয়া আর পুরিয়ার মাঝখানে বাজাবে"। এইরকম নানা ধরণের রহস্যময় কথা বলতেন। আমার ভালো লাগতো।
১৯৮২ সালে আমার পাড়ার এক দিদির কিডনির অসুখ হয়েছিল। অনেক টাকার প্রয়োজন। এই টাকার প্রয়োজনে অবন মহল প্রেক্ষাগৃহে একটি অনুষ্ঠান করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। ভি. বালসারার কাছে প্রস্তাব দিলাম। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে তিনি রাজী হলেন। নির্দিষ্ট দিনে আমরা বিকেল বেলায় বালসারার বাড়িতে পৌঁছেছিলাম। সঙ্গে ছিল পুরোনো গাড়ি। তিনি সেই গাড়িতে উঠতে আপত্তি করছিলেন। তবু প্রায় জোর করে তাঁকে সেই গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে এলাম অবন মহলে। তারপরে আরও আশ্চর্য যেটা ঘটেছিল, অনুষ্ঠান শেষে ভি. বালসারাকে আমরা দুশো টাকা দিয়েছিলাম প্রণামী। তিনি সেই টাকা ফেরত দিলেন এবং এই ঘটনা প্রচার করতে নিষেধ করলেন। আমরা বিস্মিত, এরকমও মানুষ হয়! হ্যাঁ এরকমই মানুষ ছিলেন ভি. বালসারা। মহৎ শিল্পী। আমাদের বেঠোফেন, আমাদের মোৎজার্ট ভি. বালসারা। তাঁর প্রয়াণে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত স্মরণসভায় আমি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছিলাম। সেইটি বোধহয়, ভি. বালসারাকে নিয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম কবিতা। আমি ধন্য। ভি. বালসারা ছিলেন বাঙালির চেয়েও বেশি বাঙালি। তিনি কলকাতায় এসে আর ফিরে যাননি। কারণ, "কলকাতায় আসা যায়, কিন্তু ফেরা যায় না"।