বিবিধ

আমার শিক্ষক - প্রথম পর্যায় [মুক্তগদ্য]



চিরঞ্জীব হালদার


কাছারি পুকুরের ধারে পুলিশ আর মানুষে ছয়লাপ। কোনো শোরগোল নেই। সবাই কেমন মুখে কুলুপ এঁটে আছে। একটা চাপ চাপ গুমোট কাছারি পুকুরের জলে গুম মেরে আছে।

আমড়া পাড়তে যাবো বলে বাংলা প্যান্টের পকেটে মাটির ঢিলে ভর্তি। হাগু পাছায় লোকে যেমন হাঁটে তেমন আমি চৌধুরীদের সংলগ্ন মাঠ দিয়ে ঢিল পকেটে সেই স্বাদু আমড়া গাছটার দিকে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি মুহুরী মাস্টার প্রাণপণে উর্দ্ধশ্বাসে ডোবা পুকুরের পাশ দিয়ে আমড়া গাছের দিকে দৌড়ে আসছে। সেরেছে আমার আমড়া চুরির প্ল্যানটা কি মাস্টারমশাই জেনে গেল। ও বাবা দেখি তিনি আমড়া গাছ ছাড়িয়ে সোজা বাদায় লাফ মেরে একেবারে কানুর পল্টির দিকে পগার পার।

তিনি স্কুলের প্রেমিসেসে পরিত্যক্ত জনহীন এক ঘরে সপরিবারে থাকেন। সন্ধ্যের পর সেই দিকে যেতে গেলে বুকটা ছম ছম করতো। দুই ছেলে। মিঠু আর বিকু। যত দূর দেখেছি তার মত নির্বিবাদী, নির্ভেজাল মানুষ। সেই সময় তাকে মনে হয়েছে এক অপার সাদাসিদে মানুষ। আমাদের বোধে তিনি কেমন শিক্ষক জানি না তখন। একদিন স্কুল পালানো দুপুরে উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের মুখোমুখি পড়ে যাই। তারা জিজ্ঞেস করেছিল, কার ক্লাস ফাঁকি দিলাম। বিএম-এর নাম বলতেই তাদের নীরব ভর্ৎসনা আমাকে তাড়া করেছিল।

বিকেল হলে কোন সঙ্গ ছাড়াই স্কুলের সামনে ফুটবল মাঠের এক কোনে তাকে নির্মোহভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতুম। জানি না তিনি বাঙাল না ঘটি। তবে কখনও কখনও মাছ বাজারে তার দিনাজপুরীয় টানে তাকে মাছের দাম জিজ্ঞেস করতে শুনেছি। আমরা জানতাম না হিলি‌ নামে কোনো শহর আছে। পরে শুনেছি, ইনি যৌবনে অনুশীলন সমিতির সদস্যদের প্রাক স্বাধীনতার আমলে হোস্টেলে ঠাঁই দেওয়ার কারনে হয়ত চাকরিটা হারিয়েছেন। সবটাই অনুমান।

ষাট-এর দশকের শেষে কিভাবে যে এই গাব্বেড়েতে শিক্ষকতায় এসেছিলেন। জানি না। গ্রামের ধনঞ্জয় দাদুর সাথে শুনেছি তার সখ্যতা। শুনেছি তার বোনের সাথে বিবাহেরও কথা হয়েছিল। কিন্তু সবাই দাদুকে দুষেছিল অমন একচোখো মাস্টারের হাতে বোনকে পাত্রস্থ করার। অনেকের কাছে বি.এম.-কে ছোট হতে হয়েছিল শুনেছি।

মুহুরী স্যার সর্ববিষয়ে পারদর্শী। আর এমনভাবেই পড়াতেন ছাত্র মনোযোগের আধা হলে সবেতেই ৬০ শতাংশ নম্বর বাঁধা। অবশ্য আমি তার অনেক অগা ছাত্রের অন্যতম।

দশম শ্রেনীতে আমি অসমাপিকা ক্রিয়া আর ভূগোলের কাশ্মীরের ফাটা বাঁশে আটকে পড়ে মুহুরী স্যারের দ্বারস্থ হই। একেবারে বিনা পারিশ্রমিকে কেন যে পড়াতে রাজি হয়েছিলেন কে জানে। আগে কখনও তাঁকে কাউকে বিনা পারিশ্রমিকে পড়াতে দেখিনি।

অনেকের সাথে তাঁর বনতো না। টিচার্স রুমে তাঁর উচ্চনাদী গলাও কখনও শুনেছি বলে মনে পড়ে না। বিরলকেশ দোহারা চেহারা ধুতির খুঁট ধরে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষকটি যে আসলে শিক্ষকই তা বর্হিবিশ্বে না বেরোলে এই বোধ অধরা থাকতই। তাঁর মূল্যবোধ ও চলাফেরা গড়পরতার বাইরে।

আমার সমস্ত গুরুচন্ডালী বোধ এখনও যেন তাঁকে ছুঁয়ে বেঁচে আছে।