আজ পয়লা চৈত্র। অমলকান্তি দত্ত মজুমদারের পঁয়ষট্টি বছরের জন্মদিন। দীর্ঘ কর্মজীবনের পরে এখন অবসর জীবনের ক্লান্তি, শ্রান্তি, ব্যস্ততাবিহীন দিনযাপন। বসন্ত রায় রোডের বাড়িটার বয়স নিতান্ত কম হলো না। কৈশোরের শেষ পর্বে মামার তত্ত্বাবধানে মা ঠাকুমার আগ্রহে এই বাড়ির সৃষ্টি। বিবেকানন্দ রোডের তিনপুরুষের মহলার মহিমা ত্যাগ করে দক্ষিণ কলকাতার এই অঞ্চলে ছোট একটা বাড়ি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অমলকান্তির এই দুই অভিভাবিকা - ঠাকুমা আর মা।
ঠাকুমার নাম ছিল নারায়ণী আর ঠাকুরদার নাম ত্রিদিবনারায়ণ দত্ত মজুমদার। ঠাকুমা যেমন লক্ষ্মীর প্রতিমূর্ত্তি, ঠাকুরদা তেমনই রাশভারী দুঁদে উকিল। তবে তাঁদের জীবনযাত্রায় কোনও মালিন্য ছিল না। স্নেহ, সম্মান, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস অর্থাৎ যা যা থাকলে একটা সংসার ঝলমল করে উঠতে পারে সব তাঁদের মধ্যে ছিল।
এঁদের একটি পুত্রসন্তান - সুশোভন দত্ত মজুমদারের - অর্থাৎ আমি। বলাই বাহুল্য অমলকান্তি দত্ত মজুমদারের বাবা সুশোভন দত্ত মজুমদারকে নিয়েই এই আখ্যানের উপস্থাপনা। এবার লেখাটা প্রথম পুরুষে শুরু করছি।
আমার বাবা ছাত্রজীবনে মেধাবী ছিলেন, কিন্তু প্রকৃতিতে ছিলেন উগ্র, দাম্ভিক। মানুষকে সম্মান করার মতো শালীনতা তাঁর ছিল না। নিজের যোগ্যতায় রেলের ভালো পদে যোগ দেন। কর্মকুশলতায় তাঁর খ্যাতি ছিল কিন্তু তাঁর অহংকার লোককে আহত করত। তিনি সাধারণ মায়া, মমতা, সংবেদনশীলতাকে ব্যঙ্গ করতেন।
আমার বাবার এই আচরণ তাঁর পিতামাতাকে নিরন্তর অসুখী করে তুলছিল। উপায়ান্তর না দেখে তাঁরা আর একটি ভুল করে বসেন। অল্পবয়সী পরমা সুন্দরী একটি ভব্য শিক্ষিত পরিবারের মেয়েকে পুত্রবধূ করে আনেন। আমার মায়ের নাম ছিল মাধুরী। বেথুন থেকে বি.এ. পাস করেছিলেন। তাঁর একমাত্র দাদা ডাক্তার আর বাবা অধ্যাপক। মাধুরী যেন তাঁর নামের সার্থকতা বহন করতেন। মাধুর্যমণ্ডিত রূপ এবং মধুর ব্যবহার। ভালো গান করতেন। দাদু ঠাকুমা আনন্দে আত্মহারা। কিন্তু বাবা তাঁর দুর্বিনীত ব্যবহারকে মায়ের প্রতি তীব্র করে তুললেন। এই অমার্জিত আচরণ এবং স্ত্রীর প্রতি অমানবিক নিপীড়ন আমার মাকে বেদনায় জীর্ণ করে তোলে। তখন তিনি সন্তানসম্ভবা।
লোকে বলে ত্রিদিব উকিল তাঁর জীবনের সেরা মামলার রায় দিয়েছিলেন এই সময়ে। আমার বাবার আরও কিছু দোষ এই সময়ে প্রকট হয়ে ওঠে, যেটা হয়তো আগেও ছিল কিন্তু ঠাকুরদা টের পাননি। অর্থ উপার্জন এবং পারিবারিক স্বচ্ছলতা তাঁকে সুরাপ্রেমী, জুয়াড়ি এবং পরনারী আসক্ত করে তুলেছিল। মা হয়তো অনুভব করেছিলেন, কিন্তু আরও নির্যাতনের ভয়ে নিশ্চুপ ছিলেন। হাইকোর্ট পাড়ায় এই সময়ে নারীঘটিত একটি মামলা হয়। ঠাকুরদা আবিষ্কার করেন এর কেন্দ্রে রয়েছে তাঁর একমাত্র পুত্র।
পুত্রের এই ক্লেদাক্ত জীবনযাত্রা তাঁকে ধাক্কা দেয়। নিজে সিদ্ধান্ত নেন তিনি কি করবেন। তখন আমার অন্নপ্রাশন শেষ হয়েছে। ঠাকুরদা আমার নাম রাখতে চেয়েছিলেন সুমন। মা অনুরোধ করেন এই প্রথম যে তিনি সুশোভন দত্ত মজুমদারের পুত্রের নাম সুমন রাখতে চান না। ঠাকুরদা যদি অনুমতি দেন তবে তিনি নাম দেবেন অমলকান্তি। যে অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতায়। মা তাঁর ছেলেকে সেই রোদ্দুর হওয়ার কামনা করেছিলেন।
ঠাকুরদা তাঁর বন্ধু বিখ্যাত উকিল পূর্ণশশী সান্যালকে দিয়ে উইল করেন। এটাই তাঁর মাস্টার স্ট্রোক। নিজের সন্তানকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। সমস্ত সম্পত্তি মা আর ঠাকুমার নামে ভাগ করে দেন সমানভাবে। হেতমপুরে দেশের জমিজমাও মা-ঠাকুমার নামে রেজিস্ট্রি হয়। বিবেকানন্দ রোডের পৈত্রিক বাড়িতেও মা-ঠাকুমার নাম। সময়টা শীতের আগ দিয়ে ঘটেছিল। বাবা এই সময়ে কোথাও উৎসবে মেতে ছিলেন। আমি তখন সবে হাঁটতে শিখেছি। এই সময়ে ঠাকুরদা নিশ্চুপে পরম আরামে ঘুমের মধ্যে তারাদের জগতে পাড়ি দেন।
শুনেছি আমার এক দূরসম্পর্কীয় কাকা যিনি ঠাকুরদার আশ্রয়ে মানুষ হয়েছিলেন তিনি মুখাগ্নি করেন। বাবা কোথায় গিয়েছেন কেউ জানে না, কাউকে তিনি বলেও যেতেন, না, আর তাঁকে তো ত্যাজ্য করা হয়েছে। এর বেশ কিছুদিন পরে বাবা বাড়ি ফিরলেন। ঠাকুমা দোতলা থেকে নেমে বললেন - "তুমি বাইরে বারান্দায় বসো। পূর্ণবাবুকে খবর দিচ্ছি"। বাবা তাঁর স্বভাব অনুযায়ী চিৎকার করতে গিয়েছিলেন; ঠাকুমা রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। পূর্ণবাবুর কাছে গিয়ে সব শুনতে বললেন। কাজের লোককে বললেন গেটে তালা দিতে। দাদাবাবুকে যেন ঢুকতে না দেওয়া হয়।
এই সবই শোনা কথা। আমার স্মৃতিতে এর কিছুই নেই। শোনা যায় বাবা মাকে ডিভোর্সের চিঠি পাঠিয়েছিলেন। মা বাবাকে নিজের জীবন থেকে বাদ দিতে বেশি চিন্তা করেননি। এতদিনে তাঁর গ্লানিময় জীবনের অধ্যায় শেষ হল। আমাকে নিয়ে ঠাকুমার ছত্রছায়ায় তিনি নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। পুরোনো বাড়ি বিক্রি করে বসন্ত রায় রোডে চলে এলেন ওঁরা আমাকে নিয়ে। মা আবার গান গাইতেন, ছবি আঁকতেন, বই পড়তেন, ঠাকুমার সাথে গল্প করতেন। আর এঁদের ভালবাসায়, সুশাসনে আমি অমলকান্তি দেবদারু গাছের মতো রোদ্দুরের দিকে মুখ করে বড়ো হতে চাইলাম।
ঠাকুরদা বা বাবা অথবা বিবেকানন্দ রোডের বাড়ির জন্য আমার কোনও স্মৃতি কাজ করে না। তবে ঠাকুরদাকে খুব শ্রদ্ধা করি। ঠাকুমা, মা আর মামা দাদামশায় আমাকে কখনও অভিভাবকহীন হতে দেননি। এখন জীবনের প্রায় শেষবেলায় ঠাকুমা নেই, দাদামশায় চলে গিয়েছেন। কিন্তু আমার সৌভাগ্য অমলকান্তিকে রোদ্দুর থেকে সরে না আসার জন্য মা আর মামা এখনও আছেন। বয়সের ভার তাঁদের নিরানন্দ করতে পারেনি। আর আমার চারপাশে রয়েছে অসংখ্য রৌদ্রকণা - স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ আর নাতি। সবাই আমরা রোদ্দুর হতে চাই।