ঠিক সকাল সাড়ে দশটায় অনুষ্ঠান শুরু হলো। উদ্বোধনী ভাষণে কলেজের অধ্যক্ষ মহাশয় সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করলেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস থেকে শুরু করে এখানকার কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের কথা তুলে ধরলেন। তারপর কলেজের মহান ঐতিহ্যের কথা বললেন, কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রাক লগ্ন থেকে কীভাবে ধীরে ধীরে একটা বিশেষ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ উপস্থিত সবার সামনে তুলে ধরলেন। আমরা অনেক অজানা ইতিহাস জেনে তৃপ্ত হলাম। একের পর এক অনুষ্ঠান চলতে থাকলো - নৃত্য, গীত, বাদ্যযন্ত্র, তবলা লহড়া, বাঁশি, গীটারের সুর মূর্ছনা শুনতে শুনতে অন্য এক জগতে পদার্পণ করলাম। ইতিমধ্যে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে এলো। ছাত্র সংসদের সদস্যরা এসে প্রত্যেকের হাতে একটা করে কুপন দিয়ে বললো - বাইরে কাউন্টার থেকে লাঞ্চ সংগ্রহ করে নিস। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেবশ্রী রায় এসে যাবেন। তার আগে আমাদের এই পর্ব শেষ করতেই হবে। দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠানে আছে দেবশ্রী রায়ের একটি বিশেষ মঞ্চ উপস্থাপনা এবং তারপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীরা রবিঠাকুরের চণ্ডালিকা মঞ্চস্থ করবে সবশেষে নাটক - মুসলমানীর গল্প। তারপর নবীন বরণ অনুষ্ঠান।
আমরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে লাঞ্চের প্যাকেট সংগ্রহ করলাম। তখন কিছু সময়ের বিরতি হঠাৎ দেখি সবাই একসাথে হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিয়েছে - কী না, দেবশ্রী রায় আসছেন। হলুদ রঙের শাড়ী পরা মেয়েগুলো রবীন্দ্র ভবনের মেইন গেট থেকে দুটি লাইন করে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রত্যেকের হাতে একটা করে পিতলের রেকাবি এবং তাতে চার-পাঁচ রকমের পাপড়ি খসানো ফুল, কারও হাতে চন্দনের বাটি, কারও হাতে সুগন্ধ ছড়ানোর পাত্র। একেবারে মূল ভবনের দরজা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো স্বর্গ থেকে কোনো দেবীর আগমন ঘটছে আর সবাই তাঁকে বরণ করার জন্য রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
সত্যিই তিনি স্বর্গের দেবী বটে! চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না - এত সুন্দরী মানবী হতে পারে! বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটতেই চাইছে না। আমি আজও ভুলতে পারিনি সেই অপরূপা অনন্যা দেবশ্রী রায়কে। তাঁর মুখের সেই পবিত্র হাসি, উজ্জ্বল দুটি চোখের মায়াবী দৃষ্টি এবং এক মনোমুগ্ধকর আকর্ষণ আজও আমার হৃদয় মন্দিরে কোনো এক মহান শিল্পীর আঁকা তুলিকায় জীবন্ত হয়ে আছে। তখন থেকেই সিনেমা দেখার প্রতি আমার আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল। প্রায় ঘণ্টাখানেক তিনি মঞ্চে ছিলেন, সেই একটি ঘণ্টা যে কীভাবে কেটেছিল বলতে পারি না। তারপর তিনি দর্শক আসনে বসে শেষ পর্যন্ত আমাদের নাটক দেখলেন। নাটক দেখা শেষ হলে তিনি মঞ্চে উঠে আমাদের সাথে করমর্দন করলেন আর আমাদের অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। কৃষ্ণনগরের মতো একটা মফস্বল শহরে এমন একটা প্রযোজনা দেখবেন তিনি ভাবতেই পারেননি। এটাই ছিলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো উপহার। তাঁর সেই অমলিন করস্পর্শ আজও অভিভূত করে আমায়। মাঝে একবার মনে হয়েছিল চিত্রজগতে চলে যাই। অভিনয়টা ভালো করে শেখা যাবে। মনের সঙ্গে অনেক লড়াই চালিয়ে শেষে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম যে, সব জায়গা সবার জন্য নয়। ওটা কারও কারও জন্য নির্দিষ্ট থাকে। দেবশ্রী রায় আমার মনে স্বপ্ন হয়েই বেঁচে থাকুন।
কলেজে তো আমাদের জয়-জয়কার, চারিদিক থেকে ছুটে আসছে অভিনন্দনের জোয়ার, কলেজের জি এস এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো - না রে জয়, তুইই ঠিক। আমি তোকে চিনতে ভুল করেছিলাম। রঘু এসে আমার চোখ খুলে দিয়েছে। তা নাহলে আরও একটা বড়ো ভুল হয়ে যেত। আমায় তুই ক্ষমা করিস ভাই।
- না না দাদা এভাবে বোলো না। ভুল মানুষ মাত্রই হয়। আর ভুল কীসের, তোমরা তো আমাকে জোরাজুরি করোনি। আমাকে সময় দিয়েছিলে। ওটা নিয়ে তুমি ভেবোনা দাদা, শুধু এইটুকু অনুরোধ করছি বিপদ-আপদে একটু পাশে থেকো।
- পাশে থাকবো মানে, আলবাত থাকবো।
মনে ভীষণ জোর পেলাম। বুঝলাম - ভালো কাজের সমাদর সবাই করেন। তাই তো এখনো পৃথিবীটা এত সুন্দর। চারিদিকে এতো অভাব অভিযোগ, এতো সমস্যা তবু কিছু সমঝদার মানুষও আছেন যাঁরা পৃথিবীটাকে একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখেন। মনটা এক অপরিসীম আনন্দে ভরে গেল।