গল্প ও অণুগল্প

মা



পল্লব রায়


"তোমাকে কতবার বলেছি না যে আমার কোনও জিনিস ছোঁবে না। আমার কোনো কিছুতেই তোমার হাত দেওয়া আমার একদম পছন্দ নয়।" বাসবীর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠে সমাদৃতা।

- না মানে তোর বই-খাতাগুলো সব এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, তাই আমি সব গুছিয়ে রাখছিলাম।

- থাক, আমার বই-খাতা, জিনিসপত্র যেভাবেই থাক না কেন তোমার তাতে হাত দেওয়ার কোনও দরকার নেই। আমার জিনিসে হাত দেওয়ার কোনও অধিকারই নেই তোমার।

- "কি বলছিস এসব, আমি যে তোর মা।" ব্যথিত কন্ঠে বলে ওঠে বাসবী।

- আমি মানি না, আমি মানিনা, তোমাকে মা বলে আমি মানি না। আগেও কোনদিন মানিনি, আর ভবিষ্যতেও মানবো না। আমার ঘরে তুমি কোনদিনও ঢুকবে না বলে দিলাম।" উত্তেজিত স্বরে সমাদৃতার জবাব।

মন খারাপ হয়ে যায় বাসবীর, মাথা নিচু করে ওখান থেকে সরে যায়। গত কয়েক বছর ধরে মা আর মেয়ের মধ্যে এরকম সম্পর্কই চলছে, বাসবী অনেকবার অনেকভাবে চেষ্টা করেছে সমাদৃতার মন জয় করার, কিন্ত প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। বাসবী যে সৎমা, তা সমাদৃতা প্রতিপদেই বুঝিয়ে দেয়, কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। এসব দেখে আজকাল আর রঞ্জনবাবুরও ভালো লাগে না। দুজনের সম্পর্ক দেখে আজকাল প্রতিপদেই মনে হয় যে, দ্বিতীয়বার বিয়ে করে উনি ভুল কাজই করেছেন, একমাত্র মেয়েটার প্রতি অন্যায়ই করেছেন।

সমাদৃতার যখন বছর ছয়েক বয়স তখন দীর্ঘ রোগভোগের পর রঞ্জনবাবুর স্ত্রীবিয়োগ হয়। মা হারা মেয়েটাকে উনি বুকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, ঠিক করেছিলেন যে আর কখনই বিয়ে না করে নিজেই মেয়েকে বড় করে তুলবেন। যদিও পারিপার্শ্বিক অনেক চাপ ছিল বিয়ে করার জন্য, তবুও ঐ ব্যাপারে উনি অনড় ছিলেন। কিন্তু যত দিন যেতে লাগলো, উনি বুঝতে পারলেন যে সবকিছু সামলে মেয়ের সঠিক দেখভাল করাটা একরকম অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু সৎমা এসে যদি তার আদরের মেয়েটাকে না দেখে, যত্ন না নেয় তখন কি করবেন? এই একটি চিন্তার জন্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বেশ কিছুদিন দেরী হয়ে যায়। স্ত্রীর বাৎসরিক শ্রাদ্ধেরও প্রায় বছর দুয়েক পরে যখন শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয়ের পরামর্শে দূর সম্পর্কের এক শালীকে বিবাহ করেন, তখন সমাদৃতার বয়স নয় ছুঁই ছুঁই। স্বভাবতই ঐ বয়সে সমাদৃতা তার নতুন মা মানে সৎমাকে নিজের মা হিসেবে মেনে নিতে পারেনি, পারেনি যেহেতু সে একসময় সম্পর্কে তার মাসি ছিল। আরও মানিয়ে নিতে পারেনি পারিপার্শ্বিক কিছু দুষ্টচক্রী প্রতিবেশী এবং তথাকথিত নিকট আত্মীয়দের কু-পরামর্শের জন্য। এই সকল গোপন পরামর্শদাতাদের কথায় ওর মনে ছোট থেকেই বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছিল যে, ওর মায়ের মৃত্যুর জন্যে এই মাসিই দায়ী। এই মাসির পরামর্শ মতো ওর বাবা ওর মা'র ঠিকমতো চিকিৎসা না করেই মা'কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। সেই কারণে সমাদৃতা বাসবীকে কোনদিনই মা বলে মানতে তো পারেইনি, মা বলে ডাকেওনি কোনদিন। দরকারে মাসি বলেই ডেকে এসেছে। বাসবী কিন্তু প্রথম থেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করে এসেছে সমাদৃতাকে আপন করে নেওয়ার, নিজের সমস্ত স্নেহ, মায়া, ভালোবাসা দিয়ে ওর মন জয় করে নেওয়ার। এমনকি রঞ্জনবাবুর সাথে আলোচনা করে নিজে সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্তও নেয়, যাতে ওর ভালোবাসার ভাগ না হয়, যাতে সমাদৃতার প্রতি ওর মনোসংযোগ নষ্ট না হয়। এতকিছু করেও এতদিনেও সমাদৃতার এক বিন্দুও মন পায়নি বাসবী। দিন যত এগিয়েছে তত দুজনের সম্পর্কের দূরত্ব আরও বেড়েছে।

বাসবী মন খারাপ করে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পর সমাদৃতা সব বই-খাতা গুছিয়ে রেখে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়। আজকে ওর মাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের দিন। সমাদৃতা পড়াশোনায় বরাবরই ভালো, ওর মনে একটা জেদ কাজ করে, পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি পেয়ে সৎমার কবল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে ফর্ম ফিলাপের টাকা নিতে বাবার ঘরে ঢুকে বাবার টেবিলের ওপর রাখা ওর মায়ের ধুলো আর ঝুল মাখা ছবিটা দেখে বেশ অবাকই হয় ও। মা মারা যাওয়ার পর ছবিটা এই টেবিলের ওপরেই থাকত, বাবা খুব যত্ন করে মাঝে মধ্যেই ছবিটা মুছে মালা পরিয়ে দিতেন। কিন্তু মাসিকে বিয়ে করার পর কিভাবে যেন একদিন ছবিটা উধাও হয়ে যায়, তন্নতন্ন করে খুঁজেও সমাদৃতা তার সন্ধান পায়না। এসব ভাবতে ভাবতে সমাদৃতার চোখের কোণে জল চলে আসে, আলতো করে অশেষ মমতায় মায়ের ছবিতে হাত বুলিয়ে মায়ের স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করে। মা'র ফটোকে এতদিন সরিয়ে রেখেছিল, সেটা ও ভালো মতনই বুঝতে পারে। ও নিশ্চিত যে এটা ওর মাসিরই কাজ, কিন্তু ও জানেনা যে, বাসবীর শত আপত্তি সত্ত্বেও রঞ্জনবাবু ওটা সরিয়ে রেখেছিলেন। আজ এতদিন পর ছবিটা কেন বের করা হয়েছে তা ওর বোধগম্য হয়না। টেবিলের ওপর স্কুলে জমা দেওয়ার টাকাটা দেখে সমাদৃতা বুঝতে পারে বাবা ওর জন্যে রেখে কোথাও গেছেন। স্কুল থেকে ফিরে মা'র ছবিটা ঠিক করে পরিষ্কার করে আবার সাজিয়ে রাখবে, এটা মনে মনে চিন্তা করে স্নান করতে যায় ও।

রান্নাঘরের পাশ দিয়ে বাথরুমে যাওয়ার সময় রান্নাঘরের থেকে নানান ধরনের রান্নার সুবাস পেয়ে লক্ষ্য করে যে বাসবী একমনে নানান পদ রান্না করছে। ওকে দেখতে পেয়ে,

- "স্কুলে ফর্ম ফিলাপের পর তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস, আজকে বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে।" একগাল হেসে বাসবী বলে ওঠে।

বাসবীর মুখে হাসি দেখে সমাদৃতার গা জ্বলে ওঠে,

- "আজকে আবার কিসের অনুষ্ঠান?" মুখ ঝামটা দিয়ে বলে ওঠে সমাদৃতা।

- "আয় না, এলেই জানতে পারবে, আর তোকে ছাড়া যে এই অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হবে না।" আবারও হাসিমুখেই জবাব দেয় বাসবী।

মাসির মুখের এই হাসিটাই সহ্য হয়না সমাদৃতার। অনেক বাজে ব্যবহার করেছে মাসির সাথে, কিন্তু মাসির মুখের ঐ হাসিটা ও মুছতে পারেনি। স্নান করতে করতে ওর মনে পড়ে যায় যে আজকে মাসি আর বাবার বিবাহবার্ষিকী এবং সেইজন্যেই এত রান্নার আয়োজন। মনে মনে ও ঠিকই করে নেয় যে আজকে দেরী করে ঘরে ফিরে মাসিকে শায়েস্তা করবে - করাচ্ছি বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠান। তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে সমাদৃতা।

স্কুলে গিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ করতে দুপুর প্রায় একটা বেজে যায়। বান্ধবীরা এরপর যে যার মতন বাড়িতে ফিরে গেলে সমাদৃতা একা হয়ে যায়, এদিকে বেশ খিদেও পেয়ে গেছে, তাই খানিকটা বাধ্য হয়েই বাড়িতে ফিরে আসে। বাড়িতে ফিরে বসার ঘরে ঢুকে যা দেখে তাতে বিস্মিত না হয়ে পারেনা সমাদৃতা। ওর মায়ের ছবিটি পরিষ্কার করে, সুন্দর করে চন্দন দিয়ে সাজিয়ে, তাতে মালা পড়িয়ে তার সামনে একমনে বসে আছে ওর মাসি বাসবী। মা'র ছবির সামনে সাজানো মা'র সব পছন্দের খাবার, যা আজ সারা সকাল ধরে বাসবী রান্না করেছে। অপার বিস্ময় নিয়ে ধীর পায়ে ঐ দিকে এগিয়ে যায় সমাদৃতা। বাসবী যেন ওর অপেক্ষাতেই ছিল। সমাদৃতার পায়ের আওয়াজে ওর দিকে তাকায় বাসবী,

- জামা কাপড় পাল্টে হাত পা ধুয়ে তোর মায়ের সামনে এসে বোস। আজ সকাল থেকে দিদির পছন্দের সব পদ রান্না করেছি। তুই এসে নিজের হাতে তোর মা'কে ওগুলো নিবেদন কর।

অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মাসির দিকে তাকিয়ে থাকে সমাদৃতা, আজকে ওর মা'র কি তা কিছুতেই মনে করতে পারেনা।

- "আজকে কি দিন...?" অস্ফুট স্বরে বাসবীকে জিজ্ঞাসা করে ও।

- "তোর মনে নেই? আজকে যে দিদির দশম প্রয়াণবার্ষিকী, সেইজন্যেই তো দিদির পছন্দের সব খাবার রান্না করেছি।"

এতদিন ধরে মাসিকে ঘৃণা করে, তাকে মা বলে অস্বীকার করতে করতে নিজের মায়ের মৃত্যুদিনটাই ভুলে গেছে সমাদৃতা। এই দিনটাকে মনে রেখেছে শুধু তার সৎমার বিয়ের দিন হিসাবে।

- কি হলো? তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে আয়। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল এইদিনে দিদিকে স্মরণ করার, কিন্তু এতবছর তা হয়ে ওঠেনি। গত মাসে যখন তোর বাবার ট্রাঙ্ক থেকে দিদির এই ছবিটা খুঁজে পাই, তখনই ঠিক করি যে এবার থেকে প্রতি বছর এই দিনটা পালন করবো।

আর কিছু ভাবতে পারেনা সমাদৃতা, যে মাসিকে মায়ের মৃত্যুর কারণ ভেবে এতদিন ধরে ও ঘৃণা করে এসেছে, যে মাসি ওকে এত ভালোবাসা সত্ত্বেও তাকে মা হিসাবে অস্বীকার করে এসেছে, আজ সেই মাসিই ওর মায়ের মৃত্যুদিনটি মনে রেখে তাঁর দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চলেছে ওর হাত দিয়েই। অথচ ও নিজেই সব ভুলে বসে আছে। আত্মগ্লানি আর অপরাধবোধে মাথা নত হয়ে যায় সমাদৃতার। মায়ের ফটোর দিকে এগোতে চেয়েও এগোতে পারেনা ও। চুপ করে নতমস্তকে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে। দু-চোখ যা দিয়ে এতদিন আগুন ঝরতো মাসির প্রতি, সেই দুটোও যেন আজ অবাধ্যতা করছে ওর সাথে।

- কি হলো সমাদৃতা? দাঁড়িয়ে রইলি কেন? তাড়াতাড়ি এসে মা'কে খেতে দে।

এক ছুটে ঐদিকে গিয়ে বাসবীর কোলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সমাদৃতা। বাসবীকে 'মা' সম্বোধনে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে,

- আমাকে ক্ষমা করে দিও মা।

এতবছর পরে সমাদৃতার মুখে 'মা' ডাক শুনে বাসবীর আবেগ ও আর বাঁধ মানে না। দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। রঞ্জনবাবু পাশের ঘরেই ছিলেন, দুজনের গলার আওয়াজ শুনে দৌড়ে এ ঘরের দরজার সামনে এসে মা আর মেয়ের মিলনান্তক দৃশ্যের সাক্ষী হন। আজকের এই অভাবনীয় ঘটনায় রঞ্জনেরও আবেগের বাঁধ ভেঙে পড়ে, মনে মনে শুধু একটা কথাই ভাবেন - যাক, তাহলে আমি কোনও ভুল করিনি, মেয়েটার প্রতি কোনও অন্যায় করিনি।