সিঁড়ি দিয়ে তড়িঘড়ি নীচে নেমে এলো মৌসুমী। সময় ঘাড়ের কাছে যেন নিঃশ্বাস ফেলছে। সেই ভোর পাঁচটা থেকে কখন কীভাবে যে টিকটিক করতে করতে ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁয়ে ফেলে তা বোঝার অবকাশটুকু নেই। ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে স্কুলের জন্য রেডি করা, টিফিন বানানো, শ্বশুরমশাইয়ের গুনে গুনে পাঁচটা নিয়মিত সময়মাফিক সকালের ওষুধ দেওয়া, রান্না, স্নান, পুজো, বুদ্ধর অফিসের যাবতীয় হাতের কাছে গুছিয়ে দেওয়া... যেন রোবটের মতো মৌসুমীকে অনর্গল কাজ করে যেতে হয়। একটা শেষ হতে না হতেই আরেকটি শিডিউলে হাজির। মাঝে মাঝে ও ঠাট্টা করে বুদ্ধকে বলেই বসে, 'যদি স্যাটেলাইট থেকে জুম করে আমার সকালবেলাটার ভিডিও তোলা যেত তাহলে মনে হতো কোনও ফাস্ট ফরোয়ার্ড মুভি চলছে।' বলে নিজেই ফিক করে হেসে ফেলে। কার কাছে অভিযোগ করবে! এরা সবাই তো সবটা জানে! অভিযোগ শুনেও মাথা নিচু করে একরাশ মনখারাপ নিয়ে আবার সেই মৌসুমীর দিকেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। কখন দুটো রান্না করে খেতে দেবে বা কখন হাতের ওপর ওষুধ এনে দেবে বা কখন অফিসের জামা প্যান্ট ইস্তিরি করে বাড়িয়ে দেবে... আসলে মৌসুমী ছাড়া এ সংসারের চাকা অচল। শাশুড়ি মারা যাওয়ার পরে ও হলো একমাত্র যোগসূত্র। মালার সুতো। সুন্দরভাবে সব ফুলগুলোকে গেঁথে রেখেছে।
এগারোটা পঁচিশের বাসটা ধরতে না পারলে ছেলেকে আনতে স্কুলে পৌঁছনো খুব মুশকিল হয়ে যায়। দশ মিনিট পরেও আরেকটা বাস আছে বটে, কিন্তু তাতে বাদুড়ঝোলা ভিড় হয়। ওদিকে বাস থেকে নেমেও প্রায় ছুটতে হয়। এত ঝক্কি পোহানোর থেকে ভালো দশমিনিট আগে বাড়ির কাজটুকু তাড়াতাড়ি সেরে আগেই বেরোনো। মৌসুমী লিফ্ট থেকে বেরিয়ে গেটের কাছে আসতেই নজর গেল সিকুইরিটি গার্ড সন্তোষের ছোট্ট মেয়েটার দিকে। বছর সাতেক বয়স হবে। লেটার বক্সের নীচে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। হাতের চক দিয়ে মেঝেতে হিজিবিজি কাটছিল এতক্ষণ। হাসিটা যেন দীঘিতে ফোটা একগুচ্ছ শাপলা। চাপা গায়ের রঙ আর মাথা ভর্তি ম্যাগির মতো কোঁকড়া চুল। চুলগুলো অগোছালো করে কোনওমতে পেছনে গার্ডারে বাঁধা। দেখলেই বোঝা যায় যে মায়ের সময় হয়নি। কয়েকটি দড়ি সেই ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে কপাল বেয়ে গালে এসে পড়েছে। খালি গা। লাল হাফ প্যান্ট পরা। মৌসুমীর বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠলো। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলো, নাঃ, ওর মা আশেপাশে তো নেই! 'মেয়েটাকে এভাবে একা এখানে রেখে কোথায় গেল!'
- মা কোথায় তুলতুলি?
- ওই বাড়িতে গেছে। শেফালির মা ওর জন্য পূজার নতুন জামা কিনেছে। ওটা দেখতে গেছে।
মৌসুমী বুঝলো আবাসনের উল্টোদিকের বাড়িতে ওর মা আছে। রাস্তার দুই দিকের দূরত্ব পাঁচ-ছ’ হাত। হয়তো ওখান থেকেই লক্ষ্য রেখেছে মেয়েকে। তবুও ওর সংশয় যেন যাচ্ছে না।
- তুই একা বসে থাকবি? বাবা কই?
- বাবা তো পেছনে গাছে জল দিচ্ছে।
- এবার কী করি! আমার তো দেরি হয়ে যাচ্ছে।
- তুমি দাদাকে আনতে যাচ্ছ?
- হম্ম।
- আমরা ক'দিন পরেই দাদুবাড়ি যাব। ইস্কুল ছুটি হয়ে যাবে তো! ওখানে পৌলমীর সাথে খেলতে আমার খুব ভালো লাগে জানো! পৌলমীর একটা ছোট্ট বনু আছে। এইটুকু! আমার কোলে শুয়ে ঘুমোয়। ওকে দেখতে পাব।
মৌসুমীর চোখটা বারবার তুলতুলির শরীরটা বুলিয়ে নিচ্ছে। এই বয়সে লিঙ্গের ভেদাভেদ বোঝা না গেলেও, লালিত্য আর নমনীয়তা প্রমাণ করে দেয় ও মেয়ে। দিশা না পেয়ে ও তুলতুলির দিকে এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললো, 'ঘর থেকে চট করে একটা জামা নিয়ে আয় তো সোনা। বাইরে যা আছে সেটাই।' তুলতুলি দৌঁড়ে গেল আর এলো। হাতে রঙিন ফ্রক। সেটা ওকে পরিয়ে মৌসুমী আবার ফিসফিস করে বললো, 'এবার মায়ের কাছে যা। মা কিছু বললে বলবি ওপরের আন্টি বলেছে তোমার সাথে থাকতে। একা থাকতে না করেছে। আমি বিকেলে মায়ের সাথে কথা বলে নেব। খালি গায়ে ঘর থেকে বেরোবি না একদম।' বলে ওকে হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে তবে নিজে বাসস্টপের দিকে এগোল মৌসুমী। 'আজকে পরের বাসেই না হয় যাব। তবু নিশ্চিন্ত হলাম।' নিজের ছেলেটি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। আজকাল খবরের কাগজ দেখলে মৌসুমী শিউরে ওঠে। শ্বশুরমশাইকে দ্বিধাভরে বলেই ফেলে, 'বাবা, মনাইকে ঠিক করে বড় করতে পারব তো! ছেলে তো! আরও ভয় লাগে!'... শ্বশুরমশাই আশ্বাসের হাত বুলিয়ে দেন বৌমার মাথায়, 'আরে, এত ভাবিস না! বাড়ির শিক্ষা, বাবা মায়ের প্রভাব এগুলোর কি কোনও মূল্য নেই! তাহলে তো পৃথিবী কবেই রসাতলে যেত! আমার নাতি মানুষের মতো মানুষ হবে। তুই নিশ্চিন্তে কাজ কর গিয়ে...'
আজ আর বাসস্টপে দাঁড়ানোর এক মুহূর্ত সময় পায়নি মৌসুমী। রাস্তার মোড়ে পৌঁছতেই এগারোটা পঁচিশের বাস হাজির। তারও আজ পাঁচ মিনিট লেট হয়েছে। টুক করে উঠে পড়ল মৌসুমী। মনে মনে বলে নিল 'এবার থেকে সব ভালো হবে।'