রুনুর বিয়েটা কোন রকমেই দেয়া যাচ্ছে না। পাত্রপক্ষ সামনাসামনি না-পছন্দের কথাটা বলে না। তারা বলে, বাসায় যেয়ে সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দেবে। রুনুর বাবা-মা ফোনের অপেক্ষায় থাকে। না, ফোন আসে না। মন খারাপ করা সিদ্ধান্ত কেউ জানাতে চায় না, নিরব থাকে। নিরবতা সম্মতি না, অসম্মতির লক্ষ্মণ - রুনুর বেলায় এটাই প্রমানিত।
রুনুর ছোট বোন ঝুনু। রুনুর বিয়ের এই বিলম্বিত অবস্থা ঝুনুর বিয়ের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঝুনু কলেজে যায় - আসে। পথে কেউ কেউ দ্যাখে, বলে, বা! মেয়েটা দেখতে ভালো তো! বাড়িতে ঝুনুর বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। বড় বোনের বিয়ে হয়নি বলে ঝুনুর বিয়ের প্রস্তাব না করে দিতে হয়।
পাছে বিয়ের বাজারে ঝুনুর মূল্য কমে যায় - এই ভয়ে ঝুনুর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় পিতা রমজান আলি।
এক সুদর্শন যুবক ঝুনুকে দেখতে এসেছে। তিনি ঝুমুকে প্রশ্ন করেন - আপনারা কয় বোন?
- আমারে 'আপনি' কইবেন না। আমি আপনার অনেক ছোট।
- তোমরা কয় বোন?
- দুই বোন।
- তুমি কি বড়?
- না, আমি ছোট।
- বড় বোনের জামাই কী করে?
- বড় বোনের বিয়ে হয়নি।
- বলো কী!
- সত্যি বলছি। এতে বিস্মিত হবার কী আছে?
ঝুনু যথার্থই বলেছে, জগতে বিস্মিত হওয়ার ঢের জিনিস আছে। এ আর এমন কী?
মাহমুদ ঝুনুকে বলে, না আমি মোটেই বিস্মিত না।
ঝুনু সুন্দরী। মাহমুদের সাথে তার জোড়া মিলতো চমৎকার। কিন্তু ঝুনুর মুখনিঃসৃত বাক্যে কোন রাখঢাক নেই। বিবাহযোগ্যা কন্যার কথা মধুর হলে ভালো হয় - ঝুনুর কথায় মধু কম।
মেয়ের কথায় বিব্রত হলেন বাবা রমজান আলি। তিনি বললেন, না, বড় মেয়েটার বিয়ে হয়নি মানে - মেয়েটা নিজেই বিয়ে করতে চাইছে না।
মাহমুদ সাহেব ঝুনুকে বললেন, তোমার বড় বোন কি বাসায় আছে?
- জ্বি।
রুনু এগিয়ে এসে নিজেই বললেন, জ্বি, এই আমি রুনু - ওর বড় বোন।
- আপনি বুঝি বিয়ে করতে চাইছেন না?
- না, না, কেন চাইবো না? আমি তো কখনও বলিনি অমন কথা।
মাহমুদ দুলাল রুনুর চেহারার দিকে এক নজর তাকালেন। রুনু শ্যামল বর্ণের একহারা গড়নের মেয়ে। তার রূপ নজর কাড়বার মতো না। মাহমুদ আর প্রশ্ন না করে এড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। রুনুর কণ্ঠস্বরে একটা মাধুর্য আছে। রুনুর কথা মাহমুদ শুনতে চায়। সে প্রশ্ন করে চলেছেন - আপনি লেখাপড়া কতদূর করেছেন?
- বাংলা সাহিত্যে স্নাতক।
- কবিতা ভালোবাসেন?
- জ্বি।
- শোনাবেন কোন কবিতা?
- জ্বি। রুনু আবৃত্তি করে চলেছে -
তোমার চোখ বলছে তুমি কবি
তোমার হাসি বলছে তুমি শিল্পী
তোমার মুখশ্রী বলছে তুমি প্রেমিক -
তোমাকে ভালো না বেসে পারা যায়?
দারুন কণ্ঠ। কবিতার কথাগুলো ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উথাল-পাথাল ঢেউ তোলে মাহমুদের মনে।
মাহমুদ দুলাল দ্বিধায় পড়ে যায়। মেয়েটার চেয়ারা তাকে টানছে না, তার কন্ঠস্বর টানছে। চেহারায় ব্যক্তিত্বের ছাপ মেয়েটির - যেন এক মহিয়সী নারী! এমন একজন নারীকে জীবন সঙ্গী নির্বাচন মন্দ না। ঝুনুর চেহারা সুন্দর, কন্ঠ সুন্দর না। কথা বলার আর্ট নেই ঝুনুর, রুনুর আছে। তবুও রূপে কে না মুগ্ধ? মাহমুদ দুলাল ঝুনুর রূপে মুগ্ধ। তার মনে হলো, আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারি - ঝুনুর ব্যাপারেই রাজি হয়ে পড়ি।
পরক্ষণেই মনে হলো রূপ অস্থায়ী, এই আছে, এই নেই। গুণের মহিমা মরণের পূর্ব পর্যন্ত - রুনুকেই পছন্দের কথা জানিয়ে যাই।
রুনুর বাবা পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। মাহমুদ চোখ তুলে তাকালেন রুনুর বাবার দিকে। বললেন, বড় মেয়ের বিয়ে না দিয়ে ছোট মেয়ের বিয়ে দিতে যাচ্ছেন কেন?
- না, বড় মেয়ের বিয়ে দিতে তো আমাদের কোন আপত্তি নেই। ও রাজি হলে...
- আচ্ছা,আমি কি রুনুর সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে পারি?
- কেন নয়?
তিন কক্ষবিশিষ্ট বাসা। গেষ্ট রুমে দুজন সামনা-সামনি বসেছে। জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখা যায়। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। দোয়েল, টুনটুনি লেবু গাছের শাখায় ইতি-উতি উড়ছে। অন্য সময় এমন দৃশ্যের দিকে চেয়ে থাকে রুনু। কখনও চলমান মেঘের দিকে চেয়ে গেয়ে ওঠে - 'মন মোর মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলে দিগ্ দিগন্তের পানে...। আজ পাশে একজন সঙ্গী। মেঘ, পাখি আর আকাশ আজ তার কাছে গৌণ।
প্রথমে রুনুই মুখ খুললেন। বললেন, জ্বি, কিছু বলুন।
- কী বলবো?
- আমাকে কি আপনার চোখে ধরেছে?
- না।
- চোখে ধরেনি তো একান্তে বসলেন কেন?
- মনে ধরেছে বলে।
- তাই বুঝি? তা, আর একবার দ্যাখেন ধরে কি চোখে।
মাহমুদ রুনুকে দেখছে। মুগ্ধ হতে পারছে না। তার চোখ রুনুর মধ্যে আহামরি সৌন্দর্য খুঁজে পাচ্ছে না। রুনু বিষয়টা বুঝতে পেরেছে। সে মাহমুদকে বলে, দেখুন, আমি সুন্দরী না, পুরুষের চোখ আমাকে পছন্দ না। আপনার চোখ পুরুষের চোখ - পছন্দ করবে কেন? তবে হ্যাঁ, পছন্দ করলে ঠকবেন বলেও মনে হয় না।
- মানে?
- রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী ধার করে তিনি গেয়ে উঠলেন - "আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব।"
মাহমুদ ভাবে, ভালোবাসাটা সব সময় রূপে বাধা থাকে না। জগতে কত পুরুষ আটকা পড়ে আছে নারীর রূপে না, নারীর ভালোবাসায়। সে সিদ্ধান্ত স্থির করে ফ্যালে রুনুকেই বিয়ে করবে।
মাহমুদ কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। রমজান সাহেবকে বলে, রুনুকে আমার পছন্দ হয়েছে।
এতদিন কোন ছেলে এভাবে বলেনি। কনে দেখে কৌশলে এড়িয়ে গেছে। বলেছে, সিদ্ধান্তটা পরে জানিয়ে দেবে। মাহমুদ সময় নিচ্ছে না। সাথে সাথেই সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। আর দেরি কেন? শুভ কাজে দেরি করতে নেই।
প্রকৃতিতে বসন্ত। কোকিলের ডাক ভেসে আসছে। কৃষ্ণচুড়ার শাখাগুলো ছেয়ে আছে ফুলে ফুলে। মাহমুদ বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয় পরিবেষ্টিত হয়ে এসেছে রুনুকে বিয়ে করতে। রমজান আলি দম্পতির মনে আনন্দ। বেশ ধুম-ধামে উৎসব চলছে বাড়িতে।
আড়াল থেকে মাহমুদকে দেখছে ঝুনু। বোনের বিয়েতে তার মনে আনন্দ আসার কথা। কিন্তু তার মনে আনন্দ নেই। একটা তীর এসে বিঁধছে তার বুকে। তার কেবলই মনে হচ্ছে - কী হতে কী হয়ে গেল!
জামসেদপুর নিবাসী মরহুম ওসমান মিয়ার ছেলে মাহমুদ দুলালের সাথে রুনুর বিয়ে হয়ে গেল। একটা লাল শাড়ি পরে নববধূ রুনু বাবার বাড়ি থেকে চলে এলেন শ্বশুর বাড়ি। বিয়ের দিন অসুন্দর মেয়েদেরও বড়ই সুন্দর দেখায়। রুনুকে দেখতে বেশ লাগছে। প্রতিবেশী দর্শনার্থীরা বলছে, বউ দেখতে ভালোই হয়েছে। ব্যতিক্রম এক মধ্যবয়সী বিধবা। বিধবারা অন্যের দাম্পত্য সুখে সৌন্দর্য খুঁজে পায় না। সে পাঁচজন মহিলার মধ্যে একটা তীর্যক মন্তব্য করে বসলো। পাড়ার মেয়েদের মাঝে সে বলে ফেললো, মেকআপ করে আছে বলে সুন্দর লাগছে; দু'দিন বাদে আসল চেহারা বেরিয়ে আসবে।
রুনু জানে তার রূপের কদর কম। রূপের ইন্টারভিউ দিতে যেয়ে সে ফেল করেছে বারবার। সে রূপে মাহমুদকে ভোলাতে পারবে না। সে ভালোবাসায় স্বামীর মন পেতে চায়। বাসর রাতেই রুনু এই প্রাকটিস শুরু করে দিল। স্বামীর হাতে হাত রেখে উচ্চারণ করলো - "আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ..."
বউয়ের এই উচ্চারণ তার ভালো লাগে। একটা নারীর প্রাণ ভালোবাসায় লেপটে থাকবে তার সাথে - এ কথা ভাবতেই সে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। মুগ্ধ নয়নে বউয়ের দিকে চেয়ে থাকে মাহমুদ।
মাহমুদ এই প্রথম শ্বশুরবাড়ি এসেছে। ঝুনুর কথা তার মনে পড়ছে। ঝুনু তার ছোট শালিকা। ছোট শালিকারা বড়ই সুমধুর হয়।
ঝুনুকে একঝলক দেখা গেল। হাতে বই-খাতা। ঝুনু কি কলেজে যাবে?
- এই যে ঝুনু, তোমাকে দেখছি না যে।
- কথা নেই আপনার সাথে। কথা কওয়ার মানুষ পাইছেন - তার সাথে কথা কন। আমার দেরি হয়ে গেছে বলতে বলতে ঝুনু হনহন করে বেরিয়ে গেল।
এই ঝুনু, তোর দুলাভাই ডাকে, রুনু পিছে তেড়ে এসে বলে। ঝুনু অন্যদিন এত ব্যস্ত থাকে না। আজ তার কথা বলবার সময় নেই। আমার একটু তাড়া আছে, আপা - বলতে বলতে সে দ্রুত এগিয়ে যায় কলেজের পথে।
মাহমুদ দুলাল শ্বশুর রমজান আলির প্রিয় জামাতা। রুনুর প্রিয় স্বামী, প্রিয় মানুষ। বাবা মেয়ে দুজনের জীবনেই সে স্বস্তির নিঃশ্বাস বয়ে এনেছে। তারা কৃতজ্ঞ এই উদার মনের মানুষটার কাছে। রমজান পরিবারের একজন সদস্য কেবল কৃতজ্ঞ না। দুলাভাইয়ের সাথে তার কথা রসকষহীন।
সে কলেজ থেকে ফিরে এসে বলে, দুলাভাই, আপনি মানুষটা...
- কেমন?
- বিচিত্র। তা না হলে...
মাহমুদ দুলাল নিজেকে প্রশ্ন করে শুধু সেই কি বিচিত্র, না পুরো জগৎ-সংসারটাই বিচিত্র? এ সংসারে রূপ-গুণ একদেহে বাসা বাঁধে না। একটা পেতে আরেকটা ছাড়তে হয়। যাকে ছাড়তে হয় তার জন্য বেদনা হয় - ঝুনুর জন্য একটা বেদনা আছে মাহমুদের মনে।