পাতলা মেঘের চাদরে আকাশটা ঢাকা। সূর্যের মুখ কখন দেখা যাবে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। বাতাসও থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। আলস্যে মোড়া সকাল। সতীর ভাঙাচোরা মনটা দুমড়ে মুচড়ে উঠল। আজই কী শেষ দিন? হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শাখা-পলা-নোয়াটা দেখে নিল। মাথাটা উঁচু করে ড্রেসি়ং টেবিলে মুখটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সময় নিয়ে। সিঁথিতে জ্বলজ্বলে সিন্দুরের চওড়া রেখা, কপালের ফোঁটাটা কালচে মনে হচ্ছে?
"দূর তা হবে কেন?"
কাকভোরে কাকের কা-কা রব কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। তাতে সতীর মনে কু-ডাক আরও জাঁকিয়ে বসল। কতক্ষণ আর এভাবে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা যায়। বিছানা থেকে টেনে তুলল শরীরটা। কঞ্চির লাঠি দিয়ে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল কাক।
তাড়া খেয়ে উড়ে যেতেই দু-চারটে শুষ্ক শিউলি ফুল তুলসিতলায় ঝরে পড়ল। পাপড়িগুলো কুঁকড়ে ছোটো হয়ে গেছে। হেমন্তের হিম বিদায়বেলায় শিউলির মুখে হাসি ফোটায়। শিশির মাখা শিউলি, যেন মুক্ত বসানো পাপড়ি! নাহ... এবার এখনও কার্তিকের হিম পড়া শুরু হয়নি। সামনের সোমবারেই কার্তিক পুজো। ঋতু অনুয়ায়ী প্রকৃতি তেমন করে আর সাজে না। আসা-যাওয়াটা ভালো করে বোঝাও যায় না। খেয়াল-খুশি মতো আসা-যাওয়া। প্রকৃতির আর দোষ কী? কড়ায়-গণ্ডায় উসুল করে নিচ্ছে। বর্ষা, শরতের উপর ছড়ি ঘোরায়। হেমন্ত ঠিকমতো আসে না। খেজুর রস আর নলেন গুড়ের সুবাসও, বাতাসে ভাসে না, হেমন্তে।
সতীর মেয়েবেলায় শীত এসে যেত আশ্বিনের শেষে। দুগ্গা ঠাকুর দেখতে যেত ওরা খদ্দরের চাদর গায়ে দিয়ে। সেই যে আকালের বছর পুরোনো তুলোর জামা গায়ে মা দুগ্গাকে করজোড়ে নমস্কার ক'রে, ভালো 'বর' পাওয়ার প্রার্থনা জানিয়েছিল। আটে কাটে বিয়ে হবে না। ন'য়ে পুতুলের হাঁড়ি কাঁকলিতে করে শ্বশুরবাড়ি এল। ভালো বরই পেয়েছিল সতী। সকলে বলল, এ গোপাল পুজোর ফল।
বিয়ের পর তিনমাস বাবার বাড়িতেই ছিল। শ্বশুরবাড়ি এল আশ্বিনের সোনাঝরা রোদ গায়ে মেখে। একহাত ঘোমটার নীচে অশ্রু সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে ক্ষুদ্র হৃদয়ের অধিকারিণী বুক। শাশুড়ি মা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে জামবাটিতে দুধ-ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিয়েছিল।
ভাবনায় ছেদ পড়ল। খেজুর রসের জাও লোকটি খেতে চেয়েছিল সতীর কাছে। জোগাড় করে উঠতে পারল না। চাল, বাজার থেকে ছেলে এনে দিয়েছে। সক্কাল সক্কাল রসের সন্ধানে বেরিয়েছিল সতী। পায়নি কোথাও। সবকিছু যেন ছেঁড়া ছেঁড়া। কোনোকিছুর সঙ্গে মিল করতে পারছে না। না চিন্তা-ভাবনার, না কাজের।
।। ২ ।।
শিউলিফুল লোকটির বড্ড প্রিয় ছিল। সতী সাজি ভরে কুড়িয়ে এনে বালিশের পাশে রেখে দিত। আধো জাগরণে শিউলির সুবাস প্রাণ ভরে নিয়ে আরও কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকতে ভালোবাসত লোকটি। এই সুবাসের চাবি তার জিয়নকাঠি। মনের মণিকোঠায় গচ্ছিত রাখা সে ধন। আলোমাখা লাল নীল স্বপ্নের মতো। সদ্য যুবকের মনে সেই সুখস্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল এক রাজকন্যে। রাজার কন্যে নয়, সে ছিল যুবকের মনোরাজ্যের রাজকন্যে। সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারেই রয়ে গেছে। ভুরভুরে সুবাস রয়ে গেছে। সংসারের গনগনে আঁচ পুড়িয়ে ছারখার করতে পারেনি। বাসর ঘরে সব কথা সতীকে বলেছিল। গোপন করেনি কোনো কিছু। বালিকা সতী হয়তো রাজকন্যের জায়গাটা নিতে পারেনি; কিন্তু শিউলির সৌরভের পরশ তো দিতে পারে? যেমন ভাবা, তেমন কাজ। শিউলিফুলের চারা এনে তুলসীতলায় লাগিয়ে দিল। বছর ঘুরতেই কুঁড়ি এল। ফুল ফুটল। প্রথম যেদিন ভোরবেলায় ফুল কুড়িয়ে বালিশের পাশে রেখেছিল, সেদিন সতী - স্বামীর মুখে যে খুশির আলো দেখেছিল - এমনটি আগে কখনও দেখেনি।
লোকটি ছিল এই সংসারের দীর্ঘ ছায়া। ছয়-ছয়টি প্রাণীর ছায়া হয়ে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়! এখন সেই ছায়া ছোটো হতে হতে বিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। কড়া তাতে ঝলসে যাচ্ছিল লোকটি। ছায়া চায়, ছায়া! শীতল ছায়া! ঝুর নামিয়েছিল অনেকগুলো। শেষবেলাটা ঝুরের ছায়ায় তো ভরসা জোগায়। ছায়া ছিল। প্রথমদিকের ছায়া - প্রাণ জুড়োনো। গর্বে বুকটা ফুলে উঠত। সেই ছায়া শুষে নিল নিষ্ঠুর সময়। ছায়া যেন ছায়া নয়। শুষ্ক! ছ্যাঁকা দিত মনে। কালব্যাধি! হাপরের মতো বুকের খাঁচা ওঠানামা করে। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির লোকটি কুঁকড়ে তিন ফুট হয়ে যায়। এক নাগাড়ে চেঁচাত, "আমাকে তোমরা ছাদে রেখে এসো। তোমাদের কারো কোনো দায় থাকবে না। ছাদ থেকে ঝাঁপ দিলে সব শেষ হয়ে যাবে। এভাবে কী পৃথিবীতে টিঁকে থাকা যায়? যায় না। আমার কথা কেউ শোনে না। আমার কষ্ট তোমরা কেউ বুঝতে চাও না। যদি বুঝতে, তাহলে আমার কাছে এসে বসতে, আমার কথার গুরুত্ব দিতে। ও ভাই অরু বরু - আয়। আমার পাশে এসে বোস। কত কষ্ট করে মানুষ করেছি। না - কেউ আসবে না।"
রাতদিন এক করে - চার দিন নাগাড়ে চেঁচিয়েছিল লোকটি। সতীর পেয়েছিল কালঘুম। কাছে বসে থাকে বটে, ঝিমুনি যায় না। চেঁচানোর চোটে গলার রগ ফুলে, চোখ কোটরে ঢুকে গেছিল। চামড়া মোড়া হাড়ের ফ্রেম। "খাট তো নয় যেন শরসজ্জা...", লোকটি বলে। শোনে সবাই গুরুত্ব দেয় না। বলা থামে না লোকটির।
"সতী বারান্দার চৌকিতে দাও আমাকে। এখানে আলো নেই। অন্ধকার। আলো চাই। আলো। অনেক আলো। যে আলো আমার যন্ত্রণার পাষাণকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। দূরে! বহূদূরে! আমি পাখির মতো হাল্কা হয়ে যাব। আমার নিঃশ্বাস নিতে কোনো কষ্ট থাকবে না। প্রতিটি কোষের যে অক্সিজেন দরকার সহজেই জোগান দেবে ফুসফুস। আ!... আমি বুক ভরে অক্সিজেন নেব। আমি বাঁচব! জীবন-মৃত্যুর মাঝে এইভাবে ঝুলে থাকা যায় না। হয় ভালোভাবে বাঁচি, নয়তো মৃত্যু আমাকে মুক্তি দিক এই যন্ত্রণা থেকে।"
দু'দিন পরে চৌকি ছেড়ে শ্বেতপাথর বিছানো মেঝেয়। সবার অলক্ষ্যে গড়িয়ে গড়িয়ে উঠোনে নামার সিঁড়ি গড়িয়ে এই ঝুলন্ত জীবনের ইতি টানবে। সেই ইতি টানার জন্য শক্তি চাই। শক্তি। গড়িয়ে যাবার শক্তি। বিধাতা সেখানেও মেরে রেখেছিল। এক গড়া দেওয়া ধকলের যন্ত্রণায় গগনবিদারী চিৎকারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল সবাই। হৃদয় নিংড়ানো 'মৃত্যুভিক্ষা'। কী করুণ! কী মর্মান্তিক! দম বন্ধ হয়ে আসছিল অন্যদের। তারাও লোকটির মৃত্যু বন্দনায় মেতে উঠল। এই দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে মুক্তি প্রার্থনায়। লোকটির বেঁচে থাকার প্রার্থনা বেমালুম ভুলে গেল সবাই। গর্ভধারিনী মা ভুলে গেল। স্ত্রী ভুলে গেল। সন্তানরা ভুলে গেল। ভাইয়েরা ভুলে গেল। ভুলে গেল পরিচিত নিকট বা দূর জনেরা, প্রতিবেশীরা।
ভুলে যাওয়ার পর দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে শিউলির সুবাস ছেড়ে গেল লোকটির। প্রাণপাখিটা বেরোনোর অপেক্ষা। শেষ দু'দিন ঘাপটি মেরে পড়েছিল। তোবড়ানো গালে নোনা জলের শুকনো ধারার ছাপ। আপনজনেরা চারপাশ ঘিরে থাকলেও তাদের উষ্ণতায় টান ধরেছে। যন্ত্রের মতো যার যেটুকু করা, করে গেছে। সতীও হাল ছেড়ে দিয়েছিল। মনকে বুঝ দিত - "আগের জম্মে নিশ্চয়ই পাপ করেছিল, তাই এই সাজা। না-হোলি এত কষ্ট পাবে ক্যান?"
সতীর মতো সকলের একই কথা, "ঠাকুর তুমি ওকে নাও।"
বাঁশির মতো নাক। অক্সিজেনের নল গোঁজা। একহারা চেহারা। পাতলা চাদর বুক পর্যন্ত টেনে দেওয়া। বছর ছয়েক আগে চলে যেতে যেতেও, যায়নি। সময় না-হলে নাকি যাওয়া যায় না। হবে হয়তো। নিজে এবং বাড়ির লোকরা ওষুধপত্রের বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকায় ছয় ছয়টা বছর জীবনমৃত্যুর মাঝে কাটিয়ে গেল। নিজের রোগের উপশম করতে না পারলেও অন্যের রোগ নিরাময়ের ওষুধ দিয়েছে। বিছানায় বসেই ওষুধপত্তর দিয়েছে। বউ সাথ দিয়েছে। সতী নিরক্ষর হলেও সূচ ফোটাতে পারত। যেদিন প্রথম শ্বাসকষ্ট চরম পর্যায়ে, সতী মনস্থির করে সূচ লাগিয়েছিল। রাজস্থানে স্যুই লাগানো বলে। যে অসুখই হোক না কেন গুলিয়ার থেকে সূচে বিশ্বাসী কোল-ভীলেরা। এমনকী বর্ণ হিন্দুরাও। তারা সূচে বিশ্বাসী। সূচ না দিলে সে ডাক্তারই নয়! সূচ দিলেই গুলিয়ার তিন-চার গুণ টাকা। টাকা আর টাকা। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে রোগীর সঙ্গে কথা বলতে হয়। সূচ ফোটানোর সময় পেটের সবকিছু তোলপাড় শুরু করে বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য। এ কষ্টটুকু সহ্য করতে হয়। সহ্য করতে হয় টাকার জন্য। পড়ে থাকতে হয় রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত গ্রামে। জলের কষ্ট, মনের কষ্ট নিয়ে। শুধু টাকার জন্য। পড়ে থাকতে হয় বিদ্যুতের আলো, শিক্ষার আলো - না পৌঁছানো গ্রামে। ঝাড়ফুঁক, ওঝা-বদ্যির থেকে একটু একটু বিশ্বাস জন্মাতো সূচ ফোটাতে পারা ডাক্তারের উপর; তাদের মধ্যে। সূচের উপর তাদের বড্ড আস্থা! বিদ্যের বিচার তারা করে না। যে ডাক্তারবাবু গেলেই সূচ দেয়, সেখানেই ভিড় জমায়।
এই যে সতী - সূচ ফোটাত, গুলিয়া দিত - কখনও কী কারও মনে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছ? জাগেনি। জাগার কথাও না। এ প্রশ্ন জাগার মতো জাগরণ কী তাদের ছিল? গৌরবর্ণা সাফ-সুতরো ডাক্তারনীর উপর তাদের অগাধ বিশ্বাস। কথায় বলে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। আর্ধেক রোগ সেরে যেত। ফর্সা ধবধবে হাতের ছোঁয়া! কথা বলতে বলতেই সূচ ফুটিয়ে দেয়; রুগী বুঝে ওঠার আগেই। হাত খুব ভালো, লাগে না একটুও। সতী সাক্ষরতা অভিযানের সময় নাম সইটা শিখেছিল। চর্চার অভাবে, সেটাও ভুলেছে। তাই বলে সূচ ফোটাতে অসুবিধা হয় না। সূচ ফোটাতে তো আর অক্ষর লাগে না, সাহস আর কৌশল জানা থাকলেই হল। জ্বরজ্বালা সর্দিকাশি পায়খানা বমির ওষুধ স্বামীর নির্দেশ মতো দিতে দিতেই শিখে নিয়েছে। সতী দেখে শিখেছে, শুনে শিখেছে। লোকটি শিখেছিল পড়ে।
মাস ছয়েক হাঁপের টান বড্ড বেড়েছিল। বুকের খাঁচা হাপরের মতো ওঠানামা করেছে। চোখ বড়ো বড়ো করে চেঁচাতে থাকে, মনে হয় এখনি প্রাণপাখি বুঝি ফুড়ুৎ হবে! সতী ঘাবড়ে যায় না। সিরিঞ্জে ওষুধ ভরে। বাঁশের মতো আকাটা মজ্জাহীন হাতে শিরা খুঁজে পেতে সময় নেয়। খুব সাবধানে সূচ ঢুকিয়ে দেয়। ওষুধটা ধীরে ধীরে পুস্ করে। ওষুধ শরীরে ছড়িয়ে পড়ার পর স্থির হয়ে যায়। কিছুদিন যাবৎ ওষুধ আর কোনো কাজ করছিল না। মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনে যাচ্ছিল সবাই।
সেই মেঘাচ্ছন্ন অলক্ষুণে কাক ডাকা সকালে লোকটা চলে গেল। রোদও সেদিন ঝিমুচ্ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে বিষণ্ণতার ছায়া দীর্ঘ হতে থাকে। পাড়া-প্রতিবেশী, আপনজনেরা বল্লে, "বাঁচল'। কী কষ্টই না পাচ্ছিল - চোখে দেখা যায় না।" কেউ বললে, "লোকটি ভারি ভালো মানুষ ছিল। কারো কোনো অনর্থ করেনি। সৎ পরামর্শ দিয়েছে। মনে সাহস জুগিয়েছে। তবুও কেন যে লোকটা এত কষ্ট ভোগ করলে!"
।। ৩ ।।
প্রাথমিকের বিদ্যেয় লোকটার নাটক নভেল রামায়ন মহাভারত ভাগবত কথামৃত সব পড়া। সৎচরিত্র, সদালাপী। নাটক নভেল পড়েছে বাবুদের বাড়িতে মাহিন্দার থাকার সময়। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম। রাত জেগে লণ্ঠনের আলোয় পড়েছে। তখন বিদ্যুতের ফুটফুটে আলো শহর ছেড়ে গ্রামের আঙিনায় পৌঁছয়নি। উৎসব-অনুষ্ঠানে বাবুর বাড়ির হ্যাজাকের আলো মস্তবড়ো উঠোন, ঘরদোর, লোকজন দিনের মতো দেখা যেত। হাওয়া দিতে দিতে ফট করে যেই আলো জ্বলে উঠত, নিমেষে অন্ধকার দৈত্য ভ্যানিস। তাদের সংসারের অভাব দৈত্যটাকে ভ্যানিশ করার কাজে সঁপে দিয়েছিল নিজেকে। হ্যাজাকের আলো জ্বালানোর দায়িত্বের মতোই। সবাই তো আর সবকিছু পারে না। দেশলাইয়ের একটা কাঠির ঠোকায় এত আলো! তার জীবনে কী এমন আলো জ্বলে উঠবে কোনোদিন?
মানুষের মনের মধ্যের নিকষ কালো গাঢ় অন্ধকার কীসে দূর হয়? বড়োবাবু, সেজোবাবু কত জানে। জ্ঞানের কথা বলে। বিদ্যান মানুষ কিনা। ওঁনাদের মতো জ্ঞানের কথা জানার, বলার ইচ্ছা হয়েছিল বলেই না রাত জেগে বই পড়ত। অন্যরা কটু কথা বললেও, ডাক্তারবাবুর প্রশ্রয় ছিল। শ'বিঘে জমি দেখাশোনা। রাখাল বাগাল কিষান জনমুনিষের তদারক করা। ফসল বোনা কাটা মাড়াই, এমনকী বিক্রি-বাট্টা তাকেই করতে হতো।
বালিকা মানু সবার অলক্ষ্যে লণ্ঠনে তেল ভরে রেখে গেছে। বালিকা মানু - কিশোরী মানু হয়ে ওঠার সময়ে বুঝে গেছিল লোকটি শিউলি ফুল বড্ডো ভালোবাসে। কোঁচড়ভরা শিশির মাখা শিউলি ফুল বালিশের পাশে রেখে যায়। দিনের শেষে শুকিয়ে আসা শিউলির সুবাসে তরুণ যুবকের নেশা ধরে। এ সুবাস জ্ঞান অর্জনের নেশা ধরায় আরও গাঢ়ভাবে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলা রবি ঠাকুরের কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করত, "মানুষ কীভাবে অবসর যাপন করে তাই দিয়ে তার প্রকৃত পরিচয়।"
পরিচয় পাল্টানোর নেশা কী অতই সহজ। সেও তো একরকমের সাধনা। চলে তা অন্তর্লোকে।
"পৃথিবীটা টিকে আছে শুধু বইতে সংশোধনের জন্য।" - মালার্মের উক্তিটি তার কাছে গুরুমন্ত্রই বটে!
দু'দিন চারদিন পরপর বই পাল্টে যায়। 'পড়া শেষ' - চিরকুট শেষ পাতায় রাখার পরদিনই। অদৃশ্য বন্ধন। বাল্য-প্রণয়ের টুকরো টুকরো স্মৃতি লোকটিকে উদাসী করে দিত। মনে মনে আওড়াত, "গরীবের ঘোড়া রোগ ভালো নয়।" ধনীর দুলালী! পরীর মতো চেহারা! স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা বৈ তো নয়! সেই রাজকন্যাকে হরণ করে নিয়ে গেল জাসু দস্যুরা। একসঙ্গে বিশটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ জ্বেলে বাড়ি ঘিরে ফেলেছিল। কোথাও একফোঁটা অন্ধকার ছিল না, যেখানে মানুকে লুকিয়ে রাখবে বড়োগিন্নিমা। বাড়ির জোয়ান পুরুষদের দড়ি দিয়ে শালের খুঁটির সঙ্গে পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলল। বেঁধে ফেলেছিল যুবক কিষাণকে। বড়োবাবু অনেক টাকা-পয়সা দিতে চেয়েছিল। পায়ে ধরে ভিক্ষে চেয়েছিল তাঁর মানু মা'কে। দলপতি অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে বলেছিল, মানু সুন্দরীকে তার চায়।
"পায়ে ধরে কোনো লাভ হবে না। বেশি চেঁচালে গলার নলি ফাঁক করে রেখে যাবে।"
দলপতি নির্দেশ দিল সহকারিণীকে, "মানু সুন্দরীকে ছেলেদের জামা-প্যাণ্ট পরিয়ে উঠোনে এনে দাঁড় করাও।"
তৎপরতার সঙ্গে হুকুম তালিম হল। মানুকে যখন উঠোনে এনে দাঁড় করানো হল, চেনার কোনো উপায় নেই। সদ্য কিশোর যেন!
মাথায় টুপি দিয়ে কুড়িজন চারপাশ ঘিরে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলল গ্রাম ছেড়ে মেঠো পথে। গ্রাম ও মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছে টর্চের আলোয়। প্রাণভয়ে গ্রামবাসীরা এক পাও এগিয়ে এল না। মেয়ে লুটেরাদের রুখে দেওয়ার হিম্মত কি কারও ছিল?
ডাক্তারবাড়িতে কান্নার রোল উঠল। কন্যাসন্তান লুট করে নিয়ে যাওয়ার পরিণতি কী ভয়ঙ্কর, সেই আশঙ্কার হাহাকারের শেলে যুবক কৃষাণের হৃদয় ফালাফালা হয়ে যেতে লাগল। শালের খুঁটিতে দড়া দিয়ে বাঁধা যুবক হয়ে উঠেছিল অতিমানব। ভর করেছিল আসুরিক শক্তি। সর্বশক্তি দিয়ে উপড়ে ফেলল শালের খুঁটি। সমস্ত বাঁধন খুলে ফেলে কোমরে কষে গামছা বেঁধে কাজিয়া লাঠি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তিন গ্রাম পেরিয়ে ধরে ফেলল দলকে। ভোরের আজানের সময়। শুরু হল লড়াই। মরণ-বাঁচনের লড়াই, যদিও দলের অনেকেই নিষ্ক্রিয় ছিল। নতুন দলপতি। পূর্বদিকে সবে লাল রঙ ধরতে শুরু করেছে। চাষীরা দুই- একজন লাঙল-গরু নিয়ে মাঠের দিকে আসছে। এখানে থাকা একদম নিরাপদ নয়! দলপতির হুঁস ফিরে এল। দিনের আলো ফুটে ওঠার আগেই সামনের গ্রামে আশ্রয় নিতে হবে। আর দেরি করা ঠিক হবে না।
মানু সুন্দরীকে 'নিয়ে যাওয়ার বাসনা ত্যাগ করে, সবাইকে নির্দেশ দিল এই মুহূর্তে এ-স্থান পরিত্যাগ করতে হবে। "চল। ক্যুইক।" নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুকুরপাড় গ্রামের দিকে সবাই দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে লাগল। সারাদিন ওই গ্রামের অবস্থাপন্ন তিন বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকবে। দিনের আলো শেষ হলে বেরিয়ে পড়বে দস্যুদল।
"মানুকে আমি ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছি বড়োবাবু। নিয়েই ফিরব।" এ-কথা বলে বেরিয়েছিল যুবক। বড়োবাবুকে কথা দেওয়ার সময় লোকটির গায়ে অসুরের শক্তি ভর করেছিল। কোমরের গামছা দিয়ে মাথায় ফেট্টি বেঁধে লাঠি হাতে বেরিয়ে পড়েছিল। কথা রেখেছিল। রাজকন্যাকে রাজার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল। উদ্ধারকর্তা হলেও সে তো রাজপুত্র নয়! কিষান! "সাবাস!" বলেছিল সেজোবাবু। বড়োবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল।
।। ৪ ।।
এই যে - এত বই লোকটি পড়তে পেরেছিল তা ওই মানুর জন্য। সেজোবাবুর লাইব্রেরির ছিল। লাইব্রেরিতে সেজোবাবুর প্রিয় ভাইঝির অবাধ প্রবেশাধিকার। লোকটির বই জোগান পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। তখন লোক হয়ে ওঠেনি, ছিল তরুণ। শ্যামলা, একহারা চেহারা। বাঁশির মতো নাক। মায়াভরা চোখ। সে চোখের তারায় মানু নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল।
সারাদিন কঠোর পরিশ্রম। রাত জেগে বইয়ের পাতার পর পাতা উল্টিয়ে গেছে। কত কিছু জেনেছে। জানার আগ্রহ আরও বেড়ে গেছে। জ্ঞান আহরণের খনি খনন করে মণিমুক্তো তুলে এনে অন্তর্লোকের কুঠুরির অন্ধকার দূর করেছে। বিশ্ব-সাথে পরিচয় ঘটিয়েছে বই। 'চাঁদের পাহাড়' পড়ে তাজ্জব বনে গেল। লেখক কখনও আফ্রিকায় যাননি। সেই আফ্রিকার বর্ণনা গুটিকয়েক বই পড়ার ফল। কী কল্পনাশক্তি লেখকের? 'আরণ্যক' - রাজু পাঁড়ের প্রকৃতিপ্রেম, প্রকৃতিকে দেখার আগল খুলে দেয়। একটা 'কড়াই' - একটা মানুষের কাছে এত মূল্যবান! 'পথের পাঁচালী'র অপুর বাঁকা কঞ্চি - যা ছিল অপুর কাছে মহামূল্যবান। তা ভেঙে ফেলায় দিদির চুল ধরে মারে। পরে অনুশোচনা! নিষ্ঠা - মানুষকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়।
এই এতকিছু জানা সে তো ওই বই থেকেই। কতদিন বইয়ের পাতার নিমগ্নতা ভঙ্গ হয়েছে মোরগের ডাকে। কাছারি ঘরের বাইরে আলোর রাস্তা বন্ধ করত গামছা বা কাঁথা ঢাকা দিয়ে। পড়তে পড়তে রাত যতই হোক ব্রাহ্ম মুহূর্তে উঠে পড়তেই হতো। লাঙল গরু নিয়ে জমিতে পৌঁছে গেছে প্রভাতবেলায়।
অন্ধকারের অবগুণ্ঠন সরিয়ে পৃথিবীর জেগে ওঠার অপরূপ রূপমাধুর্যে মুগ্ধ যুবক গুনগুন করে গাইত, "এমন মানব জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা।"
সেই যে মানব জমিন চাষের ভূত মাথায় চেপেছিল, চোখে ছানি পড়ার আগ পর্যন্ত চালিয়ে গেছে। ছ'মাস আগেও ঘণ্টা চারেক কথামৃত পড়েছে। নাম জপ করেছে তিন লক্ষ বার প্রত্যেকদিন।
গত শতকের ন'য়ের দশকে এক কাপড়ে ওদেশ ছেড়ে এদেশে আসে। ছ'টা পেটের জোয়াল কাঁধে। শিশুর দুধের জোগান। জ্ঞাতির বাড়ির বারান্দায় একমাস আশ্রয় নিতে হল সপরিবারে। এর মধ্যে কিছু একটা কাজের জোগাড় করতেই হবে। কী করবে? কে কাজ দেবে? ভাইদের পড়াশোনার খরচই বা জোগাবে কীভাবে? চোখে অন্ধকার দেখে। সেই ঘোর অন্ধকারে এক চিলতে আলোর রেখার মতো যোগাযোগ ঘটে গেল এক জ্ঞাতি ভাইয়ের সঙ্গে। সে তাঁতের শাড়ি বুনত। শান্তিপুরের তাঁতের কাপড়। সপ্তাহখানেকের মধ্যে শিখে নিল কাপড় বোনা। সুতোর পর সুতো জুড়ে রং-বেরঙের শাড়ি বোনে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। নরজ থেকে যখন গোটা একটা শাড়ি স্বামী-স্ত্রী মিলে খুলে ভাঁজ করে - লোকটি স্বপ্ন বোনে - শাড়ি বোনার সঙ্গে। মেজোটার আর পড়া হবে না। বয়স হয়ে গেছে। তাঁত বুনুক আর মুনিষ খাটুক। গানটা শিখুক। গলাটা ভালো। পরের দুটো অনেক পড়াশোনা করুক। দুই-চারটে পাশ দেবে, চাকরি করবে। ছেলেটাকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে। মানব জমিনকে একেবারে পতিত রাখে না। পাশে খোলা থাকে বই। গ্রামের গ্রন্থাগারের একটা কার্ড জোগাড় করেছিল অনেক কষ্টে। একটাই নেশা ছিল - বইয়ের। জীবনে পান বিড়ি সিগারেট ছোঁয়নি। মদ তাড়ি গাঁজা দূরস্ত। শুধু বই পড়ার নেশা। শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি থাকে না। খাবার সময় বাঁ হাতে পাতা উল্টিয়ে পড়ে যায়। খাওয়া তো ডান হাতে। নুন ঝাল কম - সেদিকে নজর দেয় না। কয়েকপাতা পড়া হয়ে যায়। সপ্তাহে দুইদিন অন্তর বই পাল্টাতে যায়।
অভাবী সংসারে সবাই বেঁধে বেঁধে থাকে। ভায়েরা মান্যি করে দাদাকে। পরিবারের কেউ, বসে থাকে না। নলি ঘোরানো, সানা-বোয়া করা, কাপড়ে মাড় দেওয়া। সপ্তাহে কাপড়ের ব্যাগ হাতে, কাঁধে নরজ নিয়ে তরতরিয়ে বাসের ছাদের মাথায় ওঠে। ফেরে, রাতের শেষ বাসে। সুতো জুড়ে জুড়ে গোটা একটা কাপড় বোনার মতো সংসারটাও অভাবের ফাঁক-ফোকর বুজিয়ে সচ্ছল পরিবার গড়ে তোলার কঠোর পরিশ্রম করে চলে। দাদা, বাপ-মায়েরা সমথ্ব মেয়েদের তাঁত বোনা শিখতে পাঠায় লোকটির কাছে। ভরসা করা যায়। পাঁচ-সাতজনের মহাজন হয়ে ওঠে। সকলের দাদা। বড্ড নির্ভরতার জায়গা। কটু কথা নয়, হাসি মুখে ভুল শুধরে দেয়। হঠাৎ একদিন হোমিওপ্যাথি বই কিনে ফেলল। বাড়ির লোক ও কর্মচারীদের সর্দিকাশি, জ্বরজ্বালা, পেটব্যথা, মাথাব্যথার ওষুধ দেয়। সেরে যায়। এইট পাশের সার্টিফিকেট বের করেছিল কিছু টাকা ঘুষ দিয়ে। ভাইয়েদের স্কুলে ভর্তির সময় সার্টিফিকেট বের করতে টাকা দিতে হয়েছে। টাকা দিলে সবই মেলে। মিলে গেছে রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড, সব! সব! কুঁড়ে ঘর থেকে টিনের চালের ঘর। কাপড় বোনায় আগের মতো তেমন মন বসে না।
স্থির করল রাজস্থানে গিয়ে ডাক্তারি করবে। পাড়ি জমাল, সেখানে। পাঁচ-সাত গ্রামে ডাক্তারবাবুর নাম ছড়িয়ে পড়ল। ভালো ভালো কথা বলে, স্যুই দেয়। ভালো-মন্দ পরামর্শ দেয়, লেখাপড়া শিখে অন্দরে আলো জ্বালার কথা বলে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে অসুখ-বিসুখ কম হয়; তা এই ডাক্তারবাবুর কাছেই জেনেছে, তারা। ফুটফুটে মেমের মতো ডাক্তারবৌ - গল্প করতে করতে সূচ দেয়, বুঝে ওঠার আগেই। দুই হাত ভরে টাকা। সোনার গয়নায় সতীর অঙ্গ ভরে উঠল। দেশে পাথর বসানো কোঠাবাড়ি। টিভি, ফ্রিজ, ঘর সাজানোর আসবাব। নতুন নতুন জামা-প্যাণ্ট, পালিশ করা বুটজুতো। সতী টুকটুকে ফর্সা পায়ে আলতা লাগায়। লাল টুকটুকে শাড়ি পরে। রাজস্থানের কোল-ভীলদের গায়ে এমন সোনারবরণ 'নারী'র আলো ছড়িয়ে পড়ে। যেন পাঁকে পদ্ম ফুল। পুরুষরা কেন মহিলারাও হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ডাক্তারবউয়ের দিকে। কু-দৃষ্টি নয়। বিস্ময়! সম্ভ্রম! সতী স্বামীর দেখাদেখি শিখে ফেলে সূচ ফুটানো। ছাই ওড়া শরীরে সূচ ফোটায়। ভীল রমনীরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ডাক্তার বউয়ের দিকে। ডাক্তারবাবু না থাকলে ডাক্তারবউ ভরসা। গুলিয়ার রং ও আকার দেখে জ্বরজ্বালা, ডায়রিয়া, ঘা-পাচড়ার ওষুধ দেয় - ডাক্তারবাবু দূর শহরে ওষুধ আনতে যায় যেদিন। সারাদিনের রাস্তা। রাতে ফেরে। সতীর খারাপ লাগে না, বেশ আনন্দেই দিন কাটে। একদা এই আনন্দধারায় নেমে এল দেবশিশুর মতো দ্বিতীয় সন্তান।
।। ৫ ।।
নবদ্বীপে ডেডবডি দাহ করতে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। শিউলিতলায় শোয়ানো লোকটির চারপাশে আত্মীয়, অনাত্মীয় লোকের ভিড়। মুখটা আলগা। গলা পর্যন্ত সাদা কাপড়ে ঢাকা। দুই-একটা ফুল ঝরিয়ে শিউলি গাছ শেষ বিদায় জানাচ্ছে। কপালে চন্দনের ফোঁটা এঁকে হরিনাম লিখে দিয়েছে পুত্রবধূ। চোখ দুটো তুলসীপাতায় ঢাকা। নাম সংকীর্তন হচ্ছে। এখন লোকটির মুখমণ্ডলে যন্ত্রনার কোনো চিহ্ন নেই। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে যেন। "বলো হরি, হরি বোল..." করতে করতে চারজন ধরে লরিতে তুলে দিল।
খইয়ের সঙ্গে পয়সা ছড়িয়ে পড়ল চলার পথে। কুড়িয়ে নিল দুই একজনে। ছেলের ঘুনসিতে পরিয়ে দেওয়ার জন্য।তাহলে ঘুমের ঘোরে বিছানা ভেজাবে না। সতীর শাঁখা-পলা ভেঙে, এককৌটো সিঁদুর সিঁথিতে ঢেলে দিয়েছিল একজন বিধবা রমনী। এই কাজটি করতে কারও ভালো লাগে না। অনেক বলার পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়েছিল রতিদি। সতীর গুনগুন কান্না লোকটিকে লরিতে তোলার পর বাঁধ ভেঙে গেল। তিন-চারজনও সামলাতে পারছে না। কান্না থামানোর জন্য মহিলামহল চারপাশ ঘিরে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সতীর সদ্য অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া পৃথিবীতে আলো কখনও আসবে কি? কী সাজে সাজিয়ে রেখে গেল তাকে? হাত দুটো কাপড়ের আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখছে। এক এক করে খুলে নিয়েছে কানের দুল, নাকচাবি। আয়নার সামনে দাঁড়ালে কেমন লাগবে? ইচ্ছে হলেও নিজের প্রতিবিম্ব দেখার জন্য এক পাও বাড়াতে পারল না। বুকটা পুরো ফাঁকা করে দিয়ে গেল, লোকটা।
লরি চলে যাবার পর সর্ষের তেল এক খাবলা সতীর মাথায় থাবড়ে দিয়ে ডোবার এক হাঁটু পাকের ঘোলা জলে ডুব দিয়ে নিয়ে এল রতিদি। সাদা থান পরিয়ে বসিয়ে দিল শিউলিতলায়। একটা শিউলি ফুল ঝরে পড়ল কোলের উপর। হাত দিতেই আঙুলের ফাঁক গলে উড়ে গেল। একটা সাদা প্রজাপতি। সতী ধন্দে পড়ে গেল - তার কোলে শিউলি ফুল ঝরে পড়েনি? প্রজাপতি এসে বসেছিল! প্রজাপতি, না - শিউলি ফুল? শিউলিফুল, না - প্রজাপতি? প্রজাপতি - শিউলি ফুল, শিউলিফুল - প্রজাপতি... বিড়বিড় করতে করতে সতী ঢলে পড়ল শিউলিতলায়।
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।