।। ৯ ।।
চারটি ছোট ছেলে একসাথে বড় হতে লাগল। ওদের দেখলে তোমার নিজের ছোটবেলার ছোট ভাইগুলোর কথা মনে পড়ে। ওদের মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, এখন থেকেই। তোমার কাছে চারজনকেই নিজের সন্তানের মতই মনে হয়। কৌশল্যা আর সুমিত্রাও, প্রত্যেকেকে সমানভাবে দেখে।
কৌশল্যার ধৈর্য্য চ্যুতি ঘটত যখন রাম ঘুমাতে চাইত না, মাঝে মাঝে সে তোমার কাছে এসে ক্রন্দনরত রামকে দিয়ে যেত! তুমি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে যেমন ভাবে ভরতকে ঘুম পাড়াও, তেমনি ভাবে ঘুম পাড়াতে। আবছা স্মৃতির মত মনে পড়ে ঠিক এইভাবে তোমার মা, তোমার ছোট ছোট ভাইদের গান গেয়ে ঘুম পাড়াতেন!
তুমি ওদের, তোমার জানা সব শিক্ষামূলক কাহিনী বলতে যাতে ছোটবেলার থেকে ওদের চরিত্রের গঠন মজবুত হয়। নানা রকম খেলাধূলায় ওদের ব্যস্ত রাখতে! তার মধ্যে দিয়েও যাতে ওরা কিছু শেখে, সেদিকে ছিল তোমার কড়া নজর। বছর ছয়েক বয়েস হল যখন, তখন ওদের গুরুকুলে দেওয়া হল। আর একটু বড় হলে ওদের অস্ত্রশিক্ষাও শুরু হয়ে গেল।
তোমার এখন হাতে অনেক সময় থাকে। ছেলেদের জন্য আর ততটা সময় ব্যয় করতে হয়না।
রাজাকে বললে, "আমি দেশের মহিলাদের জন্য কিছু করতে চাই, আমাকে তুমি সুযোগ করে দাও।"
রাজা জানে, তুমি যেটা করবে বলে ভাব, সেটা করেই ছাড়। কাজেই তোমাকে বাধা দিল না। তুমি, কৌশল্যা আর সুমিত্রার সঙ্গেও পরামর্শ করলে। ওরা বুঝতে পারেনা, এই সুখের জীবনের মধ্যে আবার এসবের কি প্রয়োজন? ছেলেরা গুরুকুলে যায়, তখন মায়েরা তাদের ত্বক আর চুলের যত্নে সারা সকাল কাটিয়ে দেয়, তাদের দাসীরা তাদের পরিচর্যা করে। দুপুর বেলা রাণী মহলে, অন্য রাণীদের নিয়ে নিন্দা চর্চা চলে, তারপর দিবা নিদ্রা। এহেন আরামের জীবনে, হঠাৎ দেশের অন্য মহিলাদের নিয়ে কাজ করতে হবে কেন ? তবে কৈকেয়ীর পীড়াপীড়িতে তারাও একসময় সায় দেয়।
প্রাসাদের একটি অংশে, মাঝে মাঝেই, রাজ্যের যত মহিলা, উচ্চ, নীচ নির্বিশেষে আসে। তখন তোমরা তাদের মাঝখানে গিয়ে বস আর তাদের হরেক রকম সমস্যার কথা শোনো, বোঝার চেষ্টা কর, তার সমাধানের উপায় বের করো।
এর মাধ্যমে, সব ধরনের মহিলাদের সঙ্গে তোমাদের পরিচয় হচ্ছে। কোনরকম উপকার করতে পারলে নিজেদেরও খুব ভাল লাগে! কত দুঃস্থ নারীর জীবনের কাহিনী জানতে পারছ, প্রাসাদের চার দেয়ালের মধ্যে যেটা সম্ভব নয়। যত দিন যেতে লাগল, কাছে, দূরের গ্রাম থেকে দলে দলে মহিলারা আসত! লোকমুখে এই খবর ছড়িয়ে পড়ছিল আরও বেশী করে, তবে কিছু মহিলা হয়তো নিছক কৌতূহল মেটাতেও আসত! রাজপ্রাসাদের রাণীদের সচরাচর তো এত কাছ থেকে তারা আগে কখনও দেখেনি। তোমার নির্দেশে কৌশল্যা আর সুমিত্রাও খুব আটপৌরে ভাবেই আসত এখানে।
এইভাবে, বিশেষত নারীদের অনেক সমস্যার সমাধান ঘটছিল বলে সেকথা জানতে পেরে রাজা দশরথও তোমাদের বাহবা জানালেন, তবে রাজসভার অনেক মন্ত্রী, অমাত্যদের এই কাজ পছন্দ ছিল না। পর্দানশীন নারীদের এভাবে জনসমক্ষে এসে বসার কোনও যুক্তি তারা খুঁজে পাননা। তারা রাজার কাছেও, বিশেষ করে তোমার সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকে, একথা তুমিও তোমার চর মারফত জানতে পারো। কিন্ত রাজার প্রিয়তমা রাণী হওয়ার সুবাদে সেই অসন্তোষ কার্যত ফললাভ করেনা।
ইতিমধ্যে একদিন, তোমার দাসী আশা এসে কীরকম ইতস্তত করে কিছু বলতে চায়, যেটা আশার স্বভাববিরুদ্ধ! "কী হয়েছে, বল আমাকে পরিস্কার করে!" তুমি ওকে আশ্বাস দাও। আশা তবুও ভয় পায়, চারিদিকে তাকায়! অবশেষে অনেক কষ্টে যা বলে, তার মর্মার্থ হল এই যে, রাম নাকি তাকে বলেছে, 'তোমাদের মহিলা সভা করা একদম উচিত নয়, মেয়েদের এসব করা মানায়না! মেয়েরা ঘরেই সুন্দর!'
প্রথমেই তুমি অট্টহাস্য করে ওঠ! "আশা, রাম একটা দশ বছরের বালক, সে এসব বলতেই পারেনা, আর যদি বলেও থাকে, সে মানে না বুঝেই বলেছে।" আশাকে আশ্বস্ত করলেও নিজে একথা ভুলতে পারছনা! তোমার ছেলের মুখে একি কথা! ঠিক করলে, নিজেই রামকে জিজ্ঞেস করবে, একথা সত্যিই সে বলেছে কিনা!
পরদিন বিকেলে, যখন ছেলেরা সবাই তাদের শরীর চর্চার শিক্ষা শেষ করে ফিরছে তখন তুমি রামকে ডাকলে। কপালের ওপর ঘামে ভেজা চুল এসে পড়েছে,
রাম তার সরল, পদ্মপলাশ চোখ তুলে বলল, "কী বলছ মা?" তোমার মাতৃ হৃদয় আবেগে উদ্বেল হয়ে উঠল, তার এমন সোনার টুকরো ছেলের মনে কোনও খারাপ থাকতেই পারেনা! কিন্ত তাকে জানতে হবে সত্যিটা!
"আজকের দিনটা কেমন ছিল, সোনা? ভাল করে পাঠ নিয়েছো, খেলাধুলো করেছো তো?" রাম মাথা নাড়ল!
"বাঃ, আজকে আমারও খুব ভাল কেটেছে, প্রথমে মহিলা সভা ছিল, তারপর আজকে আবার রাজসভায়ও যেতে হয়েছিল।" মাঝে মধ্যে রাজার আহ্বানে তোমার ডাক পড়ত, কোনও মন্ত্রনা সভাতে। রামের চোখের দৃষ্টি মুহুর্তের মধ্যে পালটে গেল, যেন কোন বড় মানুষের বিরক্ত চোখের চাহনি! "না, নারীদের এইসব না করাই ভাল! সমস্ত লোকের মাঝে কেন মেয়েরা বেরোবে? যেসব মেয়েদের বাইরের পুরুষ মানুষ দ্যাখে, তাদের বলে 'বারনারী'!
"কে তোমাকে এসব শেখাচ্ছে রাম? তোমার গুরুরা? কার কাছে শুনেছ একথা, বল আমাকে?" ক্রোধে ফেটে পড়লে তুমি। তোমার রুদ্র মূর্তি দেখে রাম ভয় পেয়ে কাঁদতে লাগল, "মা, আমি শুনেছি, আমাদের প্রহরীরা বলছিল, আমাকে ক্ষমা করো মা, আমি অন্যায় করে ফেলেছি!" ওর কান্না দেখে তোমারও ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি ওকে বুকের কাছে টেনে এনে আস্তে করে বললে, "কোনও দিন এমন কথা আর বলোনা! মেয়েদের যদি সম্মান করতে না পার তাহলে নিজেও কখনো সম্মান পাবে না! এ কথা মনে রেখো।" তোমার অন্য তিন ছেলে বা সেখানে উপস্থিত সকলেই, এই ঘটনায় হতচকিত হয়ে এই দিকেই তাকিয়ে আছে।
রামকে তিরস্কারের এই ঘটনা তুমি রাজাকে আর কৌশল্যাদের জানিয়েছিলে। ওরা সবাই তোমাকে বলেছিল, তুমি উচিত কাজই করেছো।
এর কিছুদিন পরে রাজারই উদ্যোগে তুমি তোমার চার ছেলেকে নিয়েই 'কেকয়া' বেড়াতে গেলে। শত্রুঘ্ন ছাড়া ভরত এক পাও কোথাও নড়বে না। লক্ষণ যেমন রামের ছায়া হয়ে ঘোরে সব সময়!
কেকয়ার রাজা এখন যুধাজিত। পিতা এখন ভগ্ন শরীরের কারণে অরণ্যে নিভৃত বাস করছেন। বারো বছর পর আবার কেকয়াতে, তোমার নিজের দেশ, পাহাড় আর উপত্যকায় ঘেরা, যার একপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সরস্বতী নদী।
কেকয়ার রাজা যুধাজিতের আদরের ভাগ্নেরা এত খাতির পেতে লাগল যে তাদের আর আনন্দের অবধি রইল না।
(ক্রমশ)
গ্রন্থের নামঃ কৈকেয়ী (Kaikeyi: A Novel)
লেখিকাঃ বৈষ্ণবী প্যাটেল (Vaishnavi Patel)
ভাষাঃ ইংরাজী
প্রকাশকঃ রেডহুক (Redhook)
বাঁধাইঃ পেপারব্যাক
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৫১২ পাতা
মুদ্রিত মূল্য (ভারতীয় মুদ্রায়): ১,৭৩৪ টাকা