ভ্রমণ ও দেশ-বিদেশ

রাঁচি-নেতারহাটঃ জলপ্রপাত-পাহাড়-অরণ্য ছুঁয়ে



অমৃতাভ দে


সপ্তমীর সকালে বেরিয়ে পড়েছিলাম জলপ্রপাতের রাজ্য ঝাড়খণ্ডের উদ্দেশ্যে। নদী, পাহাড়, অরণ্য আর জলপ্রপাত দিয়ে ঘেরা রাঁচি পর্যটকদের আকর্ষণ করে বারবার। দুর্গাপুর ব্যারেজ পেরিয়ে পুরুলিয়ার পথ ধরে যখন রাঁচি পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা নামছে। বাঁকুড়া-পুরুলিয়া হয়ে রাঁচি যাবার পুরো পথটাই নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর। লালমাটির দেশ আমার কাছে কবিতার মতো। বর্ষায় বৃষ্টি হয়েছে খুব, তাই সবুজ পাহাড় গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। পুরুলিয়ার পথ ছুঁয়ে জলপ্রপাতের রাজ্যে যখন ঢুকলাম তখন বুঝতেই পারলাম না আমরা আমাদের প্রতিবেশী অন্য এক রাজ্যে পৌঁছে গিয়েছি। চোখে পড়ল দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল। রাঁচি স্টেশন-সংলগ্ন এলাকায় অনেকগুলি পুজো হয়। স্বাভাবিকভাবেই পুজোর আনন্দকে অন্যরাজ্যে এসে উপভোগ করতে কোনো অসুবিধা হল না। হোটেলে ফ্রেশ হয়ে কয়েকটি পুজো প্যান্ডেল ঘুরে দেখলাম, রাত্রে অনেকটা সময় কাটলো রাঁচি স্টেশনে।

পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়া স্বপ্নের জোনা ফলস্ দেখতে। মোহনীয় এক প্রাকৃতিক পরিবেশ। অসংখ্য সিঁড়ি নেমে পৌঁছতে হয় জলপ্রপাতের কাছে, তবে জলপ্রপাতের শব্দ কানে আসবে অনেক আগে থেকেই। এই জলপ্রপাত দেখার সময় বেশি তাড়াহুড়ো না করাই ভালো। ওখানকার গাইডের কাছ থেকেই শুনলাম এখানে এসে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। চারপাশে যেহেতু পাহাড় ঘেরা, তাই বাতাসের স্বাভাবিক প্রবাহমানতা এখানে নেই এবং জলপ্রপাত দেখতে যেহেতু অনেকটা নিচে নামতে হয়, সে কারণেই শরীরের ভেতর একটু অস্বস্তি হতে পারে। কিন্তু মন ভরাবেই জোনা ফলস্। উপরি পাওনা হতে পারে জলপ্রপাতে রামধনুর খেলা। স্থানীয় মানুষেরা বাঁশের তৈরি হস্তশিল্প সামগ্রী বিক্রি করছেন খুব অল্প দামে, সংগ্রহ করতে পারেন।

জোনা ফলস্ দেখে আমরা রওনা দিলাম সীতা ফলস্ দেখতে। এই জলপ্রপাতটিও মন কাড়বে। সীতা জলপ্রপাত দেখতে অনেকগুলি সিঁড়ি ভাঙতে হয় ঠিকই কিন্ত উপর থেকেই সিঁড়ি না-ভেঙে দেখে নিতে পারবেন জলপ্রপাতের সৌন্দর্য। তবে ছায়াঘেরা পথে শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে আলাদা এক অনুভূতি।

রাঁচি বেড়াতে আসবো অথচ হুড্রু জলপ্রপাত দেখব না! সেটা তো হয় না। কিন্তু হুড্রু জলপ্রপাতের সৌন্দর্য দেখতে গেলে নামতে হয় প্রায় ৭৪৫টি সিঁড়ি। সেটি বেশ কঠিন কাজ। আমি অবশ্য পৌঁছেছিলাম শেষ পর্যন্ত। সঙ্গে নিয়েছিলাম স্থানীয় একজনকে, তার নাম গোবর্ধন। গোবর্ধনের একটা পা জখম হলেও সারাদিনে বেশ কয়েকবার পর্যটকদের নিয়ে এতগুলো সিঁড়ি ভেঙে সে পৌঁছে যায় জলপ্রপাতের কাছে।পরম যত্নে পর্যটকদের জলপ্রপাত দেখিয়ে নিয়ে এসে আবার নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিয়ে যায়। উপার্জন হয় কিছু। ওর এক ছেলে এক মেয়ে এই হুড্রু জলপ্রপাতের পথের ধারেই বাঁশের তৈরি নানা জিনিস বিক্রি করে। পরিচয় হল ওদের সাথে। যে উঁচু স্থান থেকে জলধারা অনেক নিচে গভীরে প্রচন্ড গতিতে ধাবমান, সেই স্থানটি দেখতেও বেশ ভালো লাগবে। এতগুলো সিঁড়ি ভাঙতে শারীরিক কষ্ট একটু হতে পারে, তাই স্থানীয় কোনো মানুষকে সঙ্গে রাখলে মনের জোর বাড়ে।

মহাষ্টমীর বিকেলে সূর্য যখন অস্ত যাচ্ছে তখন রাজারাপ্পায় আমাদের নৌকাবিহার। ছোট্ট জলপ্রপাত হলেও খুবই সুন্দর এবং দামোদর নদীর বুকে পাথরের তৈরি অপূর্ব ভাস্কর্যের ভিতর দিয়ে ভ্রমণ মুগ্ধ করল আমাদের। এখানে ভৈরবী নদী এসে পড়েছে দামোদরে। মন্দির দর্শন হয়েছে আগেই। নানা ফুলে সাজানো হয়েছিল মন্দির চত্বর।

নবমীর সকালে সেরা উপহার পেলাম প্রকৃতির কাছ থেকে।

রাঁচি বেড়াতে এসে দশম ফলস্ সবাই দেখেন। কিন্তু দশম ফলস্ দেখে এসে আরেকটু পাহাড়ের উপরে উঠলেই এক অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়, দেখা যায় যেমন দশম ফলস্, তেমনি আরেকটি ধারা আপনার সামনে ধরা দেবে। মায়াময় এই প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাদের উপহার দিল অনেককিছু। কিছু ঘর মানুষের বাস এখানে। তারা আছে জীবনছন্দে। পাহাড়ি গ্রামের স্বাদ পাবেন এখানে। এই নির্জনে কিছুটা সময় অবশ্যই কাটিয়ে যাবেন।

দশম ফলস দেখে আমরা চলে গেলাম সান টেম্পল দেখতে। এই সূর্যমন্দির খুবই জনপ্রিয় এবং বেশ একটু অন্যরকম। রথের আদলে মন্দির, রথের ১৮টি চাকা এবং ৭টি ঘোড়া টানছে সেই রথ।

এইদিন পুরো বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাঁচি শহরের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখে নেওয়া। রাঁচি শহরের প্রাণবায়ু রক গার্ডেন ও কাঁকে ড্যাম। বিরাট জায়গা জুড়ে তৈরি হওয়া এই গার্ডেনটিতে বসে অনেকটা সময় কেটে যাবে। প্রচুর গাছপালা, স্থাপত্য-ভাস্কর্যে সাজানো। এখান থেকেই কাঁকে ড্যামের রূপ অবলোকন করতে পারেন। মনে হবে পটে-আঁকা ছবি। লেকে নৌকাবিহার করতে পারেন।

রাঁচিতে 'টেগোর হিল' বলে একটি জায়গা আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি এখানেই। জীবনের বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছেন তিনি এখানে। জায়গাটি মুগ্ধ করল। স্মৃতি হিসেবে বাড়িটা রয়ে গেছে। ফলকগুলো দেখলে মনে অদ্ভুত অনুভূতি হয়।একটি ফলকে লেখা ছিল - "রাঁচীবাসীদের পরম সৌভাগ্য, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতো এক বিরাট প্রতিভাবান, উজ্জ্বল, উচ্ছল, স্বপ্নদ্রষ্টা, আধুনিক, বিচিত্রকর্মা, সর্বোপরি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার পরিপোষক মহান ব্যক্তিত্ব রাঁচীকে তাঁর সুদীর্ঘ শেষজীবনের বাসস্থান হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন (১৯১০-১৯২৫)।" এখানে মিউজিয়াম গড়ে উঠলে ভালো হতো। এটি মোরবাদী পাহাড়। 'টেগোর হিল' নামে সমধিক পরিচিত। এখান থেকে পুরো রাঁচি শহরকে দেখতে পাওয়া যায়।

রাঁচির রামকৃষ্ণ আশ্রম ঘুরে দেখে নিতে পারেন। সন্ধ্যেবেলায় রামকৃষ্ণ মিশনের দুর্গাপুজোর সন্ধ্যারতি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের। এই রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের কৃষি-পশুপালন-জৈবসার উৎপাদন প্রকল্পগুলির কথা জেনে খুব ভালো লাগল। পাশেই গড়ে উঠেছে 'রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ ইউনিভার্সিটি - স্কুল অফ এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভলপমেন্ট'।

পরদিন সকালে পাত্রাতু ভ্যালি হয়ে আমাদের গন্তব্য ছিল নেতারহাট। চোখধাঁধানো পাত্রাতু ভ্যালি আমাদের জন্য তার রূপের ডালি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। শীতের সকাল আর পাত্রাতু লেকে নৌকাবিহার হৃদয়বীণায় সুর এনে দিল। পাহাড়ঘেরা পাত্রাতু লেক কাশ্মীরের ডাললেকের কথা মনে করিয়ে দিল। সুসজ্জিত নৌকায় কুয়াশার বুক চিরে এসে পৌঁছলো সকালের সূর্যালোক। পাত্রাতু ভ্যালির পথ আসলে জিগজ্যাগ, সিল্করুটের মতো। ভিউপয়েন্টে দাঁড়িয়ে পুরো রাস্তাটিকে দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যাবে।

এখান থেকেই আমরা চলে গেলাম ঝাড়খণ্ডের পাহাড়ি গ্রাম নেতারহাট। নেতারহাটকে বলা হয় 'কুইন অফ ছোটনাগপুর'। নেতারহাটে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখার জন্য ছুটে যান পর্যটকেরা। নির্জনে একটা রাত পাহাড় আর অরণ্যের সাথে কাটাতে বেশ লাগবে। নেতারহাট যাবার রাস্তাটির বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সবুজ পাহাড়ের কোলঘেঁষে, সবুজ শস্যক্ষেতকে পাশে রেখে এ পথ চলে গেছে। মনে হয় এ পথে অসুখ নেই কোনো। মায়াবী পথে বারবার থামতে হয়, পাহাড়ঘেরা উপত্যকা - যেন তার শেষ নেই কোনো। সবুজ বনানী আলিঙ্গন করবে। দুপুরের মধ্যেই নেতারহাট লেকের পাশে একটি হোটেলে উঠলাম আমরা। দশমীর বিকেলে দুর্গামণ্ডপকে ঘিরে বিশাল মেলা বসেছে। আমাদের ভ্রমণের এক পরম প্রাপ্তি এই মেলা। বিকেলে সূর্যাস্ত দেখবার জন্য চললাম 'ম্যাগনোলিয়া ভিউপয়েন্ট'-এ। প্রকৃতিপ্রেমে মগ্ন এক সাহেব কন্যার আত্মহত্যার স্মারক এই জায়গাটি। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখবার স্মৃতি মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে আজীবন। প্রসঙ্গত জানাই, ম্যাগনোলিয়া ভিউপয়েন্ট পৌঁছোনোর রাস্তায় পাইনের বন আপনার সঙ্গী হবে।

আমরা ফেরার পথে বৃষ্টি পেলাম। পাহাড়ের অরণ্যে বৃষ্টি আমাদের সামনে তৈরি করল জলরঙের ক্যানভাস। মেলা তখনও জমজমাট। তারপর একে একে মানুষ ঘরে ফিরতে শুরু করল। দুর্গাঠাকুর বিসর্জন দেওয়া হল নেতারহাটের লেকে। ক্রমশ সমগ্র নেতারহাট জুড়ে ঘনিয়ে এলো অন্ধকার, মায়াময় এক নির্জনতা।

সকালবেলায় লেকের পাশ দিয়ে আমরা চলে গেলাম কোয়েল ভিউপয়েন্টে, এখান থেকে সূর্যোদয় দেখা যায়। নিচ দিয়ে বয়ে গেছে কোয়েল নদী। বিশালাকৃতির ঝাউবনের গভীর জঙ্গল বিছিয়ে রেখেছে প্রশান্তি। নেতারহাটের ন্যাসপাতি বাগান আমাদের প্রথম চেনাল ন্যাসপাতি গাছ। এখানকার অন্যতম আকর্ষণ এই ন্যাসপাতি বাগান। ঘুরে দেখে নিতে পারেন আপার ঘাঘরি, লোয়ার ঘাঘরি জলপ্রপাত। অরণ্যপথে এই জলপ্রপাত আপনার মন খারাপ দূর করতে পারে।

নেতারহাটকে পিছনে ফেলে এবার আমাদের গন্তব্য ম্যাকলাস্কি সাহেবের স্বপ্নের ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। নেতারহাট থেকে ম্যাকলাস্কিগঞ্জের পথে একেবারেই একটি অন্যরকম অনুভূতি হয়েছিল আমাদের। গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ চলে গেছে ক্রান্তি ফলসের দিকে। নির্জনে প্রকৃতির মাঝে এই ফলস দেখতে অবশ্য বিশেষ কেউ যান না। গা ছমছমে পরিবেশ, একেবারেই শুনশান। আমরা তো অভিভূত।

সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহর প্রিয় জায়গা ম্যাকলাস্কিগঞ্জকে ঘিরে বহু ইতিহাস। সে ইতিহাস পরে কোনোদিন শোনাব তোমাদের।


কীভাবে যাবেনঃ হাওড়া থেকে ট্রেনে সরাসরি রাঁচি চলে যেতে পারেন। রাঁচি থেকে গাড়ি নিয়ে নেতারহাট ঘুরতে পারেন।

কোথায় থাকবেনঃ রাঁচিতে থাকার জন্য অজস্র হোটেল রয়েছে। তবে নেতারহাটে থাকতে গেলে আগে থেকে বাংলো বুক করে যাওয়া ভালো, কারণ সেখানে হোটেল কম।

কোন্ সময় যাবেনঃ যে কোনো সময় যেতে পারেন। বর্ষার পরে গেলে জলপ্রপাত এবং সবুজ অরণ্যকে উপলব্ধি করা যায় যথাযথ।