বিবিধ

কৃষ্ণনগরে কাজী (সপ্তদশ পর্ব) [ধারাবাহিক]



ইনাস উদ্দীন


[১৯২৬ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর এসেছিলেন, এনেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। কবিকে কেন এনেছিলেন তিনি? শুধুই বন্ধু বলে? প্রতিভাবান কবি বলে? মাস ছয়-সাতেক গোলাপট্টিতে থেকে কবি গ্রেস কটেজে আসেন। ঠিক কবে আসেন তিনি? জুলাই, নাকি আগস্ট? কেনই বা এলেন এই বাড়িতে? ভীষণ দারিদ্র্যের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে? অনেক কিছুই আমরা জানি না, জানাও যায় না। এখান-ওখান থেকে জোগাড় করা তথ্য আর তার সাথে খানিক অনুমান মিশিয়ে টুকরো কথার কিছু দৃশ্য সাজিয়ে তোলার চেষ্টা এই কাহিনীতে।]

।। ১৭ ।।

- সুভাষবাবু থাকলে কি লেবার স্বরাজ পার্টিতে যোগ দিতেন?

কলতান মুখর ঘরে হঠাৎই নিস্তব্ধতা নেমে এলো। অত্যন্ত সাদামাটা প্রশ্ন। তাছাড়া দেশবন্ধুর আকস্মিক প্রয়াণে বাঙলায় জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিতে যে ধরনের দলাদলি, কখনো কখনো কুশ্রী রকমের নিম্নরুচির চেহারা বেরিয়ে পড়ছে, তাঁর স্বপ্নের স্বরাজ্য দলটি একপ্রকার অর্থহীন এবং অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে, তাতে সুভাষ জেলের বাইরে থাকলে নিজেই হয়ত নতুন দল গঠনে উদ্যোগ নিতেন। তবু সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ অথচ সোজাসাপটা প্রশ্নটা সবাইকেই একটু থমকে দিল।

'সেটা একমাত্র সুভাষের পক্ষেই বলা সম্ভব' - হেমন্ত সরকার নীরবতা ভঙ্গ করলেন। উপস্থিতদের মধ্যে সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে জোর দিয়ে কথা বলবার অধিকার শুধু তাঁরই আছে। কাছের বন্ধু বলে শুধু নয়, সমবয়সী হলেও সুভাষ তাঁকে রাজনীতিতে অগ্রজ পথপ্রদর্শক বলে স্বীকার করেন। 'আমরা যখন দল তৈরি করি তখন সুভাষ জেলে। আর শুধু জেলে নয়, সেই বর্মা মুলুকে মান্দালয় জেলে। সাম্যবাদী ভাবনায় নতুন দলগঠনের ব্যাপার নিয়ে চিঠিপত্রে নিয়মিত মতবিনিময় এবং খবরাখবর আছে ঠিকই, কিন্তু দেশবন্ধুর চলে যাওয়ার পরের অবস্থাগুলি যাকে বলে চোখে দেখা - সুভাষ সেটা দেখেনি। বাইরে বেরোনোর পরে সে সিদ্ধান্ত নেবে।

- সে তো মুজফফর সাহেবও জেলে ছিলেন। আপনাদের দল তৈরির সময় ঘনিষ্ঠ না থাকলেও সব খবরই আমি জানি। লাঙলের ইশতেহার, কাজী সাহেবের সাম্যবাদী সবই পড়েছি। জাতীয় কংগ্রেসের ভিতরে থেকেও আলাদাটি কোথায় সেটা ঠিকই বুঝেছি। মুজফফর সাহেবের সিদ্ধান্ত নিতে তো দেরি হয়নি।

হেমন্ত সরকার একপ্রকার হেসেই উঠলেন। 'মুজফফর সাহেব আবার কী সিদ্ধান্ত নেবেন! ভাবনাটাই তো তাঁর। জেল থেকে তিনিই আমাদের আইডিয়া সাপ্লাই দিয়ে গেছেন।'

আপাত গম্ভীর মুজফফর সাহেবও বোধহয় মুচকি হাসলেন। কিন্তু সৌমেন্দ্রনাথ খুব নম্রসুন্দর ভাবেই মনের মধ্যে উঁকি মারা কথাটা বলে ফেললেন - 'তা যাই বলুন হেমন্ত বাবু, মান্দালয় জেলে দুর্গাপূজা নিয়ে এতো হৈচৈ এতো আন্দোলন করা সুভাষ বাবুর পক্ষে শোভন হয়নি'।

গত পুজোর সময় মান্দালয় জেলে দুর্গাপূজা করার অধিকার এবং তার জন্য সরকারি সহায়তার দাবিতে কয়েদিদের আন্দোলন ইতিমধ্যেই বাঙলায় যথেষ্ট প্রচার পেয়েছে। ফরোয়ার্ড পত্রিকায় প্রায় নিয়মিত সে সংবাদ ছাপা হয়েছে।

সুভাষচন্দ্র তো বটেই, বিপিন বিহারি গাঙ্গুলি, ত্রৈলোক্যনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ প্রথম সারির রাজবন্দীরা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। শেষমেশ জেল কর্তৃপক্ষ নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এরকম একটা সাফল্য-সংবাদ নিয়েও প্রশ্ন উঠলে, বিশেষ করে সুভাষচন্দ্রের মতো নেতৃত্ব প্রসঙ্গে - বিষয়টি অস্বস্তিকর হয়ে পড়ে।

মুজফফর আহমদ ধীরকণ্ঠে বললেন, 'আপনি একটা গভীর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কথাটি উল্লেখ করেছেন বুঝতে পারছি। কিন্তু সুভাষ বাবুর লক্ষ্য যে পূজার কার্যে অধিকার আদায় করা নয় সেটা আপনিও বোঝেন। এটি ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে একটা জাগরণ সৃষ্টি করার একটা হাতিয়ার, একটা আন্দোলন। প্রেসিডেন্সি জেলে সাহেব কয়েদিদের জন্য বড়দিনের উৎসবে সরকারি সহায়তা ও খরচ করা হয়েছিল। এই বৈষম্যের বিষয়টিকে সামনে রেখে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে উদ্দীপিত করা - সুভাষবাবু সেই কর্তব্যই করেছেন। দেবীপূজার অনুষঙ্গ এখানে উপলক্ষ মাত্র। আমাদের কাজী সাহেব তো দেবীস্তুতি করেই ব্রিটিশ শাসককে ভয় ধরিয়ে দিলেন!'

বলার ভঙ্গিতে নজরুল সর্বাগ্রে হো হো করে হেসে উঠলেন। 'সৌমেন বাবু, এখন ইংরেজ তাড়ানোই মুখ্য কাজ। আর তার জন্য ভারতবর্ষের মাটিতে মাতৃশক্তি জাগরণই সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী পন্থা। যার যেখানে যেরকম হাতিয়ার হাতের সামনে আছে, তাই দিয়েই লড়ে যেতে হবে।'

'কিন্তু কাজী সাহেব, দেশ স্বাধীন হলে আমরা ফের নবাব আর মহারাজাদের শাসনে ফিরে যাব?' সৌমেন্দ্রনাথও একপ্রকার হেসেই জবাব দিলেন।

হেমন্ত সরকার চুপচাপই ছিলেন। একটু যেন উৎসাহিত হয়েই বললেন - ঠিক এই ভাবনা নিয়েই তো আমাদের এতো কাণ্ড। কী জানেন সৌমেন বাবু, এই যে সাধারণ শ্রমিক কৃষকদের কথা মাথায় রেখে আমরা নানান কথা ভাবছি, কানপুরে কমিউনিস্ট সংস্রবের দোষে মুজফফর সাহেব জেল খেটে এলেন, ঠাকুরবাড়ির সামন্ত-স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আপনি বিভিন্ন সভা-সমিতিতে যোগ দিচ্ছেন - সুভাষের ভিতর এই সমস্ত ভাবনারই একটা সমন্বয় আছে। খুব ঠান্ডা মাথায় ভাবতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রসঙ্গক্রমে একটা ঘটনার কথা আপনাদের বলি। সে বছর দশেক আগের কথা। আমি এবং সুভাষ একবার পলাশীর প্রান্তর ঘুরে নৌকা করে কৃষ্ণনগর ফিরছি। চাঁদনী রাত। কথায় কথায় দু'জনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম সন্ন্যাস নেব। বিবেকানন্দের ধারায় আমরা ঘুরে ঘুরে দেশটাকে দেখব। কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হরিদ্বার হয়ে হিমালয়ের এদিক ওদিক ঘুরি, সাধু বাবাজি দেখলেই তাঁদের কাছে বসি। সুভাষের কিন্তু কাউকেই পছন্দ হয়না। এরা তো সবাই দিবারাত্র নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, আর কারো কথা তাঁরা ভাবেন না। শেষমেশ এলাহাবাদের কাছে এসে পেলাম এক অন্যরকম সাধু রাখাল মহারাজকে। তিনি বললেন - এটা তোদের পথ নয়। মানুষের কাছে ফিরে যা। আমরা ফিরে এলাম। কিন্তু এই ক'দিনে আমরা লাভ করেছিলাম প্রচুর। সুভাষকে দেখলাম - অনেক বদলে গেছে। জাতি-ধর্ম বর্ণ-সম্প্রদায় ইত্যাদির কলুষকে হাতিয়ার করে ইংরেজরা আমাদের দেশটাকে কিভাবে পঙ্কিল আবর্তে নিমজ্জিত করে রেখেছে - তার চেহারা ওর কাছে একেবারে স্বচ্ছ করে সুভাষ ধরে ফেলেছিল। সৌমেন বাবু, চারিদিকে সাম্প্রদায়িকতার নোংরা রাজনীতি আর ক্ষমতার দলাদলি যেভাবে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করে দিচ্ছে - দেশবন্ধুর আকস্মিক শূন্যতায় দিশেহারা হয়ে যাওয়া এই সময়ে সুভাষের বড়ো দরকার ছিল। সেটা মনে করিয়ে দিতেই লাঙলের বিশেষ সংখ্যার ভাবনা।

মণিভূষণ মুখোপাধ্যায় আপনমনে নিজের কাজ করে যাচ্ছিলেন। সময় তো কম হেমন্তদা, সুভাষ বাবুর বিষয়ে লেখা তো যোগাড় করতে হবে। এবারে কাজীও কবিতা দেয়নি। সাম্যবাদীর জের চলছে এখনো। চটি বই ছাপানো হয়েছে, সেটা বিক্রিও হচ্ছে বেশ। আগের সংখ্যাতে 'সব্যসাচী' ছাপা হয়েছে। মানুষজন তো নজরুলের কবিতার জন্য মুখিয়ে থাকবে!

নজরুল হেসে বললেন, মণিদা, আমি তো লাঙলের অর্ধেক জুড়ে প্রচুর লিখলাম। এক-দু'হপ্তা বিশ্রাম দিন!

মুজফফর আহমদ বললেন - না মণিবাবু, পাঠক কিন্তু জেনে গিয়েছে কবিবর কাজী নজরুল ইসলাম অসুস্থ, বর্তমানে কৃষ্ণনগরে অবস্থান করিতেছেন। সেই কারণে অ্যালবার্ট হলে কবির সাহায্যার্থে আয়োজিত ভ্যারাইটি এন্টারটেনমেন্ট বাতিল করা হয়েছে, টিকিটের মূল্য ফেরত প্রদান করা হচ্ছে, সুস্থ হয়ে শীঘ্রই হেমন্তবাবুর সঙ্গে বঙ্গ সফরে বাহির হবেন - এতো কিছু জানার পরে কাজী সাহেবের কবিতা না পেলে পাঠকবর্গ খুব একটা হতাশ হবেন বলে মনে হয়না।

বলার ভঙ্গিতে বেশ একটা সরসতা ছিল, যেটি আহমদ সাহেবের নিকটে দুর্লভ। বাচন উপস্থাপন এবং কথার যৌক্তিকতা সকলেই বেশ উপভোগ করলেন।

- তাই বলে কাজীর লেখা বাদে লাঙল ছাড়া যায় নাকি?

- ময়মনসিংহ সম্মেলনের জন্য কাজীর লেখা চিঠিখানা আমার কাছে আছে। এবারে ওটাই ছাপিয়ে দিন মণিবাবু। হেমন্ত সরকার তাঁর সুটকেস সদৃশ চামড়ার ব্যাগ থেকে একটি কাগজ বার করে মণিবাবুর হাতে দিলেন। 

লাঙলের বিশেষ সংখ্যা নিয়ে কথাবার্তা হয়ে ঠিক হলো সুভাষচন্দ্রের একটা জীবনকথা ছাপা হবে। হেমন্ত সরকারই সেটি লিখে দেবেন। এছাড়া তাঁর নিজের কাছে সুভাষের লেখা কিছু চিঠি আছে। সেগুলি ছাপানো হবে। মান্দালয় জেল থেকে দিলীপ রায়কেও বেশ কয়েকটা চিঠি লিখেছেন। বাসন্তী দেবী এবং শরৎবাবুকেও চিঠি লিখেছেন বলে শুনেছেন। হেমন্ত বাবু যতটা সম্ভব এর মধ্যে সংগ্রহের চেষ্টা করবেন। কার্ল মার্ক্স-এর উপরে তো দেবব্রত বসু লিখেছেন, এবারে লেনিনের উপরে লিখছেন জানিয়েছেন। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ম্যাক্সিম গোর্কির 'মাদার'এর অনুবাদ করছেন। সেগুলি তো থাকবেই। নরেন্দ্র দেবের একটি কবিতা পাওয়া গিয়েছে। সর্বশেষ সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর দায়িত্ব অর্পিত হলো - লাঙল-এর জন্য গুরুদেবের আশীর্বচন যোগাড় করতে হবে। নজরুল ইসলামের প্রতি তাঁর তো শুধু স্নেহ নয়, বিশেষ পক্ষপাতিত্ব আছে - অন্তত কলকাতার সুধীমহল সেইরকম মনে করেন। ধূমকেতুর জন্য আশীর্বাণী পাঠিয়েছিলেন, লাঙলকেও আশা করা যায় নিরাশ করবেন না।

হেমন্ত সরকার সন্ধ্যার ট্রেনে ফিরে যাবেন কৃষ্ণনগর। নজরুল থেকে গেলেন। মুজফফর আহমদ লাঙল-এর অফিসেই পাশের ঘরটিতে বসবাস করছেন। আজ তাঁর সঙ্গে রাত কাটাবেন। বহুদিন পরে, কোলাহলের বাইরে একান্ত করে মুজফফর আহমদের সঙ্গে কথা হবে। নার্গিসের সঙ্গে বিবাহ নিয়ে নানাবিধ দুর্বিপাকের সময় তাঁকে মুজফফর সাহেব উদ্ধার করে এনেছিলেন। প্রমীলার সাথে বিবাহ-বন্ধন এবং তৎপরবর্তী অধিকতর দুর্বিপাক - মুজফফর আহমদ কারাগারে বন্দী না থাকলে নজরুলের জীবন হয়ত অন্যপথে প্রবাহিত হতো। রণক্লান্ত বিদ্রোহীর সামনে আর কেউ এসে না দাঁড়াক - মুজফফর আহমদ ঠিক এসে দাঁড়াতেন।

শীতের কম্বলের ব্যবস্থা করে পাশের তক্তপোষ ঝেড়েঝুড়ে মুজফফর আহমদ নজরুলকে নিয়ে নেমে এলেন পথে। হ্যারিসন রোড ধরে হাঁটতে থাকলেন শিয়ালদহের দিকে। শীতের রাত্রি, দেরি হলে দোকানে আর রুটি পাওয়া যাবে না।

(ক্রমশ)

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।