বিবিধ

শত শতাব্দীর জাদুবিদ্যা (একাদশ পর্ব)



জাদুকর শ্যামল কুমার


ইউরোপে জাদুবিদ্যা (১৮০০-১৮৭৫)

জাদু সিন্দুক

এক অতি বলিষ্ঠ আরবীয় যুবক সাহসের সঙ্গে মঞ্চে পদার্পণ করলেন। রবার্ট হুডিন (Robert Houdin) তাকে একটি হালকা কিন্তু মজবুতভাবে তৈরী সিন্দুক দেখালেন। এই সিন্দুকের উপরে ধরবার জন্য একটি হাতল ছিল। জাদুকর হুডিন যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, সিন্দুকটি সে তুলতে পারবে কিনা? সঙ্গে সঙ্গে আরবীয় যুবকটি সহজেই সিন্দুকটি তুলে ফেলল। রবার্ট হুডিন এইবার ঘোষণা করলেন যে এই যুবকটিকে আমি স্ত্রীলোকের থেকেও দুর্বল করে দেবো ও আর সিন্দুকটি তুলতে পারবে না। জাদুকর যুবকটিকে সিন্দুকটি আবার তুলতে বললেন। সিন্দুকটির হাতল ধরে যুবকটি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল। সে তার পা দুটি শক্ত করে, খুব জোর দিয়ে সিন্দুকটি তোলার চেষ্টা করে যেতে লাগলো। তার মাংসপেশী ফুলে উঠলো, মুখে ঘাম ফুটে উঠলো। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মঞ্চ থেকে এবং শেষে  ওই থিয়েটার থেকেই সে বাইরে পালালো।

রবার্ট হুডিন তাঁর এই খেলার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এইভাবে - সিন্দুকের নিচের তলায় একটি ইস্পাতের পাত লুকোনো থাকত। আর মঞ্চের নিচে একটি শক্তিশালী বৈদ্যুতিক চুম্বক রাখা হতো। জাদুকর হুডিন-এর নির্দেশ মতন যখন বিদ্যুৎ চালানো হতো তখন সিন্দুকের নিচের ইস্পাতের পাতটি সিন্দুকের সঙ্গে আটকে যেত। ফলে এই সিন্দুককে তখন কারো পক্ষেই একচুলও নাড়ানো সম্ভব হতো না।

বুলেট ক্যাচিং-এর ম্যাজিক

প্রদর্শনীর চরম অবস্থা এরপর আসে। রবার্ট হুডিন ঘোষণা করেন যে তাঁর একটি মন্ত্রপূত কবচ আছে, যেটা তাঁকে বুলেটের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। তাই তিনি থিয়েটারে উপস্থিত যে কাউকে, যে ঠিক ঠিক লক্ষভেদ করতে পারেন তার হাতে বন্দুক তুলে দেন। জাদুকর হুডিন এরপর দর্শকদের পিস্তল, পাউডার ও টোটা দিলেন পরীক্ষার জন্য। সেই আরবীয় দর্শকটিও পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলেন, যে সব ঠিক আছে। এবার জাদুকর হুডিন একটি ছুরি দিয়ে সিসার টোটাগুলি চিহ্নিত করে নিলেন, যাতে এগুলি পরে চেনা যায়। এরপর ওই টোটাটি একটি পিস্তলে ভরা হল। জাদুকর তারপর একটি ছুরির ডগায় একটি আপেল গেঁথে ওই দর্শকের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। বললেন সোজাসুজি হৃদয় লক্ষ্য করে গুলি করো। আরবীয় যুবকটি লক্ষ্যস্থান স্থির করে গুলি ছুঁড়লো। কিন্তু রবার্ট হুডিন-কে গুলি স্পর্শ করল না। তার পরিবর্তে গুলি আপেলটিকে দু'ভাগ করে দিল। আর আপেলের ভিতরে পাওয়া গেল সেই চিহ্নিত বুলেটটি। সারা হলে হইচই পড়ে গেল। 'Djinn! এবং Satan!' এইসব শব্দের আওয়াজের মধ্যে দর্শকগণ হুড়োহুড়ি করে তাদের স্থানত্যাগ করলেন। এর ফলে আরব প্রধানগণ রবার্ট হুডিন-কে একটি সুন্দর কাজ করা টেবিল এবং এক উচ্চ পর্যায়ের জাদুকর ঘোষণা করে সুদৃশ্য প্রশংসাপত্র দিয়েছিলেন। আর তাই মারাবউট (Marabouts) পন্থীরা সম্পূর্ণরূপে অখ্যাতি লাভ করে ছিল এবং ফরাসী সরকারের বিরুদ্ধে আর কোনো বিদ্রোহের কথা শোনা যায়নি।

রবার্ট হুডিন জীবনের শেষের বছরগুলি নানান বৈজ্ঞানিক চর্চায় কাটিয়েছেন। ১৮৭১ খৃষ্টাব্দের জুন মাসে ব্লোইস (Blois)-এর নিকট তাঁর বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ব্লোইস-এ রবার্ট হুডিন-এর স্মৃতিসৌধে রক্ষিত আছে এই মহান জাদুকরের ব্যবহৃত বস্তুসমূহ এবং তাঁর আবিস্কৃত কতকগুলি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ও অন্যান্য আবিস্কার। প্যারিসে তাঁর থিয়েটারটি তাঁর পুত্র এমিল (Emile) কিছুদিন পরিচালনা করেন।

পরে তা প্রতিভাপূর্ন জাদুকর জর্জ মেলিস (George Melies)-এর হাতে হস্তান্তরিত হয়। এই মেলিস ছিলেন সৃজনশীল শিল্পী, যিনি প্রথম জাদু বিষয়ক কতকগুলি চলচ্চিত্র তৈরী করেন, যার মধ্যে কতকগুলি কল্পনামূলক ছোট চিত্রও ছিল। যেগুলির মধ্যে ইন্দ্রজলিক ক্রিয়াকলাপ অদ্ভুতভাবে ফুটে উঠেছিল। এগুলিই সম্ভবত বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র যা বহন করে কাল্পনিক কাহিনী।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে কতিপয় ইউরোপীয় জাদুকরের মধ্যে একজন মাত্র অস্ট্রিয়ান জাদুকর জোহান নেপোমুক হফজিনসার [Johann Nepomuk Hofzinser (1806-1875)], রবার্ট হুডিন-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখা দিয়েছিলেন। তিনি প্রাথমিকভাবে অপেশাদার জাদুকর ছিলেন। সাধারণ দর্শকের সামনে খুব অল্প প্রদর্শনী করে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী সমস্ত গোপন কার্যাবলি ধ্বংস করে ফেলেন। তা সত্ত্বেও হফজিনসার-এর বেশ কিছু নথিপত্র ভিয়েনার এক জাদুলেখক অটোকার ফিশার [Ottokar Fischer (১৮৭৩-১৯৪০)] উদ্ধার করেছিলেন। জাদুকর হফজিনসার বহু রকমের ড্রইংরুম ম্যাজিক দেখিয়েছেন। কিন্তু তিনি বিশেষভাবে বিখ্যাত ছিলেন তাসের ম্যাজিকের জন্য। তাঁর Card manipulation-এর নিপুণতা এক পৌরাণিক কাহিনীতে পরিণত হয়েছে। এটা খুবই সৌভাগ্যের বিষয় যে, ফিশার এই সকল কৌশলের অধিকাংশই সংরক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁর লিখিত "J. N. Hofzinser's Card Conjuring" বইটিতে।

এবার আমরা ইউরোপের জাদু থেকে একটু সরে গিয়ে আগামী সংখ্যায় দেখব নতুন পৃথিবীতে এই সময় আর কি কি ঘটেছিল।

(ক্রমশ)