জীবনানন্দ দাশ (১৯.০২.১৮৯৯ - ২২.১০.১৯৫৪)
বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন, দেখেছেন রক্তপাত, অজস্র মৃত্যু দেখেছেন, দেখেছেন মন্বন্তর, তবুও একাকী নিঃশব্দে অন্ধকারে হাজার বছর হেঁটেছিলেন পৃথিবীর পথে।
আজও হাজার হাজার মানুষ নিঃশব্দে নীরবে অন্ধকারে তাঁর সঙ্গে হেঁটে চলেছেন হাজার বছরের পথে...
সেখানে ধর্ম নেই, জাতপাত নেই, নেই সংঘাত। আছে অক্ষম পিঁচুটি, আছে কৃমি, কীট খুঁটে খাওয়ার চেষ্টা, আর আছে বিস্ময়, অপার বিস্ময়!
"জানি - তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ - নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় -
আরও এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে..."
দেখেছেন পরাধীনতা, পরাধীনতার গ্লানি। দেখেছেন স্বাধীনতা, আর স্বাধীনতার উল্লাস। এসব নীরবে সরিয়ে রেখে, নির্জনের কবি, নির্জনতম কবি একাকী, নিঃসঙ্গ হেঁটেছেন অন্ধকারে হাজার বছর পৃথিবীর পথে বেবিলন থেকে বিদর্ভ, ট্রয় থেকে টোকিও, মিশর থেকে মালয় সাগরে। তাঁর মতো করে নীরবে নিঃশব্দে কয়েক হাজার প্রজন্মের মানুষ তাঁরই সঙ্গে হাঁটতে থাকবে প্রকৃতির রূপ, অন্ধকারের রূপ, মানস মানুষীর সন্ধানে...
কবি যখন গভীরভাবে পৃথিবীর মাঠের দিকে তাকান, তখন ভেসে ওঠে...
"নিড়োনো হয়েছে মাঠ পৃথিবীর চারদিকে,
শস্যের ক্ষেত চ'ষে-চ'ষে
গেছে চাষা চ'লে;
তাদের মাটির গল্প - তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হলে
অনেক তবুও থাকে বাকি -
তুমি জানো - এ পৃথিবী আজ জানে তা কি!"
যখন নগরীর বুকে চোখ রাখেন, তখন দেখেন...
"ফিরিঙ্গি যুবক ক'টি চলে ছিমছাম।
থামে ঠেস দিয়ে এক লোল নিগ্রো হাসে;
হাতের ব্রায়ার পাইপ পরিস্কার ক'রে
বুড়ো এক গরিলার মতো বিশ্বাসে।
নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয়
লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।
তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব-অতিবৈতনিক,
বস্তুত কাপড় পরে লজ্জাবশত।"
যখন হারানো পাড়াগাঁর কথা মনে পড়ে, তখন তাঁর কলমে ফুটে ওঠে...
"মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ;
উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক
কল্পনার হাঁস সব; পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রঙ মুছে গেলে পর
উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।"
যখন প্রেম আসে, প্রেয়সীর খোঁজে লেখা হতে থাকে...
"পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু'জনার মনে;
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হ'য়ে আকাশে-আকাশে।"
"অনেক মুহূর্ত আমি ক্ষয়
ক'রে ফেলে বুঝেছি সময়
যদিও অনন্ত, তবু প্রেম সে অনন্ত নয়।
তবুও তোমাকে ভালোবেসে
মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এসে
বুঝেছি অকূলে জেগে রয়ঃ
ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি এ-হৃদয়।"
"আমাকে সে নিয়েছিল ডেকে;
বলেছিলঃ এ নদীর জল
তোমার চোখের মতো ম্লান বেতফল;
সব ক্লান্তি রক্তের থেকে
স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;
এই নদী তুমি।"
"নিঃসঙ্গ বুকের গানে
নিশীথের বাতাসের মতো
একদিন এসেছিলে,
দিয়েছিলে একরাত্রি দিতে পারে যত।"
"ওইখানে একজন শুয়ে আছে- দিনরাত দেখা হতো কতো কতো দিন,
হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কতো অপরাধ;
শান্তি তবুঃ গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং
আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।"
যখন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, দাঙ্গা তাঁর মনকে ক্ষতবিক্ষত ও পীড়িত করে, তাঁর ব্যথাতুর কলম আমাদের উপহার দেয়...
"মানুষ মেরেছি আমি- তার রক্তে আমার শরীর
ভ'রে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার
ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু
হৃদয়ে কঠিন হ'য়ে বধ ক'রে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর
কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে
বধ ক'রে ঘুমাতেছি..."
জীবনের দ্বন্দ্ব গভীরভাবে অনুভব করে যখন জানলেন ভারসাম্যের সূত্র, তখন তাঁর মনে পড়ে অনুপম ত্রিবেদীকে।
"জড় ও অজড় ডায়ালেকটিক মিলে আমাদের দু'দিকের কান
টানে বলে বেঁচে থাকি - ত্রিবেদীকে বেশি জোরে দিয়েছিলো টান।"
যে মননশীল মরমী কবি বাঙ্গালীকে চিরকালের জন্য বোধের কানাগলিতে আবদ্ধ করে রেখে দিয়ে চলে গেছেন তাঁর কবিতার কয়েকটি পংক্তিতে...
"মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয় - প্রেম নয় - কোনো এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরেঃ
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়।
অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ
মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!"
তাই সুগভীর নির্জনতার কবি হয়তো বলতে চেয়েছেন, আমাকে আলাদা করে, ভিন্নভাবে আর খোঁজার দরকার নেই, বাংলার মাঠ, ঘাট, প্রকৃতির মাঝে আমি চিরন্তনভাবে রয়ে গিয়েছি। সে কারণে তাঁর কলম গেয়ে উঠেছে -
"হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে ডিঙা বায়;
রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বকঃ আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে -"
[২২শে অক্টোবর, ২০২৪ বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ-এর ৭১তম প্রয়াণ দিবস (১৯৫৪) উপলক্ষে এই লেখাটি প্রকাশিত হল।]