।। ১ ।।
ধ্বনিবিপর্যয়ের কাহিনি আমাদের সকলের জানা। তবু্ও আমরা প্রতিদিন, প্রত্যেকে আরও একটা নতুন বিপর্যয় কাহিনি লিখি আর ঘুমিয়ে পড়ি সে কাহিনি কাউকে শোনানোর আগেই।
ঘুম ভাঙলেও স্বপ্ন সহজে ভাঙে না। তাকে ফুল, বেলপাতা, তেল, সিঁদুর দিই আর ঘুমিয়ে পড়ি আবার।
এইসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধ্বনিবিপর্যয়ের কাছে নিজেকে সঁপে দিই। নীরবতা হাসে। হাসতে থাকে সারাজীবন। আমাদের এই চার্লি চ্যাপলিনের জীবন দেখে তার হাসি পায় অথচ আমরা ভিতরে ভিতরে কাঁদি। স্বপ্নগুলোর পুজো করি, অথচ প্রসাদ জোটে না। ক্লান্ত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। নিঃস্ব হবার আগে আরও অনেকবার বিপর্যস্ত আমরা প্রত্যেকেই নিজেকে পুজো করতে থাকি।
স্বপ্নগুলো হারিয়ে যায় বিপর্যয়ের ধ্বনি শুনতে শুনতে।
।। ২ ।।
ধ্বনিগুলো কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ট্রেনের হুইসেল, যাওয়া আসার আওয়াজ, যাত্রীদের ট্রলির চাকার আওয়াজ মিশে আসছে কানের কাছে আর তারপর হুট করেই কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের শিকার হয়ে ধ্বনি উল্লাস করতে থাকে। এই ফাঁকে আমরা অন্ধকার নিয়ে ভাবি। আমাদের আলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি। সেইসব ভাবনার চাবি এইসব ধ্বনি বিপর্যয়ের ভ্রমণকাহিনিতে হারিয়ে যায়। অপেক্ষার শেষ রাত ফুরোয় না। ঘুম আসে চোখে। পাইন বনের গান কানের পাশে বাজে। পাহাড়ি ঝরনা ডাকে অচেনা ইশারায়। নদীর বুকে জমা পাথরের গায়ে জলের তরঙ্গ যে ধ্বনি তোলে তা ওষুধের মতো কাজ করে। ধ্বনিবিপর্যয়ের শোকগাথা ভুলে একদল প্রবীণ প্রজাপতি নতুন করে বাঁচার পাঠ নেয় পথে বসে। অপেক্ষার নির্জনতা তাদের ডাকছে। হোম স্টের বারান্দায় রাখা মরসুমি ফুলের রং তাদের ডাকছে আর তারা জীবনের প্রতিটি খরচের হিসাব রাখছে বেহিসাবি ধ্বনির শরীরে।
।। ৩ ।।
ধ্বনি ভেঙে যাচ্ছে। গল্প ভেঙে ভেঙে গুঁড়ো হচ্ছে অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাসে। তারপর প্রত্যেকেই নিজেকে গুছিয়ে, কাউকে সঙ্গে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে নির্জনতার আদর বোঝার চেষ্টা করছে এতসব ধ্বনি বিপর্যয়ের ভুল বোঝাবুঝির মধ্যে। পাহাড়ি হাওয়া নেমে এসেছে শহরের পথে। এখানে সেও তার সঙ্গী খুঁজে নিতে চাইছে। তবে, সে জানে এই সঙ্গলাভ ক্ষণস্থায়ী। আমরা এই সত্যির কিছুই জানি না, কিছুই বুঝি না। যদি বা অনুভব করতে পারি, তবুও মেনে নিতে পারি না। আমাদের প্রত্যেকের অপূর্ণতাকে পূর্ণ করতে নির্জনতার খোঁজ করি। ভোগ করি কল্পনার আতিশয্য। উপভোগ করি কল্পনার উষ্ণ আদর আর বরফ শীতল অভ্যর্থনা। কল্পনার ধ্বনি বিপর্যয়ে মুখর হবার আগেই হয়তো স্বপ্ন ভেঙে যাবে প্রত্যেকের। কিন্তু এই মুহূর্তে সেইসব কথা ভেবে লাভ কী কিছু আছ? শেষ পর্যন্ত ভ্রমণ কাহিনি ঘুরে ফিরে লাভ আর ক্ষতির গল্পে শেষ হবে কি না জানার আগেই আমরা প্রস্তুতি নিই অপেক্ষাপর্ব ভেঙে শিস দিতে দিতে এগিয়ে যেতে। যাবতীয় ট্রেনের হুইসেলের আওয়াজ থেকে দূরে, যাবতীয় কোলাহল আর ব্যস্ততা থেকে দূরে সরে যাবার এক প্রাণান্তকর চেষ্টায় কত যে ধ্বনি তার বিপর্যয়ের নিয়তি থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করবে এখন শুধু তাই-ই দেখার।
।। ৪ ।।
দিনের আলো ফুটলে অস্বস্তি বাড়ে। ওভারব্রিজের ওপর পলিথিন বিছিয়ে শুয়ে পড়া মানুষগুলো হঠাৎ করেই খুব বেশি সচেতন হয়ে পড়ে। নিজেকে গুছিয়ে নিতে থাকে। ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাওয়া গল্পগুলোর আড়ালে নিজেকে ঢেকে নিতে চায়। পথচারীদের দৃষ্টির বাইরে গিয়ে নিজেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো মনে করতে চাইলেও পারে না। এই না পারার মুহূর্তগুলো বড়ো হয়ে ওঠার দিনগুলোকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। অথচ, প্রত্যেকেই কিছুদিন ভালোভাবে বেঁচেছে আর কিছুদিন খারাপভাবে। ভালো আর খারাপের অনুভূতিগুলো প্রত্যেকেরই ভীষণ প্রবল অথচ তারপরও কৈশোরের দিনগুলোর ডাকে আজ তারা ছুটে চলেছে কোনও না কোনও পাহাড়ের খাদে দাঁড়িয়ে প্রতিধ্বনির মজা নিতে। কারও নাম ধরে ডাকার প্রতিধ্বনি আজ কীভাবে প্রত্যেকের কাছে ফিরে আসবে সেটাই দেখার। কীভাবে স্মৃতির গুল্মলতায় উঠে আসবে ফেলে আসা প্রেম আর বিরহের ঘ্রাণ আজ সেটাও অনুভব করবে প্রত্যেকে। নির্ভেজাল অবসর জুড়ে আরও কত ধ্বনি আমাদের প্রত্যেককেই বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করাবে তা এই ভ্রমণকাহিনি লিখে রেখে যাবে। প্রত্যেকেই বুঝে নেবে ফিরে পাওয়ার আয়ু। স্মৃতির সদ্ভাবে প্রত্যেকেই অগোছালো করে নেবে মুহূর্তের জীবন আর নিম্নচাপজনিত জলবায়ু। ঝড়, হাওয়া আর বৃষ্টির ধ্বনিবিপর্যয়ের ফাঁকে ফাঁকে হেসে উঠবে স্মৃতি বিজড়িত উল্লাস আর দুর্ঘটনাজনিত রক্তপাত।
।। ৫ ।।
শব্দ ব্রহ্ম। ঘুরপাক খায়। বিশ্রামের সুযোগ হারিয়ে সে ঘুরপাক খায়। ভ্রমণের পথ হারিয়ে আমরা প্রত্যেকেই ঘুরপাক খাচ্ছি ক্লান্ত, অবসন্ন দেহে পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে। একে অপরকে দোষারোপ করছি মৃদুস্বরে অথবা নীরব থেকে। গোপন ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র প্রদক্ষিণ করে আমরাও প্রশিক্ষাহীন ছবি আঁকার কথা ভাবছি ডেলো বাগানের ফুলের দিকে তাকিয়ে। আমাদের স্বপ্নের ধ্বনি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে ভ্রমণপিপাসু মানুষের কৌতুহলী ট্রাফিকজ্যামে। এভাবেই প্রতিটি অবসরযাপন ক্লান্তিকর জীবনের সাধনায় জড়িয়ে পড়ে। ভালবাসাহীন আদরের শীৎকারধ্বনি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে আর্তনাদ করে। পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে বাঁকে পরিযায়ী জীবনের সুর ভেঙে ভেঙে আসে কানে। তার গানে শব্দ ব্রহ্ম ভেঙে যায়, গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায় কুয়াশার মতন। আমরা সকলেই সেই পথ ধরে ভেঙে যাই, ভেঙে পড়ি। ধ্বনি বিপর্যয়ের মতো প্রত্যেকের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
সেই বন্দীদশা থেকে মুক্তির পথ খোঁজাই বেঁচে থাকার কারণ। খুঁজে পাওয়া বা না পাওয়ার ভিতর ক্লান্তিকর ধ্বনিগুলোকে পরিত্যাগ করা সম্ভব। অথচ অসম্ভবের মুঠো থেকে সময়ের ধ্বনি গড়িয়ে পড়ে নিজস্ব নিয়মে। প্রকৃতির ওমে সময় পরিপুষ্ট হয়। তার ধ্বনিবিপর্যয় নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই। শুধু আমরা নিছক সাময়িক সুখ লাভের আশায় একের পর এক শব্দ সাজিয়ে, এলোমেলো করে এগিয়ে যাচ্ছি বিপর্যয়ের দিকে। যে বিপর্যয়ের আলো নেই, অন্ধকারও নেই; নেই মুক্তি, নেই বন্দী হবার ভয়। তবু, এক নেশা ধ্বনি বিপর্যয়ের দিকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সারি সারি ভ্রাম্যমাণ যানবাহনের দাপটে নীরবতার শব্দ ব্রহ্ম ভেঙে পড়ছে যেন পাহাড়ের শরীর ভেঙে নামছে ধ্বস আর সব পথ বন্ধ হয়ে গিয়ে আমাদের রক্তে বেজে চলেছে এক হাহাকার ধ্বনি।
।। ৬ ।।
প্রতিটি মুক্তিই কি স্বাধীনতা? প্রতিটি স্বাধীনতাই কি উচ্ছৃঙ্খলতার নামান্তর? ভ্রমণের প্রথম রাত্রে এরকম প্রশ্নগুলো ভিড় করে এলো। রঙিন জলের ফোয়ারা আর উচ্ছ্বাসের চিৎকারে পাহাড়ি গ্রামের পরিবেশ ক্রমশ পরিবর্তনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তা আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। ঘুমিয়ে পড়ার অভিমান নেমে এলো বৃষ্টি হয়ে। রেমালের প্রভাব নাকি পাহাড়ি গ্রামের অভিমান এ নিয়ে তর্ক করার কিছু নেই, কেউ নেই। অবসর কীভাবে কাটাবে তা কারোর পরিকল্পনায় নেই। বৃষ্টি ফিরে এলে বাইরে বেরোনোর প্ল্যান ভেস্তে যাবার ভয় গিলে নেয় সক্কলে সকালের চায়ের সাথে। ভিড়ের মধ্যে একা থাকার পাহাড়ি গন্ধ গায়ে মেখে কুয়াশার সাথে বন্ধুত্ব করার সুযোগ হারিয়ে ফেলে অনেকেই স্মৃতি নিয়ে খেলা করছে। হাসছে, গাইছে, কাঁদছে অথবা ভুলছে নিজের অতীত। এই মুহূর্তে স্মৃতি তার অতিথি নাকি সে নিজে অতিথি এই পাহাড়ি গ্রামে, এ হিসাব ভুলে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না জেনেই আমরা সারাদিনের পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যাই বৃষ্টির মাধুর্য মাথায় নিয়েই।
সন্ধ্যে হলেই রঙিন জলের আসরে বন্ধুরা স্মার্ট অথবা উচ্ছৃঙ্খল হবার প্রতিযোগিতায় নামে। সুখ আর ঐশ্বর্যের প্রতিযোগিতায় নিজেদের একান্ত ব্যক্তিগত গোপন শোকের ছায়া এসে পড়ে মুখে। প্রতিটি ধ্বনি বাচালতার আশ্রয়ে খিস্তিখেউড়ের মুখোশে অবসাদের ঘ্রাণ এসে পৌঁছায় হোমস্টের রুমে।
গাঢ় হতাশার ধ্বনি বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। আর আমরাও সকালের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘার উজ্জ্বল মুখ দেখে ভুলে যাই ধ্বনিবিপর্যয়ের ইতিহাস।
।। ৭ ।।
সময়ের গোপন স্বরে যে পাঠে ধ্বনি বিপর্যয়ের নির্মাণ কৌশল শিখে নিতে হয়, সেই পাঠ আমাদের কোনও পাঠশালা শেখায়নি অথবা আমরা নিজেরাই শিখে উঠতে পারিনি। আর পারিনি বলেই মাঝেমধ্যে কৈশোরের অন্ধকার সুরগুলো আজ আমাদের আলোকিত করে তুললে আমরা অস্বস্তিতে পড়ি। সেই অস্বস্তি কখনও আমাদের বাধ্য করে স্মৃতির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে। অথচ, সবসময় আমরা তা করে উঠতে পারি না। উল্লাসধ্বনির বুকে যে হাহাকার ধ্বনি ওঠে তা আমাদের স্মৃতির ঘ্রাণকে ভুলে যেতে সাহায্য করে বটে কিন্তু আমরা ভুলতে পারি না পুরোপুরি। এ দায় আমাদের। রক্তাক্ত হতে হয় প্রতিমুহূর্তে এইসব ধ্বনিবিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
মুঠো খুলে দেখি হাতের তালুতে রক্তের দাগ। প্রতিটি আঙুলে স্মৃতি হত্যাকারীর অভিশাপ। পাশাপাশি বসে থাকা যায় না সেইসব ধ্বনির সাথে অথবা ধ্বনিবিপর্যয়ের সাথে। নিজেকে অসহায় মনে হয়। হয়তো এই বোধ সকলের এক নয়। হয়তো সবাই এভাবে ভাবতে পারে না বলেই উল্লাসধ্বনির ভিতরে জন্ম নেয় আর্তনাদ। ব্যক্তিগত শোকের মুহূর্ত ভুলতে যে স্মৃতির কাছে আশ্রয় নিতে চাওয়ার অভিনয় আমরা প্রত্যেকেই করি, সেই শোকের শরীরে আরও বড়ও কোনও নখের আঁচড় নিয়ে অবসরযাপনের সুসজ্জিত মঞ্চে আমরা দাঁড়িয়েছি নির্দ্ধিধায়। হায়, তবু এই সত্য স্বীকার করে কোনও আরাম নেই। নেই কোনও স্বস্তি। শুধু বারবার একই অস্বস্তি ফিরে ফিরে আসে। উল্লাসধ্বনি বিপর্যয়ের সন্ত্রাসে মুখর যখন নীরব হয় তখন আমাদের সামনে শুধু আমরাই দাঁড়িয়ে। নিজেকে হারিয়ে নিজে জয়ধ্বনি দেবার মতো উন্মাদনায় প্রত্যেকটি বেঁচে থাকা কী অদ্ভুত! ভাবি আর বিস্মিত হই। বিস্মিত হই আর ডুব দিই অবচেতনের অন্ধকারে। তুলে আনি শব্দের ধ্বনি আর তার বিপর্যয়ের ছন্দ। ছন্দের আড়ালে দ্বন্দ্ব আর দ্বিধার আলো ও অন্ধকার ধ্বনিবিপর্যয়ের ভ্রমণকাহিনি লিখলে মনে হয় বিপর্যয়ও অনেক অনেক কাহিনির সম্পূর্ণতা এনে দেয়।